‘চেয়ে দেখি রুমালটা তো আর রুমাল নেই,দিব্যি মোটাসোটা লাল টকটকে একটা বেড়াল গোঁফ ফুলিয়ে প্যাটপ্যাট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।’
এই লাইনটার পর আশা করি লেখকের আর কোন পরিচয়ের দরকার নেই।
ঠিক ভেবেছেন, তিনি বাংলার অন্যতম প্রিয় শিশুসাহিত্যক ‘সুকুমার রায়’।
কিন্তু ভুলটা হয়ে গেল ঠিক এখানেই। বাঙ্গালির কাছে চিরউপেক্ষিত সম্রাট শুধু শিশু-সাহিত্যিকই নয় তিনি এক গবেষক, বৈজ্ঞানিক, প্রবন্ধকার এবং দার্শনিকও বটে। আমাদের সৌভাগ্য আমরা তাকে শিশু সাহিত্যিক হিসেবেই চিনেছি, আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা তাকে শুধুই শিশু সাহিত্যিক হিসেবে চিনেছি।
কারণ, ভাষা থেকে সাহিত্য দুক্ষেত্রেই তিনি উপলক্ষের থেকে উদ্দেশ্যকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন এবং একান্ত সেই কারনেই তিনি ভয়ঙ্কর কঠিন কঠিন সব বিজ্ঞানের সুত্র প্রকাশ করছেন জলের মতো সহজরুপে।
যেমন ধরুন, ডারউইনের জীবনীতে তিনি সহজ ভাষায় উদাহরন দিয়েছেন ওস্তাদ মালীদের।তারা যেমন ভাবে গাছের সাথে গাছের কলম করায়, সেই উপায়ে তিনি চেষ্টা করে গেছেন পৃথিবীর বিবর্তনের ইতিহাস পাঠকের সামনে তুলে ধরতে। এই তুলে ধরার মধ্যে চলেছে বিস্তর পরিক্ষা-নিরিক্ষা।দিনের পর দিন রাতের পর রাত পরিশ্রমের মধ্যে দিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বিজ্ঞানের শক্তশক্ত সুত্র সাধারন মানুষের বোধগম্য করতে হলে তা হওয়া চাই কাঁচের মতো স্পষ্ট এবং আমাদের লৌকিক উদাহরনে ভরা।
তাই তিনি ন্যাচারাল সিলেকশন বা মিউটেশনের মত থিয়োরি অবলীলায় প্রকাশ করছেন‘খিচুড়ি’ কবিতায়। আবার লেটারপ্রেস মেশিনে ছাপার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন –
‘হাঁ-করাপ্রেসটার মধ্যে কাগজ বসিয়ে দিলে প্রেসটা সেই কাগজের ওপর অক্ষরের টাইপ দিয়ে এক কামড়বসিয়ে দেয়…’
খেয়াল করুন যন্ত্রবিজ্ঞানের কঠিন শব্দচয়নের পথ না বেছে তিনি ব্যাবহার করেছেন দুটি মাত্র উদাহরন-‘হাঁ-করা প্রেসটার’ এবং ‘এক কামড় বসিয়ে দেয়’। আর যন্ত্র কেমন দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে পাঠকের মনে।
বিজ্ঞান এবং সাহিত্যকে এইভাবেই তিনি এক গণ্ডির মধ্যে বেঁধেছেন অবলীলায়।কিন্তু কাজটা কি সত্যি সহজ?
একদমই নয়। এই অলৌকিক জগতের সৃষ্টির পেছনে ছিল তার জ্ঞান, নিষ্ঠা, পরিবারএবং অবশ্যই হাসির ছলে পৃথিবীকে সাহিত্যে ব্যাক্ত করবার ক্ষমতা।
ছোট থেকেই সুকুমারের জীবনের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিল বিজ্ঞান। তার দিদা কাদম্বিনী গাঙ্গুলি পেশায় ডাক্তার। পিসেমশাই হেমেন্দ্রমোহন বসু (যিনি আবার জগদীশ চন্দ্রবসুর ভাগ্নে) ইঞ্জিনিয়ার। বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী আজীবন পরীক্ষা নিরিক্ষা করেগেছেন হাফটোন ছবি এবং প্রেস নিয়ে(U.ROY &SONS).
