চৈত্রসেল – সুব্রত দাস
আজ তিন দিন হলো ঘোষবাবুর
দোকানে নতুন একটা কুর্তি এসেছে। আসা মাত্রই এক কোণে পরে থাকা পুরোনো একটি চুড়িদারের
সাথে তার আলাপ হয়...... নতুন পরিবেশে সে যেন তার মনের দুটো কথা বলার সাথী খুঁজে
পেলো, ..... বেশ ভালোই লাগে কুর্তির ।
এই কদিনেই তাদের বন্ধুত্ব
বেশ জমে উঠেছে। ...... এর ক্রেডিটটা অবশ্য কুর্তির ....... বেশ মিশুকে সে , নয়তো এরই মধ্যে বয়সে বড়ো কুৎসিত চুরিদারটার সাথে কেউ বন্ধুত্ব পাতায় !!!!!!!!
কুর্তি ওতো সুন্দর হওয়া
সত্ত্বেও একবিন্দুও অহংকার নেই তার মধ্যে, একটুও নিজের সৌন্দর্যের বড়াই করে না বরং কত সহজেই চুড়িদারের সাথে মিশে
গেছে, তাকে দিদি বলে ডেকেছে ।
তবে এই কদিনের মধ্যেই
কুর্তি বুঝেছে চুড়িদার দিদির মুখে সারাক্ষন হাসি লেগে থাকলেও মনে কিন্তু তার অনেক
দুঃখ ,....... কারণটাও বোধ করি সে আন্দাজও
করতে পেরেছে এই কদিনে, ....
চুরিদার দিদির বিক্রির
বয়স পেরিয়ে গেছে , তবুও কেউ তাকে
পছন্দ করে কেনেনি , এক দুবার নাকি বিক্রি হতে হতেও আর
শেষপর্যন্ত হয়নি । দেখতে একটু বিশ্রী আর সেকেলে বলে কেউ ছুঁয়েও দেখে না তাকে ।
দোকানের নানা কাপড় জামা নানা কথা বলে , তাকে নিয়ে হাসি
ঠাট্টা গালমন্দও করে ।
আজ চৈত্র মাসের বারো
তারিখ ,
তারা দোকানে একটু
কানাঘুষো শুনতে পেলো ...... দোকানের মালিক আর কর্মচারীরা কি জানো বলাবলি করছে ....
তারা বলছেন কাল থেকে নাকি
চৈত্রসেল শুরু ...... আর চুড়িদারের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন যে কাল তাকে দোকানের
বাইরে দাঁড় করিয়ে দাওয়া হবে বিক্রির শেষ প্রচেষ্টায়।
....... খুব কম
দাম ধরা হয়েছে তার জন্য , যদি কম দাম দেখে কোনো মানুষের
লোলুপ দৃষ্টি পরে তার উপর , তাহলে বাড়িতে সবসময় পড়ার জন্য
কেউ হয়তো তাকে কিনলে কিনতেও পারে ,
.... কি আর করবে
সব জামাকাপড়ের তো আর আলমারির ভাগ্য জোটে না , ...... যে শুধু
বিয়ে বাড়ি যাওয়ার সময়ই তাদের আলমারি থেকে নামিয়ে পড়া হবে , তারপর
আবার কেচে ইস্ত্রি করে তুলে রাখা হবে ........ কজন আর এই ভাগ্য নিয়ে তৈরি হয়।
আর চুড়িদারও সেটা জানে , ..... সে জানে সে কুৎসিত দেখতে , তাই
বিয়েবাড়ির জামা হওয়ার আশা সে কখনই করে না । এখন শুধু কোনো ভাবে নিজেকে বিক্রি করতে
পারলেই হয় ..... অনেকদিন তো হলো সে এই দোকানে আছে , .... আর
এই জন্য তাকে দোকানের বাকি জামাকাপড়দের কাছে অলক্ষী অপয়া গালও শুনতে হয় .... তাই
সে এখন বিক্রি হলেই সবার মঙ্গল।
পরের দিন থেকেই চৈত্র সেল
শুরু ...... কুর্তি আর চুরিদারের খুব মন খারাপ ...... সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠতে না
উঠতেই কুর্তি দেখলো চুড়িদার কে দোকানের সবাই মিলে ঝাড়পছ করা শুরু করেছে .... একটু
পরেই তাকে দোকানের বাইরে দাঁড় করানো হবে ,
...... তাদের দুই
বন্ধুর আর একসাথে থাকা হবে না.. .... যাওয়ার সময় চুড়িদার এক দৃষ্টিতে কুর্তির দিকে
চেয়ে রইলো । ......
