‘পদ্মাবতী’ চরিত্রটি কতখানি ঐতিহাসিক
ও কতখানি কবিমনের কাল্পনিক চরিত্র তা নিয়ে কয়েকমাস যাবৎ দেশের মানুষ মারকাটাকাটি
করে দেশকে উত্তাল করে রেখেছিল আর তার উৎস ছিল সঞ্জয়লীলা বনশালির ‘পদ্মাবতী’
সিনেমা। তরোয়াল বের করে মুণ্ডচ্ছেদের উপক্রম হয়েছিল রাজস্থানের রাজপুতেরা। কারণ,
পদ্মাবতী তাদের কাছে পূজ্যদেবী; তাঁকে নিয়ে বানানো সিনেমাতে পরিচালক দেখিয়েছেন
তাঁর দৈহিক সঙ্গসুখের চিত্র। তাই নিয়ে পেপারে পেপারে শয়ে শয়ে লেখা বের হওয়া, সেন্সরবোর্ড
থেকে কাটাছেঁড়া। এই কাহিনিতেই মানুষজন মশগুল হয়ে সকালের চা-পানি সারছিল। তবে আমার
লেখার বিষয় সিনেমা সমালোচনা নয়। আমার বিষয় ‘পদ্মাবতী’ কাব্য। তাই প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিত রায়ের
কিছু কথা তুলে ধরে এ প্রসঙ্গের ইতি টানবো। “ চলচ্চিত্রে যে অন্য শিল্প-সাহিত্যের
লক্ষণ আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।… উপন্যাসের কাহিনী ও পরিবেশ বর্ণনা...পেইন্টিং সুলভ আলোছায়ার
ব্যঞ্জনা এ সবই চলচ্চিত্রে স্থান পেয়েছে। কিন্তু ইমেজ ও ধ্বনির যে ভাষা...সে
একেবারে স্বতন্ত্র ভাষা।...ফলে ভঙ্গির তফাত হতে বাধ্য। এ ভঙ্গি চলচ্চিত্রের বিশেষ
ভঙ্গি।“১
সিনেমার কথা দিয়ে শুরু করার এটাই
কারন যে, এম এ পড়াকালিন আমি শুধু পরীক্ষা দেবার জন্য আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ পড়েছিলাম,
আর পড়েছিলাম বলেই সিনেমা দেখার ইচ্ছেটাও
জেগেছিল। সিনেমা দেখার পর পুনরায় গভীরভাবে অধ্যায়ন করার মন হল। অধ্যায়নের সময় নতুন
নতুন তথ্য জানতে পারলাম। একটা কাব্য বা উপন্যাস পড়ে মনের ভিতরে নানা ধরনের যে
প্রশন উঠে আসে তার উত্তর খোঁজার জন্য পাঠকেরা লিখতে বসে, আমি সেরকম একজন পাঠক। এই
সমালোচনা পাঠক মনের সমালোচনা।
আলাওলের পদ্মাবতী কাব্যটি মৌ্লিক
কাব্য নয়, অনুবাদ কাব্য। মূল কাব্যটি হিন্দি ভাষায় লেখা মালিক মুহম্মদ জায়সীর
‘পদমাবৎ’। আলাওল তাঁর কাব্যের প্রথমদিকে ‘কবি পরিচয়’ ও ‘কাহিনী সূত্র’ অধ্যায় দুটিতে পদ্মাবতী কাব্যের উৎসরূপে মূল কবি
ও কাব্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছেন-
“
জাইস নগরে বাস কবিকুল গুরু।
সিদ্দিকের বংশভব কুলীন
সুচারু।।...
