নাগরিকত্ব - রাজীব কুমারঘোষ
এই শহরের আমি একজন নাগরিক। কোনো সাধারণ নাগরিক আমি
নই। আমি একজন সন্মানিত নাগরিক।
সামনেই যে চারমাথার মোড় তার মাঝে শ্বেত পাথরের
স্তম্ভের ওপর যে মাথাটা আছে ওটা আমার। মোড় থেকে ডান দিকে বেঁকলে যে মনোরম পার্কটা
পড়ে তার গেট দিয়ে ঢুকলেই দেখতে পাবেন সবুজ ঘাসের গালচের ওপর আমার পা দুটো রেলিং
দিয়ে গোল করে ঘেরা। রেলিং এর বাইরে বাচ্চারা রোজ বিকেলে ভিড় করে পা দুটোকে দেখে।
মাঝে মাঝে আমি যাই। ওরা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। পার্ক ছাড়িয়ে আরেকটু
এগোলে যে বড় আটতলা অফিসটা পাবেন তার অজস্র পোস্টার-ফেস্টুনে ঢাকা গেটের ওপরে দু'টো
হাত ঝুলিয়ে রাখা আছে। ওদুটো আমার। অফিস ছাড়িয়ে বাঁ হাতের রাস্তাটা ধরলে দেখবেন
শহরের বড় প্রেক্ষাগৃহ। প্রেক্ষাগৃহের ছাতের ওপর যে দু'টো ডানা হাওয়ায় ভাসছে সে
দুটো ডানা একদিন আমার ছিল। হাত কাটা, পা কাটা, মাথা বিহীন যে ধড়টা এখন দেখছেন -
সেটা আমি। এই শহরের এক সম্মানিত নাগরিক।
আমি এইরকম ছিলাম না। আমি এখানেও ছিলাম না। আমি
ছিলাম বনে। বনে বড় ভয়। বনে হিংস্র পশুর বাস। বনে ভয়াল ঝড়ের তান্ডব। বনে সহসা
দাবানলের দহন কার্য। খাদ্য-খাদকের সম্পর্কে বাঁধা বন্যজীবন। তাই বন আমার ভালো
লাগেনি। বনের বাসিন্দা হয়ে আমার সুখ ছিল না, শান্তি ছিল না। একদিন হাওয়া এসে আমার
কানে কানে বলে গেল, 'তুমি বন থেকে বেরোও, এক মরুভূমি পাবে। মরুভূমি পার করলেই
সুন্দর নগর দেখতে পাবে। সেখানে হিংস্রতা নেই, ভয়াল তান্ডব নেই। নেই কোনো দহন
কার্য। সেখানে শুধু শান্তি, আনন্দ।'
হাওয়ার কথা শুনে আমি বেরিয়ে পড়লাম সেই সে দেশের
সন্ধানে। যখন আমি মরুভূমির ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলাম, তখন হঠাৎ কারা এসে আমার ডানা
দুটোকে কেটে দিল। আমি আগুনের মত গরম বালিতে ছিটকে পড়লাম। ওরা বলে গেল,'সবাই ওপরে
থাকতে পারে না।'
ডানা হারিয়ে প্রচন্ড যন্ত্রণা সহ্য করে আমি হাঁটতে
থাকলাম সেই রোদঝরা মরুভূমিতে। মরুভূমি শেষ হল একদিন। সামনে দেখলাম এক নগর। শ্রান্ত
ক্লান্ত আমি নগরদ্বারে আসতেই ওরা আবার এসে আমার পা দুটোকেও কেটে নিল। ঠান্ডা স্বরে
বলে গেল,' এখানে বুকে হেঁটে চলা নিরাপদ।'
ডানা ও পা হারিয়ে আমি বুক ঘষটে ঘষটে নগরে প্রবেশ
করলাম। সেখানকার বাসিন্দাদের বললাম, এই নগরের রাজা কোথায়? আমি তার কাছে যাব, আমার
নালিশ আছে।' তারা বলল, 'এই নগরে কোন রাজা নেই। আমরা কয়েকজনকে নগর দেখাশোনার জন্য
নির্বাচন করেছি, তুমি তাদের কাছে যাও, লিখিত অভিযোগ পেশ কর।'
যখন আমি বসে অভিযোগ লিখছিলাম দীর্ঘ ছায়া ফেলে ওরা
আসল। এবার ওরা আমার হাত দুটো কেটে নিল। ক্রুদ্ধস্বরে বলল,'আমাদের হাতেই এখানে সব
হয় - তোমার হাতের ব্যবহার নিষ্প্রয়োজন।'
রক্তাক্ত দেহে কোনরকমে আমি নগরপালকদের কাছে গেলাম।
আমার কেটে নেওয়া ডানা, পা আর হাতের জন্য অভিযোগ করলাম। তারা তাদের বিচারব্যবস্থার
প্রতি নির্ভরতার জন্য আমার প্রশংসা করল এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হবার জন্য আমাকে
বীর বলে ঘোষণা করল। উৎসব অনুষ্ঠানের মাঝে জনবহুল রাস্তার মোড়ে জাতীয় আদর্শের
প্রতীক রূপে আমার মাথাটা কেটে শ্বেত পাথরের স্তম্ভের ওপর স্থাপন করা হল।
নাগরিকবৃন্দরা ফুল মালায় মাথাটিকে ঢেকে দিল। দিনটিকে জাতীয় আস্থাদিবস হিসাবে প্রতি
বছর পালন করার শপথ নেওয়া হল। ওরা ফিসফিসিয়ে আমাকে বলে গেল,'মাথা উঁচু করলে
স্ট্যাচুই হতে হয়।'
যাই হোক, আমি এখন দারুন খুশি, আমার ধড়টা শহরে
ভালোই আছে। সে এখন এক সম্মানিত নাগরিক।
No comments:
Post a Comment