জন্মের দিন থেকে এই শহর আমার একান্ত নিজের, যার সমস্ত পথ ঘাট অলি গলির পরিচয় আমার রন্ধ্রে মিশে আছে। আমৃত্যু পর্যন্ত যা আমার মধ্যেই থেকে যাবে। শোনা যায় গোবিন্দপুর ও সুতানুটির পরিচয় ম্যাপে দেওয়া থাকলেও কলিকাতার পরিচয় কিন্তু ম্যাপ থেকে বিপুপ্ত ছিল। কলকাতা বা ক্যালকাটা অথবা কলিকাতা কিভাবে এই কথাটির উৎপত্তি হোল সেই নিয়ে অনেক মতান্তর আছে। তথ্যে আছে কলিকাতা শব্দটি আসে কালিখেত্র থেকে। যার মানে “Fields of Goddess Kali”, কারণ কলকাতাবাসীরা ছিলেন মা কালীর ভক্ত। এইটাও বলা হয় যে এর উৎপত্তি "কিলকিলা" শব্দ থেকে যার অর্থ সমতল ভূমি। আবার কোথাও এইটাও বলা আছে যে কথাটি এসেছে "খাল-কাটা" থেকে।
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে যে-তিনটি গ্রাম নিয়ে কলকাতা শহর গড়ে উঠেছিল, গোবিন্দপুর ছিল তার অন্যতম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অপর দুটি গ্রাম ছিল সুতানুতি ও ডিহি কলিকাতা।
গোবিন্দপুর গ্রামের নামকরণ প্রসঙ্গে তথ্য পাওয়া কবিরামের লেখা "দিগ্বিজয়ী প্রকাশে" রাজা গোবিন্দশরণ দত্ত নামে এক ব্যক্তি এই অঞ্চলের উপর দিয়ে তীর্থে যাচ্ছিলেন। দেবী কালী তাঁকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে আদেশ করেন নদীর তীরবর্তী পরিত্যক্ত ভূভাগ খনন করতে। স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী কাজ করে তিনি মাটির তলা থেকে প্রচুর ধনসম্পত্তি উদ্ধার করেন। গোবিন্দ দত্ত এখানেই থেকে যান এবং তাঁর নামানুসারেই ১৫৯৬ খ্রিস্টাব্দের আসে-পাশে গ্রামের নামকরণ হয় গোবিন্দপুর।আবার শ্রীলা ভক্তিবিনোদ কেদারনাথ দত্তের তাঁর "দত্ত বংশমালা"-র দ্বিতীয় প্রকাশনে লিখেছেন যে আন্দুলের দত্তচৌধুরী পরিবারের রাজা গোবিন্দশরণ দত্ত দিল্লীশ্বর আকবরের কাছ থেকে এই গোটা জমিটি পেয়েছিলেন। পরতবর্ত্তী কালে সেই জমি তাঁরই নামে "গোবিন্দপুর" নামে নামকরণ করা হয়। কলকাতা মহানগরীর প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সুতানুটি ও ডিহি কলিকাতা তাদের নিজস্ব পরিচিতি হারায় এবং নতুন ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণের সময় গোবিন্দপুর গ্রামটি ধ্বংস করে ফেলা হয়। এই ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণের জন্য ইংরেজরা উচিত দামে নীলমণি ঠাকুরের কাছ থেকে তাঁর ধনসায়রের বাড়ি, বাগান, বৈঠকখানা কিনে নিয়েছিল।
