- ঈপ্সিতা মিত্র
এখন সকাল ন-টা সাঁইত্রিশ | দিনটা সোমবার | একে অফিস টাইম , তার ওপর মাসের এক তারিখ , ব্যান্ডেল লোকালে এই সময়টা প্রচন্ড ভিড় | লোক প্রায় ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে | পা রাখারও জায়গা নেই বিশেষ | তবে কি আর করা যাবে ! পেটের টানে ছোটাই তো কাজ | সে যতই ঘুম চোখ হোক , রবিবারের আলিস্যি শরীরে লেগে থাকুক , চাকরি তো সে কথা শুনবে না ! তাই সপ্তাহের প্রথম দিন ভোর ভোর উঠে স্রান সেরে কিছু একটা নাকে মুখে গুঁজে ঢুলতে ঢুলতে ছুটে চলার নামই জীবন ! এর মধ্যে বছর পঞ্চাশের সুবিনয়বাবু , যে ওই গেটের একটু আগে হাতল ঝুলে ঝুলছে ; সেই লোকটার আবার বাড়িতে খুব ঝামেলা | মেয়ের ডিভোর্স কেস চলছে প্রায় এক বছর ধরে | জীবনটা উকিল , কোর্ট এইসবের পিছনে টাকা ঢালতে ঢালতেই শেষ হয়ে গেলো ওনার | কি কুক্ষনে যে মেয়েকে ওই শয়তানটার সাথে সম্বন্ধ ঠিক করে বিয়ে দিয়েছিলো , কে জানে ! বাপরে বাপ্ | বাবাজীবন একেবারে ঘোল খাইয়ে রেখে দিলো ওদের | বিয়ের সময় তো এমন নেকা নেকা শান্ত চেহারা , যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না | ভোলাভালা ইঞ্জিনিয়ার | সে যে বাজার থেকে মাছ দরদাম করে কিনে রান্না করে লোকজনকেও খাইয়ে দিতে পারে , এটা সুবিনয়বাবু প্রথমে বিশেষ টের পায়নি | টের পেলো সেইদিন যেইদিন মেয়ে আর জামাইকে ফোনে পেলো না | মানে জামাই এর না কি লন্ডনে পোস্টিং হয়েছে কোম্পানি থেকে , এই বলে মেয়েকে ওনার কাছে রেখে দু মাস তার আর কোনো পাত্তা নেই | তারপর অফিস থেকে খোঁজ নিয়ে জানা যায় সেই বাবাজীবন চাকরি ছেড়ে দু মাস আগেই চম্পট | তারপর অনেক খোঁজ খবর থানা পুলিশ করে অবশেষে তার হদিশ মেলে | সে এখন ব্যাঙ্গালোর নিবাসী তার গার্ল ফ্রেন্ডের সঙ্গে | আর এদিকে লন্ডন যাওয়ার নাম করে সুবিনয়বাবু মানে শ্বশুরের কাছ থেকেও প্রায় সাত লাখ টাকা খোসিয়েছিলো এই বলে যে ওনার মেয়ের জন্য না কি লন্ডনে থাকার ব্যবস্থা করে আসবে , মানে দুজনের থাকার মতন ছোট্ট একটা এপার্টমেন্ট ভাড়া নেবে , অফিসের এপার্টমেন্টে না কি বৌ এলাও না | এইসব গল্প সাজিয়ে সেই কয়েক লাখ টাকাও এখন বাবাজীবনের পকেটে | সেই নিয়েই কেস চলছে দিনের পর দিন , মাসের পর মাস | উকিলের পেছনে টাকার শ্রাদ্ধ থেকে কোর্টে নানা রকম টেরা বেঁকা প্রশ্নের মধ্যে পরে হ্যারাসমেন্ট , এইসবের মাঝে যখন মেয়েটার বিদ্ধস্ত মুখটা দিনের শেষে চোখে দেখতে হয় , তখন মনে হয় একটা সপাটে চড় মারি ওই জামাইয়ের মুখে | কিন্তু মনে মনে হাতটা উঠেও থেমে যায় | কোর্টে প্রত্যেক মাসেই ওই বাঁদরটার , থুড়ি মানে বাবাজীবনের মুখোমুখি হলেও , সে তো ধরা ছোঁয়ার বাইরেই | আর গায়ে হাত তোলাও আবার একটা ক্রিমিনাল অফেন্স | যদি কোনো ধারা টারা লাগিয়ে আবার একটা উল্টো কেস দিয়ে দেয় ! ভেবেই মনে মনে আবার হাতটা নেমে যায় ওনার | আর না চাইতেও ওই শান্ত নিরীহ চেহারার মুখোশটা পরে জীবনটা বয়ে বেড়ান সুবিনয়বাবু |