যখনে রচিল শেখে পুথি পদ্মাবতী।
দিল্লীশ্বর ছিল শের শাহা নরপতি।।“
( কবি পরিচয়)
জানা যাচ্ছে কবি জায়সীর জন্মস্থান
জাইস নগরে। কবির কাব্য রচনাকালের সময় আলাওল দিল্লীশ্বরের নাম উল্লেখ করেছেন।
ইতিহাসের তথ্যানুসারে বলা যেতে পারে কবি জায়সীর কাব্যের রচনাকাল আনুমানিক ১৫৪০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি। সেইসময় দিল্লীর
সুলতান ছিলেন শের শাহ। আবার আলাওল ‘কাহিনী সূত্র’ তে বলেছেন
“ শেখ মহম্মদ যতি/ যখনে রচিল
পুথি/ সংখ্যা সপ্ত বিংশ নব শত”
সপ্ত বিংশ নবশত- ৯২৭ হিজরী। হিজরী মুসলিম বর্ষপঞ্জি। চন্দ্র
মাসের হিসাবে দিন গননা করা হয়। ৬২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে এর গণনা শুরু। তাহলে
৬২২+৯২৭=১৫৪৯ খ্রিস্টাব্দ। আনুমান করা যায় এই দুই সালের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে
জায়সী তাঁর কাব্যটি রচনা করে থাকবেন।
শুরুতেই বলেছি আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ কাব্য
জায়সীর কাব্যের অনুবাদ। কিন্তু কবে, কেন আলাওল অনুবাদ করলেন সে কথায় পরে আসছি। তার
আগে বলা ভালো মূলকে অনুবাদে বোধগম্য করতে গেলে একেবারে ঠিক তার মানানসই করে আঁট
করা চলে না, নিজের ভাষায় তাকে মানানসই করে নিতে হয়। তাই হিন্দি কবি জায়সীর লেখা
রাজপুত কাহিনিকে বাঙালির মর্মগ্রাহী করার জন্য আলাওল তাঁর কাব্যের নানা বিষয়কে
বঙ্গীয় করে নিয়েছেন। পরিবর্জন, পরিবর্তন, সংযোজন, সংক্ষেপ ও বিস্তারের মধ্য দিয়ে
অনুবাদকে শেষ পর্যন্ত এক অন্য পরিনতি দান করেছেন।
আত্মবিবরণিতে তাঁর যে পরিচয় পেয়ে থাকি তা
সংক্ষেপে বললে বলা হয়- ফরিদপুরের অন্তর্গত জালাল্পুরে কবি আলাওলের জন্ম। ফরিদপুর
বাংলাদেশের অন্তর্গত একটি জেলা। কিন্তু তিনি নিজের জন্মসালের কথা কোথাও উল্লেখ
করেননি। তবে তাঁর পিতার নামের উল্লেখ পেয়ে থাকি-
“
মজলিস কুতুব জান তাত অধিপতি।
মুই দীন হীন তান অমাত্য সন্ততি।“ ( আত্মপরিচয় )
ইতিহাস বলছে ,”মজলিস কুতুব ১৫৭৬ থেকে ১৬১১
খ্রিস্টাব্দ ফতেহাবাদে ক্ষমতাসীন ছিলেন।“2 তাই বলতে পারি আলাওলের জন্ম ঐ সময়কালের কোনো এক সময়ে।
পিতার সঙ্গে আলাওল জলপথে পর্যটনকালে
জলদস্যু কর্তৃক আক্রান্ত হন। তারপর পিতাকে হারিয়ে একসময় তিনি রোসাঙ্গে উপনীত হন।
সেখানে নিজের বুদ্ধিমত্তার জন্য মাগন ঠাকুরের আশ্রয় লাভ করেন এবং আরাকান রাজসভায়
সভাসদরূপে প্রতিষ্ঠিত হন। সেই জন্য কাব্যে স্তুতিখণ্ডে বিস্তারিতভাবে মাগন