কলকাতার বিখ্যাত ও জাগ্রত কালীঘাটের নামকরণ হয়েছিল কিছুটা এইভাবে।কালীঘাট কলকাতায় হুগলি নদীর প্রাচীন প্রবাহের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটি ঘাট, যা কালীপূজার কারণে পবিত্র। হুগলি নদীর (গঙ্গা) আদি প্রবাহপথ আদিগঙ্গার তীরে এই কালীক্ষেত্র।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে পৌর সংস্থা বর্জ্যজল-নিকাশীব্যবস্থার জন্য বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে কালীঘাট পর্যন্ত টানা একটি লম্বা জমি বেছে নেয় এবং সিআইটি এই নালার উপর প্রায় ৩০০ গজ লম্বা একটি রাস্তা বানিয়ে গড়িয়াহাটের সঙ্গে যুক্ত করে কালীঘাটকে। নাম হয় ‘মেন সিওয়ার রোড’। নামে নালার অনুষঙ্গ থাকায় যে সব শিক্ষিত বাঙালিরা এখানে বাস করতে আসেন তাঁদের স্বস্তি ছিল না। এঁদের উপর্যুপরি দরবারে ১৯৩১-এ রাস্তার নাম হয় রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। মূল রাস্তার সঙ্গে সংযুক্ত রাস্তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল একডালিয়া,ফার্ন এবং কাঁকুলিয়া রোড। বসবাস বাড়তে থাকলে স্কুল ছাড়াও সৌন্দর্য ও স্বাস্থ্য চিন্তা থেকে তৈরি হয় লেক,লিলি পুল। বালিগঞ্জ স্টেশনের নৈকট্যের ফলে দক্ষিণের গ্রামীণ অঞ্চলের পসারিদের সঙ্গে সংযোগে জন্ম নেয় গড়িয়াহাট বা লেকমার্কেটের বাজার অঞ্চল।
দক্ষিণ কলকাতায় গড়িয়াহাট যাওয়ার পথে ট্রাইআঙ্গুলার পার্কটি পড়ে তার পাশে একটি ছোট্ট কালীমন্দির দেখতে পাওয়া যায়, ছোট্ট এই কালীমন্দিরটি বড়ো বড়ো বাড়ির মাঝে বেশ কোণঠাসা, তাই চট করে হয়তো চোখে পরবে না। কিন্তু এই কালী মন্দিরটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে, এই মন্দিরটি স্থাপন করেন এক দুর্ধষ ডাকাত, যার নাম ছিল মনোহর বাগদি। এই মনোহর ডাকাতের নামেই তৈরি হয় দক্ষিণ কলকাতার বিখ্যাত রাস্তা মনোহরপুকুর রোড। কি ভাবে তৈরি হোল এই রাস্তা তার পিছনে একটি গল্প আছে, সেটি জানা যাক।
এরকম সময়ে, এক গভীর রাতে মনোহর ডাকাত দলবলসহ ডাকাতি করে, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ফিরছিল তার আস্তানায়। হঠাত্ তাদের চোখে পড়ে, একজন মহিলা বাঘের আঘাতে আহত হয়ে খালের কাদায় পড়ে আছে, আর তার পাশে পাঁচ-ছয় বছরের ছেলে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তারা তুলে নিয়ে আসে দুজনকে, কিন্তু অনেক সেবা-শুশ্রূষা করার পরেও মহিলাটিকে বাঁচানো যায়নি কিন্তু ছেলেটি বেঁচে ওঠে।
মনোহর ডাকাত মহিলা এবং শিশুদের উপর কোনও অত্যাচার করতো না। তাই ছেলেটিকে নিয়ে সে পড়লো মহা ফ্যাসাদে! কার বাড়ির ছেলে, সেটা খুঁজে বের করতে গেলে মহা বিপদ, আবার এই ছোট ছেলেকে সে রাখেই বা কোথায়! শেষে ছেলেটিকে মনোহর আপন করে নিল। নিজের ছেলের মতো তার দেখভাল করতো, তাকে গল্প শোনাতো, তার জন্য ভালো জামাকাপড় জোগাড় করে নিয়ে আসতো। ছেলেটির আগের স্মৃতি কিছু ছিল না। মনোহর তার নাম দিলো হারাধন।
সন্তান স্নেহ যে মানুষকে কতটা বদলে দিতে পারে, সেটার আর একটা উদাহরণ হলো মনোহর ডাকাত। যতো দিন যায়, হারাধনের উপরে মনোহরের স্নেহ আরো বেড়ে চলে। ডাকাতি করার উত্সাহ ক্রমশঃ কমে যেতে থাকে তার। দলের লোকেরা অনেক অনুরোধ করলে, তবে সে এক এক দিন যেত ডাকাতি করতে।