তারপর ওই ট্রেনের চ্যানেলে কোনোমতে ঢুকে নিজেকে সামলে , নিজের ওই
ভারী অফিস ব্যাগটাকে সামলে যেই মোটা মতন ভদ্রলোককে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘামছে , উনি হলেন
কমল হালদার | বাড়ি মানকুণ্ডু | তবে ওনার জীবনের সমস্যা আবার শ্বশুর | মানে সুবিনয়বাবুর
কেসের ঠিক উল্টো | আসলে কম বয়সে নির্বুদ্ধিতায় , আর রিয়্যাল জীবনে হিরো সাজার একটা
অদ্ভুত নেশায় কমলার সাথে প্রেমটা করে ফেলেছিলেন উনি | একেবারে যাকে বলে হোঁচট খেয়ে
প্রেমে পরে গেছিলেন | কিন্তু তখন জানতেন না , কমলার বাবা হচ্ছে একজন 'সুপারি কিলার'
| দাগি মাস্তান এলাকার | এলাকা মানে বাঁকুড়ার দিকের | ওই জন্যই কিছু না জেনে প্রেমটা
করেছিল কমল | মানে মানকুণ্ডুতে কমলা নিজের মাসির বাড়ি ঘুরতে এসেছিলো পুজোতে | তারপর
দুর্গাপুজোর মণ্ডপে চোখাচুখি হতেই কমল কে মন মে লাড্ডু ফুটা | তবে সেই মাহেন্দ্রক্ষণে
বোঝেননি উনি যে এটা আসলে লাড্ডু না , জীবনে এটম্ব বম্ব ফোটার ইনভিটেশন এসেছিলো | না
, শ্বশুর প্রেম করে বিয়ে করতে আপত্তি করেনি কোনো | তবে বিয়ের রাতে একটা আলতো সাবধানবাণী
দিয়ে রেখেছিলো , " যদি কমলার চোখে কখনো জল আসে , তাহলে ওর জীবনে বন্যা বয়ে যাবে
|" .. ব্যাস , আর বাকিটা বোঝাতে হয়নি | কমল ভালো স্টুডেন্ট | তারপর থেকেই সকালের
চা থেকে রাতের ডিনার , মা কমলার অর্ডার মতন কমল রুটিং মেনে টাইমে টাইমে সব কাজ করে
দেয় | কাল তো আবার রবিবার ছিল | মটন বিরিয়ানি , চিকেন চাপ , আমের চাটনি , এইসব মেনু
না হলে কমলার দিনটা ঠিক জমে না ! তা ও কমল একবার মিনমিন করে বিয়ের প্রথম দিকে বলেছিলো
, " কোনো কাজের লোক রাখলে হয় না ? যে একটু রান্নার দিকটা দেখে নেবে |"
...... তখন কমলা আব্দারের সুরে বলেছিলো , -------- " আমার তো শুধু তোমার হাতের
রান্না খেতেই ভালো লাগে , সোনা |" ....... তা ও কমল চেষ্টা করেছিল , আলতো স্বরে
বলেছিলো , " আমি চাকরি সামলে রোজ রোজ রান্না ! বুঝতেই তো পারছো |"
...... কমলা তখন একটু আলতো হেসে উত্তর দিয়েছিলো , ....... " না , বুঝতে পারলাম
না | আমি যখন বলেছি আমি রোজ তোমারই হাতের রান্না খাবো, মানে তুমিই করবে | এর বেশি বুঝতে
বোঝাতে ইচ্ছে করলে বাবাকে কল করছি , কথা বলে নাও |" .......... না , তারপর আর
কোনো কথা বোঝানোর কথা ভাবেওনি কমল | বৌয়ের রাত দিনের কাজের লোকের ডিউটিতে ও আজ অব্দি
ভালোই করে আসছে | তার সঙ্গে পার্ট টাইম অফিস | জীবনটা যেন চাপে চাপে চাঁপা সন্দেশ হয়ে
গেছে | মাঝে মাঝে মনে হয় , ওই ওর ছোটবেলাকার রোল মডেল অমিতাভ বচ্চনের মতন একদিন কমলার
বাবার সামনে গিয়ে আপাদমস্তক ঝেড়ে আসতে | কিন্তু তারপর ওনার মোটা গোঁফ , গোল রসগোল্লার
মতন চেহারা , আর কোমরে ঝোলানো বন্দুকটার কথা মনে পড়লেই অমিতাভ বচ্চন হওয়ার ইচ্ছেটা
কেমন ঘুঁচে যায় , তার বদলে রান্নার নুন , চিনি ঠিকঠাক হলো কি না , এই টেস্ট করতে করতেই
জীবনটা কেটে যাচ্ছে আর কি !