প্রশস্তি করেছেন এছাড়াও কাব্যের অধিকাংশ অধ্যায়ের শেষে মাগন ঠাকুরের স্তুতিভাজন
করেছেন। আরাকান রাজসভায় একবার জায়সীর পদ্মাবত কাব্যকথা শোনানো হয়, তখন সভাসদ্গনের
হিন্দি বুঝতে অসুবিধের জন্য মাগন ঠাকুর আলাওলকে সরস পয়ারে বাংলায় অনুবাদ করতে
আজ্ঞা দেন। অতঃপর রচিত হল ‘পদ্মাবতী’ কাব্য।
কবি ‘রোসাঙ্গ বর্ণনা’ অংশে আরাকান রাজসভার কথা বলেছেন। আরাকান রাজ্য
ব্রহ্মদেশের উত্তর-পশ্চিম সীমায় ও বাংলাদেশের পূর্ব চট্টগ্রামের সন্নিকটবর্তী
অঞ্চল। প্রাচিনকালে এই রাজ্যের নাম ছিল রোসাঙ্গ। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’তে বলা
হয়েছে আখরঙ। বাহারিস্তান গয়বীতে মীর্জা নাথান এর নাম দিয়েছিলেন আর খঙ—সেখান থেকে
মনে হয় নাম হয়েছে আরাকান। কবি ‘রোসাঙ্গ
বর্ণনা’ শুরু করেছেন-
“ সলিম
রাজার বংশ/ যদ্যপি হইল ধ্বংস/ নৃপগিরি হৈ্ল
রাজ্যপাল”
তারপর রাজা হলেন নৃপগিরির পুত্র সাদ
উমংদার যিনি থদো-মিনতার নামেও পরিচিত। থদো-মিনতার ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে আরাকানের
অধিপতি হন। অর্থাৎ ১৬৪৫ এর কোনো এক সময়ে আলাওল মাগন ঠাকুরের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন।
এছাড়াও ‘রোসাঙ্গ বর্ণনার’ শেষে কবি যেভাবে রোসাঙ্গরাজের আয়ু বৃ্দধি ও কীর্তি
বর্ধনে্র কামনা করেছেন তা থেকে বোঝা যায় আলাওল ‘পদ্মাবতী’ কাব্য থদো-মিনতারের
জীবৎকালেই রচনা করেছিলেন।
‘কাহিনী সূত্র’ তে আলাওল অত্যন্ত
সংক্ষেপে জায়সীর বিশাল কাব্যকাহিনির যথাযথ পরিচয় দিয়েছেন। এই অংশে তিনি সূত্রটুকুই
উল্লেখ করেছেন, ঘটনার বর্ণনা ও সমারোহ বাদ দিয়েছেন। অতঃপর কবি মূল কাহিনির পরিচয়
দিয়েছেন এরূপ--চিতোরের অধিপতি রত্নসেন শুকমুখে পদ্মাবতীর রূপের কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে
রাজকুমারদের নিয়ে যোগীবেশে চললেন সিংহলে। সেখানে অনেক দুঃখ কষ্টের পর লাভ করেন
পদ্মাবতীকে। অতঃপর রাজার প্রথমা স্ত্রী নাগমতীর দুঃখের কথা শুনে পদ্মাবতীকে নিয়ে
ফিরে আসেন চিতোরে। কিন্তু সেখানে বিশ্বস্ত পুরোহিত রাঘব চেতন তার ছলনার জন্য
নির্বাসিত হন। তিনি তখন দিল্লি রওনা দেন এবং দিল্লিশ্ব্র আলাউদ্দীনের কানে
পদ্মাবতীর কথা শুনিয়ে সুলতানের মনে কামনার ঝড় তুলে দেন। তারপর অনেক যুদ্ধ, চিতাধূম
এবং অবশেষে চিতোরকে ইসলাম রাজ্য করে সুলতানের দিল্লী প্রত্যাবর্তন।
মূলানুযায়ী আলাওলের কাব্যে আছে পৃ্থক
রসের দুটি প্লট- একটিতে আছে পদ্মাবতী-রত্নসেন-নাগমতীর প্রেমের রোমান্স; অপরটিতে