....... এরপর
বিকেল হলো, বাইরে লোকের জমজমাট , সবাই
সস্তার দামে সাধারণ খুঁতওয়ালা জামাকাপড় কেনার ধান্দায় আছে , যাতে
পিটিয়ে সারাবছর পড়তে পারে , কেউ এই সময় ভালোবেসে তাদেরকে
কেনে না , ..... শুধু দেখে আরামদায়ক কিনা আর অনেকদিন রাফ ইউস
করা যাবে কিনা ।
সারাদিন সারাবিকেল ঠায় রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকার পর অবশেষে রাতের বেলায় দুই বন্ধুর দেখা হয় ..... একটু
সুখ দুঃখের কথা বলে ক্লান্ত শরীরে রোজই চুড়িদার ঘুমিয়ে পড়ে ।
এভাবেই বেশ কয়েকদিন কেটে
গেছে .... পুরোনো কুৎসিত চুরিদারকে এই কদিনে কেউই পছন্দ করেনি। ..... এই দুঃখের
মাঝে কুর্তি কিন্তু মনে মনে একটু খুশিই হয় , ....
অন্তত দিনশেষে একবার হলেও তো তাদের দেখা হবে।
আজ চৈত্র মাসের শেষ দিন , আজ চুরিদারেরও বিক্রি হওয়ার শেষ দিন , দোকানের
মালিক স্পষ্ট বলে দিয়েছে যেগুলো শেষ অব্দি বিক্রি হবেনা সেগুলোকে হয় দোকানের এক
কোণে ফেলে রেখে দেবে আর নয়তো দোকান ঝাড়পছ করার কাজে লাগাবে ।
চুড়িদারের তাই আজ মরণ
বাচন লড়াই যে করেই হোক কারো একজনের কাছে বিক্রি হতে পারলেই হয় , সে জানে বিক্রির বয়স পেরিয়ে গেলে দোকানে থাকাটা দোকানের
মালিকের জন্য কত যন্ত্রণার , তাই মালিককে সেই অপমানের হাত
থেকে বাঁচাতে সে আজ যে কারোর কাছে বিক্রি হতে রাজি ।
চারিদিকে টানটান উত্তেজনা
, বিকেলের হইহট্টগোল আজ সবথেকে মাত্রা
ছাড়িয়েছে , আজ তো শেষ দিন চৈত্রসেলের ।
অবশেষে চুরিদারের ভাগ্য
ফিরলো ...... এতদিনের প্রতীক্ষার অবসান ঘুচল .... হাফ দামে সেই পুরোনো কুৎসিত চুরিদার বিক্রি হয়েছে .... দোকানদারও একটু নিঃশাস ছেড়ে বাঁচলো ।
..... হ্যাঙ্গার
থেকে নামিয়ে যখন চুড়িদার কে প্যাকেটে ভরতে যাবে তখন সে একটু হাসি মুখে পেছনে
দোকানের ভিতরের দিকে তাকায় ..... দেখে করুন কাঁদো কাঁদো মুখে কুর্তি তার দিকে
তাকিয়ে আছে।
চুড়িদার একটু নিজেকে শক্ত
করে নিয়ে আলতো গলায় বললো ..... ভালো থাকিস বোন .... শুভ নববর্ষ .... নতুন বছর খুব
ভালোভাবে কাটাস .... আর কখনো হয়তো দেখা হবে না আমাদের ......... চললাম রে।
.......... কুর্তি
কোনো কথা বলল না শুধু চুপচাপ তার দিকে তাকিয়ে রইলো ফ্যালফ্যাল করে .... আর সেই
সময়ই একটা হালকা হওয়ায় কুর্তির ডান হাতাটা একটু নড়ে উঠলো ......
যেন শেষ বিদায় জানালো সে।
যেন শেষ বিদায় জানালো সে।
No comments:
Post a Comment