যাই হোক , এই কমলবাবুর উল্টোদিকের সিটে বসে থাকা লোকটার নাম তমাল
সেন | না , মানে তমালবাবু এখন ঠিক বসে নেই | তিন জন মোটা মোটা লোকের শেষে নিজের সরু
শরীরটা কোনোমতে টিকিয়ে রেখেছেন আর কি ! ওনার জীবনটাও আসলে এরকমই | ওই তিন জনের সিটে
কোনো রকমে ঠেলে ধাক্কে বসে থাকা চার নম্বর লোকটার মতনই | তোতলা হওয়াটাই যেন ওনার জীবনের
সব থেকে বড়ো অভিশাপ | একে লোকজন আজকাল রাজধানী এক্সপ্রেসের স্পিডে ছুটছে | সেখানে ওনার
লোকাল ট্রেনের মতন কথা ! দু মিনিট বাদে বাদেই স্টেশন এসে আটকে যায় | সেসব শোনার ধৈর্য
আর কারই বা আছে ! তার ওপরে ঈশ্বরের কৃপায় শরীরটায় একেবারে লেডিজ ফিঙ্গার | গা এ আর
গত্তি লাগলো না | কেউ ফুঁ দিলেই উড়িয়ে দিতে পারবে লোকটাকে | তাই তার কথা , তার অস্তিত্ব
জগৎ সংসারে আর কত টুকুই বা থাকতে পারে ! অফিসে তো জুনিয়ার স্টাফ থেকে চাপরাশি , সবাই
ওনাকে ডোন্ট কেয়ার | আর বাড়িতে ষোলো কলা পূর্ণ করে দেয় ছেলে | হ্যাঁ , বয়সে সে তমালবাবুর
অর্ধেক , কিন্তু পুষ্টি তার শরীরে একটু বেশিই লেগেছে | কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে পরে ,
তবে দেখে মনে হবে কোনো ভদ্রলোক | তার ওপরে গলার আওয়াজটাও সেরকম ভারী | মানে টোটাল তমালবাবুর
অপোজিট | উনি যদি ব্যাংকের ডিপোজিট হন, তাহলে ছেলে হচ্ছে সুদসহ মোটা টাকার লোন | তাই
বাবাকে সে পাত্তা দেয় না বললেই চলে | ক্লাস ইলিভেনেই আলমারির চাবি চুরি করে পঁয়তাল্লিশ
হাজারের একটা বাইক কিনে নিয়েছে | আর এখন কাজ হলো সেটা চড়ে টোটো কোম্পানি হয়ে ঘুরে বেড়ানো
| তার সঙ্গে চুলে জেল লাগিয়ে স্পাইক , মুখে গালাগালি , এইসব তো আছেই | আর বাবা যদি
ভুল করেও কিছু বলতে আসে তাহলে তো হয়েই গেলো | মানে এই যেমন কালই কি একটা ব্যাপারে তমালবাবু
মুখ খুলেছিলো ... " শো শো শোন বাবাই , যে যে যেটা করছিস , তার জ জ জন্য কিন্তু
ভু ভু ভুগতে হবে সারা জীবন .. আর .. " না , আর এগোতে না দিয়েই বাবাই সোনা গলার
ভলিউম বাড়িয়ে থামিয়ে দিয়েছিলো বাবাকে | তারপর বেশ রোয়াব দেখিয়েই বলেছিলো ,
---------- " বেশ করেছি পিঙ্কি কে পাড়ার মোড়ে দেখে গান গেয়েছি | ওকে আমার হেব্বি
পছন্দ | আর তোমার মতন মালগাড়ি তো নোই , যে গান শেষ হতে হতে বছর ঘুরে যাবে | কিশোর কুমারের
মতন গলা আমার | তুমি নিজের চরকায় তেল দাও না, আমারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়ো না বুঝলে
|"
কথাটা শেষ করেই বাবাই ঋত্বিক রোশনের মতন ঘরের থেকে বাইকের চাবিটা নিয়ে বেড়িয়ে গিয়েছিলো ধুম থ্রি স্টাইলে | আর তমালবাবু ঘরের এক কোনায় চুপচাপ বসেছিল মীনা কুমারী স্টাইলে | মাঝে মাঝে মনে হয় এই চুপচাপ বসে থাকতে থাকতেই হয়তো কখনো মৃত্যু চলে আসবে চোখের সামনে | তখনও উঠে আটকানোর আগে চুপ করিয়ে দেবে সে | সারা জীবনের মতন | তবে যাই হোক , ওনার পাশে অনেকটা জায়গা দখল করে বসে থাকা