রয়েছে রত্নসেন –আলাউদ্দিন-পদ্মাবতীর ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনি যাতে মুখ্য হয়েছে
যুদ্ধের উত্তেজনা। রোমান্স কাহিনির অংশগুলো জায়সীর অনুসরণ হলেও আলাওল তাঁর বাঙালি
কবিমনের রসদ দিয়েই চিত্র এঁকেছেন। অন্যদিকে জায়সীর কাহিনির যেখানে পরিসমাপ্তি
ঘটেছে সেখানে কিন্তু আলাওল তার কাব্যের সমাপ্তি ঘটাননি। বাঙালি কবি আলাওল সম্ভবত জায়সীর
ট্রাজিক সমাপ্তিতে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। ফলে কবি নিজের মতো করে রচনা করলেন এ
কাব্যের এক পরিনাম যেখানে এক বৈষ্ণবীয় প্রেমের আবহাওয়ায় শত্রুতা ভুলে রত্নসেন
আলাউদ্দিনের কাছে ক্ষমাভিক্ষা জানান, পুত্রদ্বয়ের সঙ্গে মৈত্রীস্থাপন করান। যা
মূলের রসপরিনাম থেকে এর রস পরিনতি অন্যদিকে সরে গেছে এবং তা মেলোড্রামায় পরিনত
হয়েছে। কারন কবি ‘খিল খণ্ড’ তে বলেছেন-
“
দুই শিশু ধরে সাহা বিষাদ অন্তর।
শোকগুনি সাহা পুনি কান্দিলা বিস্তর।।“
আলাউদ্দিনের এহেন সহৃদয়তার পরিচয়
কোথাও পাওয়া যায়না। তাই একজন মুসলিম সুলতানের চোখ দিয়ে জল ফেলিয়েছেন তাও আবার শত্রুর
পুত্রের জন্য যা অতিনাটকীয়তা ছাড়া আর কিছুই না। তবে একথা স্বী্কার করতে হবে যে,
শেষে যতই মেলোড্রামা হোকনা কেনো, দেবপালের সঙ্গে যুদ্ধে আহত হয়েও রত্নসেন ‘সুরশশী
সমতুল’ দুই পুত্রের মুখ দেখার জন্য বিষজর্জরিত শরীর নিয়েও বেঁচে ছিলেন, তাতে
আলাওলকে যথার্থ জীবনরসিক কবি বলেই বিবেচ্য করা যায়। তাছাড়ও কবি মূল কাহিনির সঙ্গে
একটা উপকাহিনিও যোগ করেছেন। আলাউদ্দিন কর্তৃ্ক রত্নসেন বন্দী হবার পর শুরু হয়েছে
এই উপকাহিনি। পদ্মিনীর উপর আলাউদ্দিন ছাড়াও কুম্ভলনিরের রাজা দেবপালের নজর ছিল।
রত্নসেনের বন্দীদশা শুনেই দেবপাল পদ্মিনীকে পাবার ছলনা করে। গোরা-বাদলের সাহায্যে
রত্নসেন মুক্ত হয়ে আসার পর, পদ্মাবতী দেবপালের ঘটনা শোনায়। অন্যদিকে কবি শোনান
দিল্লিশ্বরের সঙ্গে গোরা-বাদলের যুদ্ধ। তারপরেও কবি কাহিনির পরিনতি না দিয়ে শুরু
করেন দেবপাল-রত্নসেনের যুদ্ধকাহিনি। আহত অবস্থায় কবি রত্নসেনকে বাঁচিয়ে রাখেন একটা
মিলনান্তক ছবি দেখাবার জন্য। এদিক থেকে তাঁর কবি হৃদয়ের সৌহার্দতা ফুটে ওঠে।
আলাওল ধর্মমতে ছিলেন ‘সুফি’
সম্প্রদায়ভুক্ত। এই পরিচয় তাঁর ‘আত্মপরিচয়’ অংশে পেয়ে থাকি। কবি বলেছেন-
‘’ যার
হৃদে জনমিল প্রেমের অঙ্কুর।
মুক্তিপদ পায় সেই সভান ঠাকুর ।।...
যার
হৃদে বিরহের জ্যোতি প্রকাশিল।
সুখ
মোক্ষ প্রাপ্তি তার আপদ তরিল।।“ (
আত্মপরিচয় )
কী এই সুফিতত্ত্ব? কারাই বা সুফিবাদী?