সুকুমার রায়ের নিজের শিক্ষাজীবনও আকর্ষণীয়। দুটি বিষয় অনার্স নিয়ে বিএসসি পাস করার পর স্কলারশিপ পেয়ে লন্ডন ও ম্যানচেস্টারে উচ্চশিক্ষা লাভ এবং মুদ্রন শিল্পে গবেষণা। সুতরাং বলাই বাহুল্যবিজ্ঞান এবং কারিগরিবিদ্যায় তার দখল ছিল অন্যমাত্রায়। তাই খেলার ছলে ষষ্ঠীচরণ যখন তখন হাতি লুফতেন। লৌকিক এবং অলৌকিক জগতের ওপর অতিমাত্রায় দখল ছিল বলেই তিনি সৃষ্টিছাড়াদের অবলীলায় বাধ্য করেছেন উল্টোনিয়মের বশ্যতা স্বীকার করতে। কারণ তার নিজেরকথাতেই বলা যায় –
‘অলৌকিক রসের অবতারনা করিতে হইলে লৌকিকের জ্ঞানটা একটুবেশিমাত্রায় আবশ্যক।’ তার সাবলীল ভাষা এবং মৌলিক ভঙ্গি সুকুমার সাহিত্যকে নিয়েগেছে বিশ্বমানের পর্যায়ে।
বাংলা সাহিত্যে বিজ্ঞান এবং ফিকশানের অভাব আমরা চিরকাল দেখে এসেছি। তিনি এবং উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রথম এই দুইপাড়ের সেতুবন্ধন করেন।
যেমন গডার্ডের প্রথম রকেট ছোঁড়ার সাফল্যের খবর পেয়ে তিনি ১৩২৭ অর্থাৎ ১৯২০ এর আষাঢ় সংখ্যায় একটি নিবন্ধে লিখেছেন –‘হয়তো তোমরা বুড়ো হওয়ার আগেই শুনতে পাবে যে তাদের দেশের প্রথম যাত্রীরা চাঁদে যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছেন।’
সত্যি এর ৪৯ বছর পর ১৯৬৯ এর ২০শে জুলাই চাঁদের মাটিতে পা রাখেন নীল আমস্ট্রং।
জুলে ভার্ন বা রাউলিং মুখী বেশিরভাগ বাঙালি কোনোদিনই তার ভবিষ্যতদ্রষ্টা নিয়ে অবগত থাকেনি। যুক্তিবাদী এবং বিজ্ঞানসন্মত দুটি ডানার ওপর ভর করে তিনি সাহিত্যকে নিয়ে গেছেন অন্য এক কল্পনার রাজ্যে।
স্ট্যাটিস্টিক নিয়েও তার জ্ঞান ছিল অগাধ। সংখ্যার বাহুল্যে তিনি অযথা পাঠকে জর্জরিত করতে চাননি। তারবদলে তুলে ধরেছেন সহজ কিছু উদাহরন। যারফলে মাপ নিয়ে একটি স্থির চিত্র নির্মিত হয়েছে সব বয়সী মানুষের মনে।
একটি ছোট উদাহরন দিয়ে ব্যাপারটাসহজভাবে দেখা যাক-
তৃতীয়বর্ষ পূর্তিতে ‘সন্দেশের হিসাব’-এ তিনি লিখেছেন- ‘বিজ্ঞাপন বাদে সন্দেশের প্রতি সংখ্যায় ৩২ পাতা থাকতো তাই তিন বছরে সবসুদ্ধ পঁয়ত্রিশ লক্ষ পৃষ্ঠা ছাপা হয়েছিল। ছাপা কাগজগুলো একসঙ্গে ওজন করলে তবে প্রায় ২১৫ মন হত, অর্থাৎ তোমাদের প্রায় দু’শ জনের সমান। সন্দেশগুলি যদি একটার ওপর একটা উঁচু করে সাজানো যেত তবে প্রায় ৭০০ ফুট উঁচু একটা স্তম্ভ হত- কলকাতার মনুমেন্টের চারগুণ। যদি উপরে উপরে না রেখে লম্বালম্বি সার বেঁধে বসাতে তবে সে সার কলকাতা থেকে ব্যারাকপুর অর্থাৎ প্রায় ১৭ মাইল লম্বা হত। যদি প্রত্যেকটি পাতা আলগা করে ওই রকম পরপর বসানো যেত, তা দিয়ে এখান থেকে প্রায় নেপাল বা বার্মা পর্যন্ত লম্বা লাইন পাতা যেত।’