হোমরা চোমরা লোকটা কিন্তু তমালবাবুর থেকে সাইজে আর স্বভাবে একেবারেই আলাদা | লোকটা এই চারজনের সিটে যেমন ছড়িয়ে বসেছে , সেইরকম জীবনের সব ব্যাপারেই একটু ছড়িয়ে , একটু এক্সট্রা জায়গা নিয়েই থাকতে পছন্দ করেন | ওনার নাম পরিতোষ মুখার্জি | সরকারি বড়ো আমলা | তবে বসগিরিটা অফিসে বাড়িতে সব জায়গায় খাটাতেই সব সময় পছন্দ করেন | ওনার বৌ , ওনার মেয়ে তো ওনার ভয়ে তটস্থ থাকে যেন | মানে সকালের চা খবরের কাগজ থেকে রাতে ডিনার , সবই ওনার হাতের কাছে টাইমে চাই | তাই বৌ নামের কাজের লোকের যদি কখনো টাইমের এদিক ওদিক হয় তাহলেই চুলের মুঠিটা ধরে একটু ঝাঁকিয়ে দেয়া , খাট থেকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেয়া , হাতের কাছে পেপার ওয়েট থেকে কাঁটা চামচ যা পাবে সেটাকে ছুঁড়ে মারা , এসব ওনার নিত্য দিনের অভ্যাস | আর এই দৃশ্য দেখে মেয়েও বাবার থেকে শত হস্ত দূরেই থাকে দিনের পর দিন | আসলে এই সবার চোখে ওনাকে নিয়ে 'ভয়', 'ত্রাস' এই ব্যাপারটাকে বেশ এনজয় করেন পরিতোষবাবু | সেই জন্যই তো গরিব ঘরের মেয়ে বিয়ে করে এনেছিল | ওনার মতন আমলার ব্যাপারে পুলিশে কমপ্লেন কি , মুখ খুলে 'হাঁ' করারও যাতে সাহস না হয় কখনো | আর অফিসেও তাই | দাবড়ে , চেঁচিয়ে , হুঙ্কার দিয়ে জীবনটা দিব্বি কাটিয়ে দিচ্ছেন আর কি |
কথাটা শেষ করেই বাবাই ঋত্বিক রোশনের মতন ঘরের থেকে বাইকের চাবিটা নিয়ে বেড়িয়ে গিয়েছিলো ধুম থ্রি স্টাইলে | আর তমালবাবু ঘরের এক কোনায় চুপচাপ বসেছিল মীনা কুমারী স্টাইলে | মাঝে মাঝে মনে হয় এই চুপচাপ বসে থাকতে থাকতেই হয়তো কখনো মৃত্যু চলে আসবে চোখের সামনে | তখনও উঠে আটকানোর আগে চুপ করিয়ে দেবে সে | সারা জীবনের মতন | তবে যাই হোক , ওনার পাশে অনেকটা জায়গা দখল করে বসে থাকা হোমরা চোমরা লোকটা কিন্তু তমালবাবুর থেকে সাইজে আর স্বভাবে একেবারেই আলাদা | লোকটা এই চারজনের সিটে যেমন ছড়িয়ে বসেছে , সেইরকম জীবনের সব ব্যাপারেই একটু ছড়িয়ে , একটু এক্সট্রা জায়গা নিয়েই থাকতে পছন্দ করেন | ওনার নাম পরিতোষ মুখার্জি | সরকারি বড়ো আমলা | তবে বসগিরিটা অফিসে বাড়িতে সব জায়গায় খাটাতেই সব সময় পছন্দ করেন | ওনার বৌ , ওনার মেয়ে তো ওনার ভয়ে তটস্থ থাকে যেন | মানে সকালের চা খবরের কাগজ থেকে রাতে ডিনার , সবই ওনার হাতের কাছে টাইমে চাই | তাই বৌ নামের কাজের লোকের যদি কখনো টাইমের এদিক ওদিক হয় তাহলেই চুলের মুঠিটা ধরে একটু ঝাঁকিয়ে দেয়া , খাট থেকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেয়া , হাতের কাছে পেপার ওয়েট থেকে কাঁটা চামচ যা পাবে সেটাকে ছুঁড়ে মারা , এসব ওনার নিত্য দিনের অভ্যাস | আর এই দৃশ্য দেখে মেয়েও বাবার থেকে শত হস্ত দূরেই থাকে দিনের পর দিন | আসলে এই সবার চোখে ওনাকে নিয়ে 'ভয়', 'ত্রাস' এই ব্যাপারটাকে বেশ এনজয় করেন পরিতোষবাবু | সেই জন্যই তো গরিব ঘরের মেয়ে বিয়ে করে এনেছিল | ওনার মতন আমলার ব্যাপারে পুলিশে কমপ্লেন কি , মুখ খুলে 'হাঁ' করারও যাতে সাহস না হয় কখনো | আর অফিসেও তাই | দাবড়ে , চেঁচিয়ে , হুঙ্কার দিয়ে জীবনটা দিব্বি কাটিয়ে দিচ্ছেন আর কি |