কেনই বা বাংলা সাহিত্যে এর প্রভাব পড়ল? এইসব প্রশ্নের উত্তর অনেক পণ্ডিত ব্যক্তিরা
নানাভাবে বলে গেছেন। সুফি শব্দের দুটি ব্যুৎপত্তিগত অর্থ পাওয়া যায়। এক, ‘সুফি শব্দটি আরবি ‘সাফা’ থেকে
এসেছে, যার অর্থ পবিত্রতা। দুই, আরবি শব্দ ‘সুফ’ থেকে আগত সুফি, যার অর্থ পশম বা
পোশাক।‘৩ মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারা এই সুফিতত্ত্ব। এ ধারা সৃষ্টির
প্রেরণা এসেছিল বহিরাগত সুফি সাধকদের কাছ থেকে। তাঁরা মুসলিম বিজয়ের আগে থেকেই
আরব-ইরান হতে বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছিলেন। তের শতকে তুর্কি সুলতান বখতিয়ার খলজী
কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ের পর রাজপুরুষ, বণিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে
ধর্মজ্ঞানী আলেম ও পীরদরবেশদেরও আগমন বেড়ে যায়। তারাই প্রচার করতে শুরু করে
সুফিবাদের। সুফি ধর্মদর্শনের মূলকথা হল ঈশ্বরের প্রেমে সমস্ত জগৎ পরিব্যাপ্ত।।
মানুষের মধ্যে সেই অপার্থিব প্রেম জেগে উঠলে তার হৃদয়ে ঈশ্বরের জন্য যে বিরহবোধ
জেগে ওঠে সেই বিরহের অগ্নিতে আত্মনাশ হলেই ভগবানের সঙ্গে তার পূর্ণ-মিলন এবং সেই
মিলনের মধ্যেই তার মুক্তি। সুফিদের উদারনীতি, মানবপ্রেমের ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে
সমাজের অবহেলিত, নিপীড়িত ও বঞ্চিত মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। তাদের মানসিক চাহিদা
নিবৃত্তির জন্য সুফি ভাবধারার কবিগণ বাংলা ভাষায় যে সাহিত্য নির্মান করতে থাকেন তা
কালক্রমে সুফিসাহিত্য নামে পরিচিত হয়। পদ্মাবতী কাব্যের মূল কবি জায়সীও
সুফিসম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন। তাঁর কাব্য অনুবাদ করতে গিয়ে মনে হতে পারে আলাওলও
সম্পূর্ণ সুফিতত্ত্বের কথাই বলেছেন। কিন্তু সুফি ধর্মাবলম্বী আলাওল সুফিধর্মের
ভিতর থেকে অর্জন করেছিলেন এক উদার অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী যার প্রভাব পড়েছে এই
কাব্যের পরিণতির ক্ষেত্রে। তাই অনুবাদে রত্নসেন-পদ্মাবতীর মৃত্যু এবং জীবন ও জগতের
এই নশ্বরতার কথা থাকলেও তত্ত্বরস অপেক্ষা জীবনরসই একাব্যের মুল কথা। যে অমাত্যসভার
পরিবেশে কবি এ কাব্য অনুবাদ করেছেন, সেখানে তত্ত্বরস অপেক্ষা রোমান্সরসই বেশি উপযোগী।
এই প্রণয়কথাই যে কবির লেখনীকে সরস করেছিল তার স্বীকারোক্তি আছে কবির আত্মবিবরণে-
“ রসনা সরস
হৈ্ল প্রেমের বচনে।।
প্রেম পুথি
পদ্মাবতী রচিতে আশা এ।“ ( আত্মপরিচয়)
বাঙালি কবি মাত্রই রোমাণ্টিক। তাই
কবিরা তাঁদের কাব্যের নায়িকাকে নিজের মনের মতো গড়ে তোলেন, সৌন্দর্যে মণ্ডিত করেন।
সে হোকনা সিংহলের কন্যা। কিন্তু সেই যখন আলাওলের কবি-হৃদয়ে ধরা দিয়েছেন তখন তো কবি