ধীরে ধীরে হারাধন বড়ো হতে লাগলো, আর মনোহর বৃদ্ধ হতে লাগলো। মনোহরকে একটা চিন্তা সবসময় তাড়া করতো, যে তার পরে হারাধনের কি হবে! এর মধ্যে, ভবানীপুর অঞ্চলে ক্রিশ্চান পাদ্রীরা ছোট ছোট পাঠশালা খুলছিলেন। তারা গরিব-দুঃখী ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতেন, খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা দিতেন এবং বাইবেল পড়াতেন। মনোহর তাদের কাছে ছেলেকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিলো। হারাধনের নাম হলো হারাধন বিশ্বাস, বাবা মনোহর বিশ্বাস। মেধাবী হারাধন, খুব যত্ন করে লেখাপড়া শিখতে লাগলো।
এদিকে দিনে দিনে জরার ভারে মনোহরের শক্তি কমে আসছিল, আগের মতো চলাফেরা করতে পারতোনা সে। অন্যদিকে কোম্পানির শাসন শুরু হয়ে গেছে, তাই চুরি ডাকাতি রাহাজানি কমে আসছিল। মনোহরের দল ভেঙে গেছিলো। এখন হারাধনকে ছেড়ে থাকতে পারতোনা সে এক মুহূর্ত। কিন্তু বিচক্ষণ মনোহর তার পেশার কথা গোপন করেছিল ছেলের কাছে, তাই শেষ জীবনে সে চাষবাস করে আর জমিতে লোক খাটিয়ে, চাষীর মতো জীবন কাটাতো। মনে অনুতাপও জন্মেছিল তার।
মৃত্যুর আগে, পাওয়া গুপ্তধনের নাম করে, ছেলেকে তিন ঘড়া মোহর আর সোনা-রুপো দিয়ে যায় মনোহর। আরো অনুরোধ করে, তার মৃত্যুর পরে এই এলাকায় যেন হারাধন কয়েকটা দিঘি আর পুকুর কাটিয়ে দেয়। কারণ ওই সময়ে এই এলাকায়, গরমের সময় খুব জলকষ্ট ছিল। হারাধন, বাবার মৃত্যুর পরে, সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। মনোহরপুকুর সংলগ্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি বড়ো পুকুর ও দিঘি কাটিয়ে দিয়েছিল সে। আজ সেগুলোর অনেকগুলো বুজে গেছে, আর কয়েকটা অসংস্কৃত অবস্থায় আছে।
আজকে মনোহরও নেই, আর হারাধনও নেই। কিন্তু তাদের স্মৃতি ও কীর্তি অমর করে রেখেছে, সাউথ কলকাতার একটি রাস্তা, যার নাম মনোহরপুকুর রোড ।
মেজর উইলিয়াম টলি নামে সাহেব ১৭৭৫-৭৬ সালে কলকাতার সঙ্গে অসম ও পূর্ববঙ্গের যোগসূত্র হিসাবে একটি নালা খনন ও ড্রেজ করার কাজ শুরু করেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি টলি সাহেবকে এই নালা দিয়ে যাতায়াতকারী নৌকাগুলি থেকে টোল আদায় ও নালার ধারে একটি গঞ্জ বা বাজার স্থাপনের অনুমতি দিয়েছিল। ১৭৭৬ সালে এই প্রকল্পটি সম্পন্ন হয় এবং পরের বছরেই এটি সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এই টালির নালাটি টলি সাহেবের নামেই টালির নালা (ইংরেজিতে টলি’জ ক্যানেল) হিসেবে পরিচিতি পায়। সাহেবের প্রতিষ্ঠিত বাজারটি টালিগঞ্জ নামে পরিচিত হয়। নালার পূর্ব পাড়ে বর্তমান টালিগঞ্জ রোডের কাছেই কোথাও এই বাজারটি অবস্থিত ছিল। পরবর্তীকালে টালির নালার দুধারে একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল টালিগঞ্জ নামে অভিহিত হয়ে থাকে।