তো এই ভিড়ে দাঁড়ানো এরকম অনেক কমলবাবু , বিমলবাবু , নন্দীবাবুদের
জীবনে এক একটা জার্নি চলছে এক নাগাড়ে | কারোর গাড়ি অনেক লেট্ এ চলছে , তো কারোর আবার
বিফোর টাইমে স্টেশনে এরাইভ করার মতন অবস্থা , তো কারোর আবার গাড়ি এখনো প্ল্যাটফর্মেই
দাঁড়িয়ে , গ্রিন সিগন্যাল আর পাচ্ছে না এগোনোর | তবে এই মুহূর্তে এই ভিড় ব্যান্ডেল
লোকাল হাওড়া স্টেশনের কারশেডে পৌঁছনোর সিগন্যাল পেয়ে গেছে | তবে গাড়িটা এখন প্রত্যেকবারের
মতন সব এনার্জি শেষ করে ধিকিয়ে ধিকিয়ে প্ল্যাটফর্মের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে | এই এক ! কারশেডে
দাঁড়ানোর সময়টা যেন কারোরই কিছুতেই পার হতে চায় না | মনে হয় রসগোল্লা কেউ সামনে ঝুলিয়ে
রেখেছে , কিন্তু সেটা আর খেতে দিচ্ছে না , এরকম একটা পরিস্থিতি | তো যাই হোক , এই মুহূর্তে
কেউ শেষ বারের ঘুমটা আর একটু ভালোভাবে ঘুমিয়ে নিচ্ছে , তো কেউ নিজের অফিস ব্যাগটা ট্রেনের
বাঙক থেকে নামিয়ে রেসে নামার জন্য রেডি হচ্ছে , যে গাড়িটা থামলেই সবার আগে ট্রেনের
দরজা দিয়ে লাফ মেরে নেমে এগিয়ে যেতে হবে ফার্স্ট হয়ে | আর ঠিক এই সময়েই ট্রেনের অলস
সময়টাকে কাঁপিয়ে হঠাৎ একটা 'চোর চোর' চিৎকার উঠলো ব্যান্ডেল লোকালে | যারা ঘুমোচ্ছিলো
তাদের ঘুম এই আওয়াজে হাওয়া | যারা দাঁড়িয়েছিল চ্যানেলে তারা আরো গেটের দিকে এগিয়ে এলো
, আর যারা বসে ছিল তারা উঠে দাঁড়ালো | সামনে কি দৃশ্য চলছে সেটা দেখার এখন প্রত্যেকেরই
একটা কৌতূহল | এই সময়েই একটা বছর পয়ঁতাল্লিশের লোক চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললো , " আমি
হাতে না হাতে ধরেছি | এই ছেলেটা অনেক্ষন ধরেই আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল | আর একটু হলেই
আমার পার্সটা নিয়ে হাওয়া হয়ে যাচ্ছিলো আর কি | কেমন লাগে বলুন ! দিনে দুপুরে ডাকাতি
যাকে বলে | ইশ | কি মহা ধড়িবাজ ছেলে রে বাবা |" ......... কথাটা শুনে আসে পাশের
লোকগুলোর এবার হো হো করে চেঁচিয়ে উঠলো | তাদের ভিড়ে ওই চোররূপী ছেলেটা এখন কুঁকড়ে
| গায়ের জামা ধরে টানাটানি করে একটা হাত ছিঁড়ে গেছে ওর , বোতামগুলোও অর্ধেক খুলে গেছে
এখন | তার মধ্যে দিয়েই অসংখ্য ফুটো হয় স্যান্ডো গেঞ্জিটা বেড়িয়ে আছে শরীরে | ওর হাতটা
ধরেই ওকে এই চার পাঁচ মিনিটে কয়েক ঘা মারা হয়ে গেছে | তাই মুখের কাছে কালশিটের রঙের
মতন লাল হয়ে রয়েছে , চুলটাও উস্কো খুস্কো | চোখ দুটো যেন অনেকদিন ঘুম না হয় নির্ঘুম
আজ | তার মধ্যেই এইবার সরকারি অফিসের বড়ো আমলা পরিতোষবাবুর হঠাৎ ছেলেটাকে দেখে ওই হুঙ্কারটা