তাকে বাঙালি নারীরূপেই সাজাবেন। আলাওল তাঁর এই মহাকাব্যজনিত কাব্যে প্রায় অধিকাংশ
খণ্ডে কবি পদ্মাবতীর রূপের বর্ণনা দিয়েছেন। যেমন, ‘পদ্মাবতী জন্ম বর্ণন খণ্ড’ থেকে
কিছু তুলে ধরছি-
“ চন্দনের
বৃক্ষ তনু পৃষ্ঠে নাগ বেণী।
শেষে আইল
রক্ষক ললাটে চন্দ্র গুণি।।
কামধনু
জিনিল ঈষৎ ভুরুভঙ্গে।
কটাক্ষে
হরএ প্রাণ নয়ান কুরুঙ্গে।“
‘রাজা শুক সংবাদ খণ্ড’ তে শুকের মুখে
“ শুনিয়া কন্যার রূপ নৃপ উল্লসিত/ প্রেমভাবে শরীর হইল পুলকিত”।
আলাওল আরাকান রাজসভায় সভাসদরূপে
প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন মাগন ঠাকুরের জন্য। তাই কবি মাগন ঠাকুরকে বাদ দিয়ে কাব্যরচনা
করতে পারেননি। সমগ্র কাব্যজুড়েই রয়েছে মাগন প্রশস্তি। প্রথমে পাই, স্তুতিখণ্ডে
‘মাগন প্রশস্তি’ অধ্যায় জুড়ে বিস্তারিতভাবে
মাগনের রূপ, গুণ, কীর্তির পরিচয়, অন্যদিকে কাব্যের অন্যান্য অধ্যায়গুলিতেও
রয়েছে মাগনের প্রশস্তি। মাগন নামের ব্যুৎপত্তি সন্ধান করতে গিয়ে আলাওল
পিঙ্গলাচার্জের ‘ছন্দোশাস্ত্র’ এর পরিচয় দিয়েছেন। বলেছেন-
“ কাব্য শাস্ত্র ছন্দমূল পুস্তক
পিঙ্গল/ পিঙ্গলের মধ্যে অষ্ট মহাগণ মূল/ তাহাতে ম-গণ
আদ্যে বুঝ কবিকুল/ নিধিস্থির
কল্পপ্রাপ্তি মগন ভিতর।“
“পিঙ্গলের ছন্দশাস্ত্র অনুযায়ি অষ্ট
মহাগণ হল যথা, ম-গণ, য-গণ, র-গণ, জ-গণ, ভ-গণ, ন-গণ, স-গণ। ম-গণকে সম্পদের অধিষ্ঠান
ক্ষেত্র বলা হয়। “৪ ‘মান্যের মা-কার আর গুরুর গ-কার’ মাগন সম্পদের সেই অধিষ্ঠান
ক্ষেত্রে অবস্থান করে সকলের মঙ্গল বিধান করেন। প্রশস্তির শুরুতেই কবি লিখেছেন-
“ যখনে আছিল
বৃদ্ধ নৃপ অধিকারী
যশস্বিনী নারী
ছিল মুখ্য পাটেশ্বরী।।
পরম সুন্দরী
কন্যা অতি সুচরিতা।...” ( মাগন প্রশস্তি )
প্রশস্তি থেকে রাজপরিবারের ইতিহাস
পাওয়া যাচ্ছে যে, বৃ্দধ নৃপ এখানে নরপদিগ্যি, তাঁর একমাত্র কন্যা পরম সুন্দরী। এরূপ কন্যার রক্ষণাবেক্ষণ
দায়িত্বের জন্য রাজা ভাবতে থাকেন কার হাতে সমর্পণ করবেন? তখন “ এক মহাপুরুষ আছিল
সেই দেশে / মহাসত্য মোসলমান সিদ্দিকির বংশে।“ সেই মহাসত্য মোসলমান মাগন ঠাকুরের
হাতে ন্যস্ত করেন। মাগন ঠাকুরের উল্লেখ কোনো ইতিহাসে পাওয়া যায়না। আলাওলের কাব্য
থেকেই জান্তে পারি, সিদ্দিকি বংশোদ্ভূত এই মুসলমান অভিজাত পুরুষটি আরাকান রাজবংশের
সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। রাজকন্যার রক্ষণাবেক্ষণার জন্য পেলেন সমাদর, পরে রাজকন্যা
পাটরাণী হলে তিনি রাজ্যের অমাত্য পদ লাভ করেন। মাগন ঠাকুর বহু ভাষাবিদ ছিলেন তার
কথা কবি বলেছেন-
“ আরবী ফারসী আর
মগী হিন্দুআনী।
নানাগুণে পারগ
সঙ্কেত জ্ঞাতা গুণী।।
কাব্য
অলঙ্কার জ্ঞাত হস্তক নাটিকা।
শিল্পগুণ
মহৌষধি মন্ত্রবিধি শিক্ষা।।“ ( মাগন প্রশস্তি )
বাংলা ভাষার পাশাপাশি আরবি, ফারসি,
মগি, অবধি হিন্দি ভাষাও জানতেন। তাছারাও নাট্যশাস্ত্র, কাব্যশাস্ত্র, অলঙ্কার