নাকতলা জায়গাটি এসেছে "নাগ"তলা থেকে, যার অর্থ সর্প। কথায় কথায় সেটি নাকতলায় প্রচলিত হয়ে যায়।
এন্টালি বা ইন্টালী –পূর্ব নাম 'ডিহি ইটালি"। হেঁতাল গাছের বন থাকায় হেন্তালি সেখান থেকে ইটালি,ইন্টালী ও এন্টালি।মতান্তরে , ওই এলাকায় ইট ও টালির ব্যবসা থাকায় নাম হয় ইটালি।
আমরা তো জানি যে সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার বিখ্যাত দুর্গা পুজোর জন্য। কিন্তু কিভাবে এর নামকরণটি হোল জানা যাক। আগে নাম ছিল “নেবুতলার মাঠ” । তারও আগে নামছিল “সেন্ট জেমস স্কোয়ার”।একদম পূর্বে নাম ছিল হুজুরিমল ট্যাঙ্ক। পাঞ্জাবি ব্যবসায়ী ৫৫ বিঘার অপর পুকুর খনন করেন । লোকে বলতেন হুজুরিমল ট্যাঙ্ক বা পাদ্মপুকুর।পরে পুকুর ভরাট করে হয় মুচিপাড়া থানা আর কেরানিবাগান।পরে এই কেরানিবাগানের নামহয় নেবুতলা বা লেবুতলার মাঠ। আজ তা শহীদ সন্তোষ মিত্রর নামে সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার । হুজুরিমলের পুকুর বুজিয়ে তৈরী হয় বাগান। এই বাগানে কম্পানীর পর্তুগীজ কেরানিরা বাস করতেন। সেই থেকে এর নাম হয় কেরানিবাগান।
বেশ কিছুকাল আগেও কলকাতায় থিয়েটার রোড নামে রাস্তার অস্তিত্ব ছিল। পুরসভার রোড রেনামিং কমিটির সদস্যরা সেটি পালটে নামকরণ করে শেক্সপিয়ার সরণি। ১৯৬৫ সালে ৮ই ফেব্রুয়ারি এই নামকরণটি হয়। উয়িলিয়াম শেক্সপিয়ার তাতে কতটা সম্মানিত হয়েছে জানা নেই কিন্তু, ইতিহাস যে তার ফলে বিকৃত হয়েছে সেটা বলাই যায়। তার কারণ ওই রাস্তার উপরেই ছিল সে যুগের বিখ্যাত রঙ্গমঞ্চ চৌরঙ্গী থিয়েটার। তার অবস্থান ছিল ওই থিয়েটার রোড ও চৌরঙ্গী রোডের সংযোগের দক্ষিণ পূর্ব কোণে। ওই থিয়েটার হলের জন্যই পাশের রাস্তার নামকরণ করা হয়েছিল থিয়েটার রোড। কালের নিয়মে সেই থিয়েটার আর নেই। কিন্তু এ শহরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদেশি রঙ্গালয়ের স্মৃতি বিরাজমান ছিল ওই থিয়েটার রোড নামের মধ্যে। নাম বদলের সাথে সাথে সেই ইতিহাস ও মুছে যায় চিরকালের মতন।
উল্টোডাঙ্গা জায়গাটির নাম আসে বেশ বিচিত্র ভাবে।এখানে খালের পাশে নৌকা বা ডিঙি উল্টো করে আলকাতরা লাগানো হত। তার থেকে উল্টোডিঙি অপভ্রংশ উল্টোডাঙ্গা ।ওই দিকটা কলকাতার পূর্ব দিক। খাল দিয়ে ভাগ হয়েছে। এই খাল খুব সম্ভব বিদ্যাধরী। এখন খাল মজে হেজে গেছে। ডিঙি উল্টে রাখা একটা রেওয়াজ ছিল যাতে এপার ওপার করতে পারে লোকজন। এখানে অনেকদিন পর্যন্ত বড়ো নৌকা চলাচল করতে দেখা যেত। তখন ওটা বালুমাঠ।
তবে বাঁশ বা কাঠের ব্যবসার অন্য এক ইতিহাস এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কিন্তু তা ধরে নামের ইতিহাস জানা যায় না।