দেয়ার ইচ্ছে হয়ে উঠলো কেমন | তাই উনি বেশ নড়ে চড়ে নিজের বড়ো শরীরটাকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে
ছেলেটার কলার ধরে চেঁচিয়ে উঠলো , ------ " এই ট্রেনের গেটে বাঁধুন এটাকে সবাই
| প্রত্যেকে নামার আগে এই মালটার গালে একটা করে থাপ্পড় মেরে তবে নামবে | তারপর পুলিশের
কাছে হ্যান্ড ওভার | চুরি করা জন্মের মতো ঘুচে যাবে এবার |" ..... কথাটা শুনে
বেশ অনেক লোকই এবার আরো উত্তেজিত হয়ে গেলো যেন | " ঠিক ঠিক ," " হোক
বাঁধা" , " মারা হোক এটাকে " এইসব প্রতিবাদী ইনকালাব জিন্দাবাদের মতন
শব্দে ট্রেনের কামরাটা গর্জে উঠলে মনে হয় এখন | আর তার মাঝে ছেলেটার করুন স্বর
" আমাকে মারবেন না | আমি আর করবো না কখনো | আমার কথাটা একটু শুনুন | আমাকে পুলিশের
কাছে দেবেন না |" , এইসব কথাগুলো কোথায় একটা ঢেকে গেলো যেন | পরিতোষবাবুই তারপর
লিডার সেজে ছেলেটার কলার ধরে হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে ওকে ট্রেনের দরজার সামনেটায় নিয়ে এসে
রডটার মধ্যে বাঁধলো জোড়ে | তার আগে অবশ্য একজন দায়িত্ব নিয়ে দড়িটা জোগাড় করে এসেছে
| এবার এই কারশেডে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটার থেমে থাকা সময়টা সবার কাছেই বেশ ইন্টারেষ্টিং
হয়ে উঠলো | চোর ধরার মতন এতো বড়ো কাজ করেছে বলে কথা ! যেটার জন্য কি না গোয়েন্দা ,
পুলিশ , কত কি লাগে ! আর তার ওপরে এই বাজারে যদি সত্যিই কারোর মানি ব্যাগটা হাওয়া হয়ে
যায় , তাহলে তো আর নাজেহাল হওয়ার শেষ থাকবে না | এ.টি.এম কার্ড , ডেবিট কার্ড , আইডেন্টিটি
কার্ড কত দরকারি জিনিসই তো থাকে ! না , এরকম কাজ যে করে তার মার্ খাওয়াটাই ঠিক | এই
ভেবেই কামরার এক একজন এসে দরজায় বাঁধা ছেলেটার কখনো চুলের মুঠি ধরে টেনে দিলো , তো
কখনো পিঠে , কখনো হাতে , কখনো গালে ভালো করে চড় থাপ্পড় বসিয়ে দিলো | এর মধ্যে সুবিনয়বাবুও
আচমকা এসে ছেলেটাকে দুটো কষিয়ে চড় মারলো দু গালে | একে গরম, তার ওপরে ভিড় , রাগে এখন
ওনার শরীরটাও কেমন গরম হয়ে গেছে | হঠাৎ মনে হচ্ছে ঐভাবে ট্রেনের দরজায় যদি কেউ ওনার
জামাইটাকে বেঁধে বসিয়ে রাখতে পারতো তাহলে যে কি ভালো হতো | বার বার ভিড়ে ঠাসা মুখগুলোর
মধ্যে সেই বাবাজীবনের মুখটা যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে ওনার , তাই রাগটা বেড়ে বেড়ে
দ্বিগুন চারগুণ হয়ে যাচ্ছে | আর সেই সমস্ত রাগ গিয়েই উজাড় করে দিলেন উনি চোরটার গালে
| জামাইকে তো আর এই জীবনে হয়তো থাপ্পড় মারার সুবর্ণ সুযোগটা পাওয়া হবে না | তার বদলে
এই চোরটাই সই | কারোর ওপর তো রাগটা বার করা গেলো ! একই অবস্থা ওদিকে কমলবাবুর ও | শ্বশুরের
সামনে তো আর এই জীবনে অমিতাভ বচ্চন হওয়া গেলো না ! কিন্তু এই ভিড় ট্রেনেও কি তা বলে
ভিজে বেড়াল সেজে বসে থাকবে ! একটা এতো বড়ো চোর সামনে , তাকেই নয় একটু নিজের একশন স্কিল