জ্ঞানেও বিদগ্ধ ছিলেন।
প্রাচীন ও মধ্যযুগে খবর পৌঁছে দেবার জন্য
একমাত্র উপায় ছিল দূতনির্ভরতা। রাজা বাদশাহরা একে অন্যের রাজ্যে বিশেষ দূত
পাঠাতেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই কঠিন দায়িত্ব পালন করতেন তারা। আরও একটি উপায় ছিল
সে সময়। ‘মেঘদূত’ এর মেঘের মতো মানুষ নয় এমন দূতের সন্ধান মেলে সাহিত্যে। বিশেষ
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পায়রা দূতিয়ালির কাজ করতো; আর ছিল রহস্যময় শুক পাখি। মানুষের মতো
কথা বলতে জানত সে। আলাওলের কাব্যে শুক পাখির ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারন কবি
শুকপাখির মাধ্যমেই পদ্মাবতী ও রত্নসেনের মিলন ঘটিয়েছেন। এছাড়াও পদ্মাবতীর কাছে
শুকপাখি কতখানি ইম্পরটেন্ট ছিল, তা দুটো ছত্রেই বুঝতে পারি-
“ তুমি মোর
প্রাণ শুক প্রাণের বেথিত।
তোমার অধিক
মোর কেবা আছে মিত।“( পদ্মাবতী শুক মিলন খণ্ড )
শুক ছাড়া একাব্যে ককনুছ নামে এক
পাখির কথাও পাই। কবি এ পাখির যেরূপ বর্ণনা দিয়েছেন তাতে চিল বা গড়ুর জাতীয় পাখির
কথাই মনে হয়। -“ দীর্ঘ পুচ্ছ আঁখিযুগ মাণিক্যের তুল/ হীরা জিনি চক্ষু তার সব
রন্ধ্রময়”
‘চৌগান খণ্ড’ তে অশ্বক্রীড়া প্রদর্শন
ও পোলোখেলার প্রতিযোগিতায় রত্নসেনের জয়লাভের কথা, অন্তরাল থেকে সখীদের নিয়ে সেই
খেলা দেখছে পদ্মাবতী। এ বিবরণ থেকে মনে হয় আরাকান রাজসভায় আসার আগে অশ্বারোহী
সৈনিক রূপে আলাওলের ব্যক্তিগত জীবন অভিজ্ঞতা ও এ ব্যাপারে কবির বিশেষ দক্ষতা ছিল।
আরাকান রাজসভায় বসে “পদ্মাবতী’ কাব্য
রচনা করলেও ‘রত্নসেন-পদ্মাবতী বিবাহ খণ্ড’ তে বিবাহের যে চিত্র এঁকেছেন সেখানে
কোনোরকম রাজকীয় জাঁকজমক নেই, আছে হিন্দু বিবাহের বিচিত্র আচার আচরনের পুঙখানুপুঙ্খ
বিবরণ-
“ ষোড়শ মাতৃকা
পূজা বসুধারা দান।
নান্দীমুখ
শ্রাদ্ধ সাঙ্গ করিল রাজন।।“
বরের বিবাহ যাত্রার সময় – “সুন্দরী
সধবা নারী/ মঙ্গল বিধান করি/ সতত করয় উলু উলু”।
গাঁটছড়ার কথাও আছে “ প্রেমগাঁঠি
বান্ধিলেক আঞ্চলে আঞ্চলে”।
পাল্কির কথাও আছে-“ সখী সবে ধরি
তোলে/ রত্নময় চতুর্দোলে/ বরবালা কৈ্ল আরোহন”।
এছাড়াও বেদপাঠ, মালাবদল, সপ্তপদী
ইত্যাদি বাঙালি বিবাহ চিত্র রয়েছে। শুধুমাত্র কবি ভোজনরসিক বাঙালির ভোজের খাদ্যতালিকার
দিকটা এড়িয়ে গেছেন।
বিবাহ ছাড়াও সমসাময়িক বাঙালি সমাজ ও
সংস্কৃতির অনেক ছবি দেখতে পাই। নদিকেন্দ্রিক বাংলাদেশে তৎকালীন যাতায়াতের একমাত্র
অবলম্বন ছিল নৌকার। কবি তাই নৌকার বিচিত্র তালিকা দিয়েছেন- “ সলুপা নানান
ভাঁতি/মাছুয়া গরাপ পাঁতি/জালিয়া ভাউরি নানা রঙ্গ”( রোসাঙ্গ বর্ণনা)। নৌকার সূত্র
ধরেই সেইসময় আরাকান রাজ্যে বানিজ্যের কথাও বলেছেন। বানিজ্যের জন্য বহু জাতির যে
সমাগম হত তা ‘রোসাঙ্গ বর্ণনা’ তে উল্লেখ রয়েছে। যেমন- “ আরবী মীসরী শামী/তুরকী