লেবুতলার নামকরণ হয় কতকটা এইভাবে, জনৈক্য ভুবন পাল ওখানে একটি বাজার বসান যা ভুবনপালের বাজার বা ন্যাড়া গির্জার বাজার বা নেবুতলার বাজার নামে পরিচিত। অসংখ্য লেবুগাছ থাকায় এই কেরানিবাগানের নাম হয় লেবুতলা বা নেবুতলা।
র্বতন ডালহৌসী স্কোয়ার (অধুনা বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ) থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত এই রাস্তাটি প্রসারিত ছিল। পরে এই রাস্তার নাম হয় বউবাজার স্ট্রিট। 'বউবাজার' শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে দুটি মত রয়েছে। একটি মত অনুসারে, মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী বিশ্বনাথ মতিলাল তাঁর বাঙালি পুত্রবধূকে একটি বাজার লিখে দেন, সেই বাজারটিই 'বহুবাজার' (হিন্দিতে 'বহু' শব্দের অর্থ 'পুত্রবধূ') এবং পরে তা বিকৃত হয়ে 'বউবাজার' নাম নেয়।তবে ঐতিহাসিকেরা এই ব্যবসায়ীর পরিচয় নির্ধারণে অসমর্থ হয়েছেন। তাই দ্বিতীয় মতে, এই অঞ্চলে বহু বাজার ছিল এবং সেই সব বাজারে বহু জিনিসপত্র বিক্রি হত। সেই থেকেই এই বাজারটি প্রথমে 'বহুবাজার' ও পরে তা বিকৃত হয়ে 'বউবাজার' নাম নেয়। প্রথম মত অনুসারে, উক্ত বাজারটি ছিল ৮৪ এ এলাকায় অধুনা নির্মলচন্দ্র স্ট্রিটের মোড়ে। দ্বিতীয় মতে যে বাজারগুলির কথা বলা হয়েছে সেগুলির অবস্থান ছিল ১৫৫-৫৮ এলাকায়।
পরে বউবাজার স্ট্রিটের নামকরণ করা হয় বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট (স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলির (১৮৮৭-১৯৫৪) নামানুসারে। ইনি ২৪ বছর ব্রিটিশ জেলে অতিবাহিত করেন। পরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন)। যদিও এলাকার নামটি বউবাজারই থেকে যায়। বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট থেকে মহাত্মা গান্ধী রোড পর্যন্ত এলাকার নাম এখনও বৈঠকখানা রোড।
এইবারে কলেজ স্ট্রীট বা বই পাড়ার চিত্র টা একটু দেওয়া যাক। সেকালের চিত্র টা যেরকম ছিল এখনকার মানুষের কাছে সেটা কল্পনাতীত। কলেজ স্কোয়ার বা গোলদিঘির দক্ষিণ দিকের রাস্তার নাম ছিল মির্জাপুর স্ট্রীট, এই রাস্তার পশ্চিম অংশের নাম ছিল কলুটোলা, তারপর আরও পশ্চিমে গিয়ে এটাই ক্যানিং স্ট্রীট। কলেজ স্কোয়ারর পূর্ব ও পশ্চিমের রাস্তা দুটোকেই কলেজ স্কোয়ার বলা হতো। বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রীট নামকরণ পরে হয়েছে। গোলদিঘির পশ্চিমে বিরাজ করছে কলেজ স্ট্রীট সেকাল থেকে এখন।
