লেখাটিকে বুক রিভিউ বলবোনা। তবে বলবো
'না'। অনেক গুলো না আর না এর সমষ্টি কে ঘিরে দেশের অর্ধেক শতাংশ মেয়ের জীবন আজও আচ্ছন্ন। আর অর্ধেকই বা বলি কি করে, এই করতে হয় আর এই করতে হয়নার গণ্ডী তো একটা শিশু তৈরী করতে পারেনা! এই সংস্কার তৈরী করে দেওয়া হয়। আর এই গণ্ডীই ক্রমশ একটা মেয়েকে সংকীর্ণতার জাঁতাকলে ঠেসে ধরে। কারণ 'যুক্তি দিয়ে বোঝার আগে আমরা সমালোচনা করতে শিখি।' তো এই জাঁতাকলে কেউ পিষে যায় আর কেউ জোড় করে কলুর বলদের চোখের ঠুলিটা ঠেসে খুলে ফেলে। কিন্তু এখানেও একটা বাধা আছে। আর সেই বাধাটা আছে সবচেয়ে বেশি যারা আপনজন, তাদের কাছেই।
তবুও কিছু কিছু মেয়ে থাকে যারা অভিমান, ভয়, রাগ, ঘৃণা, জড়তা কে জড়িয়ে থেকেও ঘুরে দাঁড়াতে পারে। অন্তর দ্বন্দ্ব কে কাটিয়ে উঠে খুঁজে নিতে পারে নিজের পথ। সিসিফাসের মত ভালোবেসে ফেলতে পারে নিজের অবস্থাটাকে। তেমনি এক মেয়ের গল্প 'আমি রাইকিশোরী'।
যেখানে একা একটা মেয়ে জনস্রোতের বিপুল তরঙ্গে, পদবীর বাগাড়ম্বর কে অস্বীকার করে খুঁজে পেতে চায় 'আমি'কে। এই গল্প সেই সব মেয়েদের। রাইকিশোরীর মনলোক হয়তো আমাদের অনেকের সাথে মেলে, অনেকের সাথে মেলেনা। আমরা যারা ভাবকল্পনার সাথে নিয়ত মুখোমুখি হই, নিজেই নিজেকে বোঝাই, নিজেই নিজেকে ভাঙি রাইকিশোরী তাদের দলে। আসলে রাইকিশোরীর মনলোকে শুধু রাইকিশোরী নেই, আছে তার পরিবার। মা, মাসির দুর্বলতা, পিসির বাস্তবজ্ঞান, বাবার স্নিগ্ধতা, দাদার উদার মানসিকতা। কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতা গিয়ে একা একটা লেডিজহোস্টেল এর বৈচিত্র্য পূর্ণ শহুরে মানসিকতায় মফস্বলের মেয়ে রাইকিশোরীরা আজও হঠাৎ অনভ্যস্ত জড়তা, লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। এগিয়ে আসে কাঁকনরা। ঠেলে তোলে, শক্তি দেয়। পাশে এসে দাঁড়ায় ডিমা বা ক্রিশ্চিনের মতো বন্ধুরা। ভেঙে দেয় ঠুনকো কুসংস্কারের বেড়াজাল।
প্রতি মুহূর্তে পথে ঘাটে নোংরা চোখের দৃষ্টিতে ধর্ষিত হতে থাকা মেয়েরা এভাবেই ঠেকে ঠেকে বাঁচতে শিখে যায়। চুপ করে সহ্য করতে করতে একদিন মুখ খুলে ফেলে। প্রতিবাদ করতে শিখে যায়। কারণ ততদিনে বিষাক্ত বিশ্বাস গুলো প্রবল অবিশ্বাসী হয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে।
আরো কেউ কেউ থাকে যারা অন্যভাবে জীবনটাকে দেখে। যেমন শুভ্রা কিংবা কাকলিরা। এদের জীবন ও চলে এদের নিজের খাতে। কেউ নিজেকে খুঁজে পায় আর কেউ সুযোগ পেয়েও হারিয়ে যায় নর্দমার কাদায়। ওরাও বাঁচে। ওরাও বাঁচতে চায়। কিংবা ব্রততীর মতো মেয়েরা!! লেসবিয়ান শব্দটা আজ যতটা কমন সেদিনের প্রেক্ষাপটে তো তা ছিলোনা। তবুও ব্রততীরা সারভাইব করতে পারে। শুধুই শরীর কিংবা মন নয় আসলে ওরা প্রত্যেকেই একটু সুখ খোঁজে।
একটা লেডিজ হোস্টেলের প্রতিটি বেডে, প্রতিটা তাকে কত আলাদা আলাদা গল্পকে এক ছাদের তলায় এনেছেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য। এই হোস্টেল টা একটু আলাদা। কারণ এরা কেউ স্টুডেন্ট নয়। ছাত্র বা ছাত্রী কথাটা লিখতে পাড়লাম না। রাইকিশোরী বোধহয় আমাকে প্রবল ভাবে নাড়া দিয়ে গেল। আমরাই তো সমাজ গড়ি। মেয়েমানুষ পুরুষমানুষে তফাৎ করি। আমরাই আমাদের পরম শত্রু হয়ে লড়াই করে মরি।
পুরুষের চোখে মেয়েরা প্রতি মুহূর্তে মাপা হতে থাকে। কখনো মারধোর, অত্যাচার। কখনো শরীরের খিদে আবার কখনো শুধুই কথার ঠারে ঠারে নিচু করার ছোট করার প্রবণতা একটি কিংবা অসংখ্য লড়াকু মেয়ের প্রতি মুহূর্তকে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। কিন্তু এই সব সংকীর্ণতা কি আবীরদেরও ছুঁয়ে ফেলে? তবেকি রাইকিশোরী কেবলই কৃষ্ণের শতশত গোপীসখীর মাঝে আর এক ব্যর্থ প্রেমিকা!! সেই প্রশ্নের ও উত্তর খোঁজেন লেখিকা।
বারবার কখনো আকাশ, কখনো জবচার্ণক, কখনো চেয়ার বন্ধু হয়ে কথা বলে। দুটো স্বত্ত্বা। কেউ আঘাত দেয়, কেউ মলম লাগায়। এভাবেই তো বাঁচতে হয়। ভালোবাসতে হয় নিজেকে। এই ভাবেই রাইকিশোরীরা বাঁচতে শেখে। কিন্তু হায়রে পোড়া মনের গোপন গাথা কেই বা বোঝে তার পথের গতি। জীবন কি চেনা ছকে চলে? না চলতে পারে? নাকি চলেছে কোনোদিনও।
যে প্রেমে এত যন্ত্রণা সেই প্রেমের জন্যই আকুল হয় নারী হৃদয়। সেই প্রেমের জন্যেই হন্যে হয়ে মরে। সেই নদীর এপার ওপারের গল্প। তবুও সুচিত্রা ভট্টাচার্য এখানে স্বতন্ত্র।
তাই ক্রিশ্চিন পারে তার প্রেমিক কে প্রত্যাখ্যান করে আত্মসম্মান কে বেছে নিতে। ফিরে আসতে পারে জীবনের চেনা মূলস্রোতে। স্বপ্ন দেখতে পারে নতুন করে বাঁচবার। তাই উপন্যাস কেবল নিজেকে খোঁজার লড়াই হয়ে থেকে যায় না, পৌঁছায় একটা সিদ্ধান্তে। জীবনের একটা সঠিক সিদ্ধান্তে।
পাঠাতে পারেন আপনাদের বইয়ের সমলোচনা আমাদের মেইল করে- blogtog18@gmail.com
No comments:
Post a Comment