এইরকম ভাবেই তিনি উপলক্ষের চেয়ে উদ্দেশ্যকে প্রণীত করতে চেয়েছেন সহজভাবে। আইন্সটাইনের আপেক্ষিকতা সুত্র থেকে নিউটন সব ক্ষেত্রই তিনি মিলিয়েছেন সাহিত্যের সাথে, অত্যান্ত সহজপাঠ্য হিসেবে। তার দর্শন ক্রমাগত খুঁজে গেছে ভবিষ্যতের পৃথিবী। হ য ব র ল-য়ে কাক্কেস্বর কুচকুচে যখন বলে – ‘তোমাদের দেশে সময়ের দাম নেই বুঝি? এখানে কদিন থাকতে তাহলে বুঝতে। আমাদের বাজারে সময় এখন ভয়ানক মাগ্যি, এতটুকু বাজে খরচ করবার জো নেই’।এই কথার মর্ম আজ এই ইঁদুরদৌড়ের প্রতিযোগিতায় আমরা প্রতিদিন প্রতিক্ষনে উপলব্ধি করি।শুধুই কি লৌকিক জগতের দর্শন! ভাষা নিয়ে তার পরীক্ষা নিরিক্ষা চলেছে আমরন। বিভিন্ন ইংলিশ শব্দকে যথাযথ বঙ্গানুবাদে তার জুড়ি মেলা ভার।
যেমন সাবমেরিনকে ‘ডুবুরি জাহাজ’,এক্স-রে কে ‘কঙ্কালছায়া’, টিউব রেলকে ‘সুড়ঙ্গ রেল’, রেডিও ট্রান্সমিশনকে ‘আকাশবাণী’এমন অজস্র উদাহরন আছে তার ঝুলিতে।
প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘মন্ডা ক্লাব’ (Monday Club)। কিন্তু নাম শুনে আমাদের মনে যতই হাসি ঠাট্টা খিল্লির ছবি আসুক না কেন আসলে এই ক্লাবের বিষয়বস্তু ছিল ভীষণ প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ভরা।
যেমন Whitman ও রবীন্দ্রনাথ, বৈজ্ঞানিক ও সাহিত্যিক ইতিহাস, কালিদাসের Geography, Rammohan Roy as Jurist, ব্রাহ্মগন হিন্দু কি না ইত্যাদি।
Nonsense Club এর সভ্যরাও ছিলেন তৎকালীন বাংলার এক একজন দিকগজ।
এই সব বিষয়ে সুকুমারের অগাধ জ্ঞানই তাকে সাহায্য করেছিল ভীষণ সহজ ভাষায় পাঠকের সামনে সমস্তটা উত্থাপন করতে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই ওনাকে নিয়েবলেছেন –
‘তাঁর স্বভাবের মধ্যে বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির গাম্ভীর্য ছিল সেই জন্যেই তিনিতাঁর বৈপরীত্যে এমন খেলাচ্ছলে দেখাতে পেরেছিলেন।’
আজীবন হাসি মজায় ভরিয়ে রেখেছিলেন তাঁর আশপাশ। কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে ১০ই সেপ্টেম্বর তিনি দেহত্যাগ করেন। শেষমুহূর্তের কিছু স্মৃতি জানা যায় মাধুরিলতা রায় মহালানবিশ এর স্মৃতিগ্রন্থ থেকে – ‘ভোরেরদিকে তাঁর জ্ঞান ছিলনা। কখনও কখনও কি যেন বলিতে চেষ্টা করিতেছিলেন, কিন্তু পরিস্কার কিছু বোঝা যাইতেছিল না। হঠাৎ একবার শুনলাম – ‘এইবার বেরিয়ে পড়ি’। ইহাই তাঁহার শেষ কথা।’
এই ভাবেই বাংলার চির সুকুমার নক্ষত্র বেরিয়ে পড়েছিলেন কল্পনার জগতে। আসলে গুরুগম্ভীর সব বিষয়ের মুল জেনে ফেললেই যে তার সহজ সত্যতা মানুষের কাছে জলের মতো পরিস্কার হয়ে যায়, তা তিনি বুঝেছিলেন খুব কম বয়েসেই। তাই আবোল তাবোল, হ য ব র ল, পাগলা দাশু, অবাক জলপান ইত্যাদি আরও বহুবহু সৃষ্টি করেছিলেন অবলীলায়। তাঁর মধ্যে বিজ্ঞান এবং দর্শনের প্রবেশ ঘটিয়েছেন সুচারুভাবে।
আমাদের সৌভাগ্য আমরা তাকে শিশু সাহিত্যিক হিসেবেই চিনেছি, আমাদের দুর্ভাগ্যআমরা তাকে শুধুই শিশু সাহিত্যিক হিসেবে চিনেছি।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার-
১) সিদ্বার্থ ঘোষের 'প্রবন্ধ সংগ্রহ'।
২) সুশোভন ঘোষের 'যা মনে পড়ে'।
৩) প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রজীবনী।
৪) এক্ষণ পত্রিকার 'বিলেতের চিঠি ও ওপর একটি'।
৫) সুকুমার রচনাবলী।
No comments:
Post a Comment