দেখিয়ে আসা যাক | কথাটা মনে হতেই উনি ছেলেটার মাথার চুলের মুঠিটা ধরে বেশ কয়েকবার ঝাঁকিয়ে
দিয়ে এলেন | এখন বেশ প্রাউড ফিল হচ্ছে নিজের ওপর | মনে হচ্ছে যদি কেউ একটু ভিডিওটা
করে বৌকে দেখাতো , তাহলে হয়তো কথায় কথায় বাবার হুমকি শুনতে হতো না | এমন কি আমাদের
গোবেচারা তমালবাবুও আজ খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে | তোতলা বলে কি মানুষ না ! বাইরের লোক
, নিজের ছেলে সবাই সারা জীবন অপমানই করে যাবে ! ও কখনো কাউকে কিছু ফেরত দেবে না ! এটা
হয় না কি ! এসব ভেবেই চোরের পিঠে গিয়ে চার পাঁচটা গুম গুম করে ঘুষি মেরে এলো | ইশ
, এরকমটা যদি কাল ছেলের পিঠে মারতো পারতো ! কথায় কথায় ওর ঋত্বিক রোশান সাজা বেরিয়ে
যেত |
যাই হোক , এইভাবে প্রায় পঞ্চাশ ষাট জনের চড় থাপ্পড় ঘুষি খেয়ে দশ
মিনিটের ভেতরে ট্রেন যখন প্ল্যাটফর্মে ঢুকলো তখন ওই আধ মরা ছেলেটাকে পুলিশের হাতে তুলে
দেয়া হলো দায়িত্ব সহকারে | তখন অবশ্য চোর একেবারে নিস্তেজ | দাঁত ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে
গালে | গায়ের জামা , ওই শতছিন্ন স্যান্ডো গেঞ্জি এখন পুরোপুরিই ছিন্ন | সারা শরীর জুড়ে
লাল লাল কালশিটের দাগ ভর্তি | চুলগুলো এলোমেলো ছন্নছাড়া | একদম ওর জীবনটার মতন | আসলে
একটা সময় ভেবেছিলো বি.কম পাশ করে কোনো বড়ো পোস্ট না হোক , গ্রূপ ডি পোস্টে একটা চাকরি
ঠিক জুটিয়ে নেবে সত্য | তবে "বেকারের রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়' কথাটা বি.কম পাশ করে
বুঝলো | ওর মতন হাজার হাজার গ্রাজুয়েট রোজ চাকরি খোঁজার লাইনে এসে ভিড় করে , সেখানে
সেদিন থেকে আরেকটা নাম ও যুক্ত হলো , সত্য বসু | তার মধ্যেও দু চারটে টিউশনি করতো
| কিন্তু তাতে আর কত টুকু কি হয় ! বড়ো জোর নিজের হাত খরচ | বাবা এর মধ্যে যেই কারখানায়
চাকরি করতো সেটাও হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলো | তারপর অভাবটা যেন হাত পা গজিয়ে আরো বেড়ে উঠলো
দিন দিন | দু বেলা ঠিক করে ভাত জোটাই কেমন দুস্কর হয়ে গেলো সত্যর বাড়িতে | অনেক সময়ই
রাতে ফ্যান খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস শুরু করতে হলো জীবনে | এই অব্দিও তাও কোনোভাবে
জোর করে কষ্টে শিষ্টে চালিয়ে নিচ্ছিলো ওরা | কিন্তু তারপর কাল রাতে যখন হঠাৎ বাবা বিছানা
থেকে উল্টে পরে গেলো ঘরের মেঝেতে, একদম বিনা নোটিশে যেন আকাশ ভেঙে পড়লো মাথায় | স্ট্রোক
এটার্ক | এই রকম হঠাৎ করে এসে সব এলোমেলো করে দেয় রোগটা | সুস্থ বাবা চোখের সামনেই
কেমন প্যারালাইসড হয়ে গেলো , হাত পা এর আঙ্গুল গুলো জোর করেও আর নাড়াতে পারছে না |
মুখটা একদম বেঁকে গেছে | এই মুহূর্তে কয়েকটা ওষুধ খুব দরকার | হসপিটালে ফ্রি তে এখন
শুধু মাটির নিচের প্লাস্টিকটাই দেয় | বেডও পাওয়া যায় না | সেখানে ওষুধ তো মহার্ঘ্য