হাবশী রূমী/খোরাসানী উজবেগী সকল/ লাহুরী মূলতানী হিন্দী/ কাশ্মীরী দক্ষিণী
সিন্ধী/কামরূপী আর বঙ্গ্দেশী...।“ এরকম বহু জাতির আগমন ঘটত। সিংহলের হিন্দু
রাজপ্রাসাদের বর্ণনা, হাটের বিবরণ, ফল-ফুল, পাখ-পাখালির যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে
তরুপল্লবিত ছায়াবৃত বাংলা পল্লীর চিত্রই ফুটে উঠেছে। যেমন- ফুলের বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন, “লবঙ্গ
গোলাপ চম্পা শতবর্গ যুথি/কেতকি কেশর বৈ্জয়ন্তী বেলফুল...”। আর পাখির বিবরণে
লিখেছেন-“সারিশুক শবদে কোকিল গাএ গীত/ এক তুষি কপোতে বোলএ সুললিত”। নারীদের পোষাক
পরিচ্ছদ, সুত্রবৃত্তি, পঞ্জিকা, ব্যাকরণ, অভিধান, বেদ ইত্যাদির উল্লেখ থেকে সমাজে
প্রচলিত বিদ্যাচর্চার পরিচয় পাওয়া যায়। আলাওল ব্যক্তিজীবনে বেশ ভালো সঙ্গীতজ্ঞ
ছিলেন তা তাঁর উল্লেখিত গানের অংশগুলি এবং প্রত্যেক খণ্ডের উপরে রাগ ও তালের কথা
উল্লেখেই বোঝা যায়।
ষোড়শ শতকে রানি পদ্মাবতীকে নিয়ে লেখা
আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ কাব্য আজকের দিনেও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। যাকে নিয়ে এত কাহিনি
সেই পদ্মাবতীর নাম প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় কবি জায়সীর ‘পদমাবত’ কাব্যে। এর আগে
রচিত ঐতিহাসিকদের ইতিহাসে কেবল আলাউদ্দিনের চিতোর রাজ্য জয়ের কাহিনির কথা বলা আছে।
সেইসময় যে সকল ঐতিহাসিকদের নাম পাওয়া যায় তাঁদের মধ্যে ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে
আলাউদ্দিনের চিতোর আক্রমণকালে তাঁর সঙ্গী আমির খস্রুর ‘ খাজা ইন উল ফতাহ’ গ্রন্থেও
পদ্মাবতীর নাম নেই। তাই পদ্মাবতী জায়সীর কবিকল্পের নারী হলে বলতে পারি আলাওল সেই
পদ্মাবতীকেই ‘’আশা দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে” নিজের মনের মানসী করে গড়ে তুলেছেন। আর তাই
শেষে একথা বলতে বাধা নেই-“ পৃথিবীতে ইতিহাস-কাহিনী যেমন অনেক্ষেত্রে কাব্যের জন্ম
দিয়েছে তেমনি কাব্য-কাহিনীও কখনও কখনও পরবর্তীকালে ইতিহাস হয়ে দেখা দিয়েছে।”৫ তার
অসামান্য নিদর্শন হল আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ তথা পদ্মিনী-উপাখ্যান।
তথ্যপঞ্জি
১। সত্যজিৎ রায়,’সিনেমার কথা’, “
চলচ্চিত্র রচনাঃ আঙ্গিক, ভাষা ও ভঙ্গি”, আনন্দ পাবলিশার্স।
২। দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সম্পাদক
‘পদ্মাবতী’, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ।
৪। দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সম্পাদক, ‘পদ্মাবতী’, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ।
৫। ত.দে.ব .
পদ্মাবতী মুল কাব্যের পিডিএফ পাওয়া যাবে কি? জানালে উপকৃত হবো। ধন্যবাদ
ReplyDelete