| যত টুকু টাকা বাড়িতে জমানো ছিল, তারপর টিউশনের বাড়িগুলো থেকে এডভান্স নিয়ে শুধু অক্সিজেন
আর স্যালাইনের খরচটা উঠেছে | কিন্তু ওষুধ ! সেটা যে আর কোনোভাবেই জোগাড় করতে পারছিলো
না সত্য | কত আত্মীয়দের কাছে গেলো | পা এ পরে ভিক্ষা অব্দি চাইলো | কিন্তু কেউ স্বান্তনা
ছাড়া ওকে কিছু ফেরত দিতে পারলো না | আবার কেউ কেউ তো সেটাও না দিয়ে দূর দূর করে তাড়িয়ে
দিলো | এইসবের ভিড়ে কি করবে , কি না করবে ভাবতে ভাবতে স্টেশনের সামনে এসেছিলো ও আনমনে
| আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলো ভিড়ে ঠাসা ব্যান্ডেল লোকাল কে | কিছু না ভেবেই তারপর
উঠে পড়েছিল ও | চোখের সামনে তখন শুধু বাবার মুখটা ভেসে উঠছিলো যেন | সব ঠিক ভুলের হিসেবে
ছাড়িয়ে শুধু একটা মুখ | বাবার এখন নিশ্চই কষ্ট হচ্ছে খুব শ্বাস নিতে ! ওই হসপিটালের
নোংড়া মেঝেটায় পরে নিশ্চই চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে আসছে বার বার | মা একা বাবার পাশে
বসে কি করছে এখন ! হাতপাখা দিয়ে সমানে হাওয়া দিয়ে যাওয়া ছাড়া তো মা আর কিছু করতে পারবে
না | বাবাকে একা ফেলে তো কোথাও টাকার জোগাড়ও করতে যেতে পারবে না ! ওই হসপিটালের পুরোনো
পুরোনো ছাদ , চুন ওঠা দেয়াল , ওষুধ ওষুধ গন্ধ , রোগের ভিড়ে কি বাবার চোখ এই মুহূর্তে
সত্যকেই খুঁজছে ! নিশ্চই মনে হচ্ছে ছেলে ঠিক আসবে , সব কষ্ট দূর করার ওষুধ নিয়ে | কথাগুলো
ভাবতে ভাবতেই সেইদিন সত্য জীবনে প্রথম একজনের পকেটে হাত ঢুকিয়েছিল | ওর যে সেই সময়
মানি ব্যাগটা খুব দরকার ছিল ! টাকার খুব দরকার ছিল | তবে কাঁচা হাতের কাজ তো | প্রথম
চুরিতেই ধরা পরে গেলো ছেলেটা | আর তারপর তো ! এই গল্পটা শুরু থেকে যারা যারা পড়ছে
, তারা এর পরের গল্পটা সবাই জানে | শুধু ওই ট্রেনের প্যাসেঞ্জারগুলোরই যা জানা হলো
না সত্যকে | ওর কিছু বলার শোনার আগেই চোখ মুখ ফাটিয়ে চোর ধরার আনন্দে সবাই নিজের নিজের
গন্তব্যের দিকে রওনা হয়ে গেলো | আর সত্য , কিছুদিন আগে গ্র্যাজুয়েট হওয়া ছেলেটা 'চোর'
তকমা মাথায় নিয়ে প্রথম কোনো সরকারি ঘরে অফিসিয়ালি গেলো | লক আপে , বন্দি সেজে |
তবে সেইদিন সত্যর বাবা শেষ মুহূর্ত অব্দি অপেক্ষা করেছিল | যতক্ষণ চোখের সামনে সবটা অন্ধকার হয়ে না আসে , ততক্ষন | উনি আশা করছিলেন | সত্য ঠিক আসবে | ওষুধ ইনজেকশন সব নিয়ে , মাত্র আর কিছুক্ষন ; একটু সহ্য করে নিক | একটু জোর করে শ্বাস নিক | ঠিক ছেলে আসবে | সব বাঁধা পেরিয়ে | ওই ছোটবেলার মতন | দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে ঘুম থেকে ডেকে তুলবে বাবা বাবা বলে | এখনো যেন আওয়াজটা কানে বাজছে ওনার| ওই শেষ মুহূর্তের আওয়াজ | সব অন্ধকার হয়ে যাওয়ার আগে শোনা আওয়াজ | ছেলের গলা উনি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন এই আবছা পৃথিবীতেও |
No comments:
Post a Comment