হাতিবাগান কলকাতার সবচেয়ে পুরনো জনবসতিগুলির মধ্যে একটি। সেই কারণে এই অঞ্চলটি বহু ঐতিহ্যবাহী দোকান, শতাব্দীপ্রাচীন হাতিবাগান বাজার,স্টার থিয়েটারসহ একাধিক পুরনো নাট্যমঞ্চ ও বেশ কয়েকটি সিনেমা হলের জন্য বিখ্যাত। কলকাতার অন্য কোথাও এতগুলি নাট্যমঞ্চ বা সিনেমা হল দেখা যায় না। স্টার থিয়েটার। এই অঞ্চলের জনপ্রিয়তম ও অন্যতম প্রাচীন নাট্যমঞ্চ ও সিনেমা হল। ১৯শ শতাব্দীর শেষভাগে নির্মিত এই নাট্যমঞ্চে গিরিশচন্দ্র ঘোষেরএকাধিক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। রামকৃষ্ণ পরমহংসওএকাধিকবার এই নাট্যমঞ্চে নাটক দেখতে আসে।
"হাতিবাগান" নামটির উৎপত্তি নিয়ে দু'টি মত প্রচলিত আছে। বাংলায় "হাতি" শব্দের অর্থ হস্তী ও "বাগান" শব্দের অর্থ উদ্যান। একটি মত অনুসারে, ১৭৫৬ সালে কলকাতা আক্রমণ করার সময় নবাব হাতিগুলিকে এখানে রাখা হয়েছিল। অন্য মতে, এই অঞ্চলে "হাতি" পদবীধারী জনৈক ব্যক্তির একটি বাগানবাড়ি ছিল। তা থেকেই "হাতিবাগান" নামটি এসেছে।মেহতাব চাঁদ মল্লিক পরে সেই বাগানবাড়িটি কিনে নিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, এই মেহতাব চাঁদ মল্লিকই হাতিবাগান বাজারটি প্রতিষ্ঠা করেন।
১৮৯৫ খ্রী পূর্ত বিভাগ "Ancient Monuments in Bengal” নামে একটি পুস্তক প্রকাশিতো করেন। ওই বইতে সে সময়েরএশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগারিক পণ্ডিত হরিমহন বিদ্যাভূষণের প্রবন্ধ
থেকে জানা যায় যে প্রায় দেড়শো বছর আগে কলকাতার শোভারাম বাসাক স্ট্রীটের বাবু জগন্নাথ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। কাশীপুরে তাঁর একটি উদ্যান ছিল। সেখানে তিনি গোপাললাল জীউর বিগ্রহ স্থাপন করেন। শোভারামের শ্যামচাঁদ জীউর নামে শ্যামবাজার নামাঙ্কিত হয়। হলওয়েল সাহেব শ্যামবাজারের নাম পরিবর্তন করে চার্লস বাজার রাখেন। পরে শোভারামের অনুরোধে তাঁর আত্মীয় শ্যামচাঁদ বসাকের নামে শ্যামবাজার ও শ্যামপুকুর নামকরণ হয়।
বর্তমানে যে জায়গায় শোভাবাজার রাজবাড়ি অবস্থিত সে স্থানে শোভারামের উদ্যান ছিল। সেখানে না না প্রকার শাক সবজি উৎপন্ন হতো। পরে ওই বাগান বাজারে রূপান্তরিত হয় এবং শোভারামের নামানুসারে শোভাবাজার নামে খ্যাত হয়।
বাবুসংস্কৃতির চর্চার দীর্ঘকালীন অভ্যাসের ফলেই হয়ত এই আলোচনার সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে বাগবাজার স্ট্রিট—তার পুরনো থেকে নতুন হয়ে ওঠার বর্ণাঢ্য ইতিহাস। কেউ মনে করেন যে ক্যাপ্টেন চার্লস পেরিনের হুগলির তীরে বসতবাড়ি সংলগ্ন বিশাল বাগান থেকেই নামকরণ বাগবাজার। এ সম্পত্তি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে গেলে তা হয়ে ওঠে বারুদ তৈরির কারখানা। বাংলার নবাবের কোপদৃষ্টি পড়ায় এ অঞ্চল আর সাহেবদের কাছে নিশ্চিন্তির থাকল না। বাগবাজার অঞ্চলের তালুকদারি শোভাবাজারের দেবদের উপর ন্যস্ত হলে এখানে বসতি বাড়ে।
এই ভাবেই সমস্ত শহর জুড়ে রয়েছে শুধু ইতিহাসের পাতা যা বিভিন্ন জায়গাকে জুড়ে রেখেছে উত্তর থেকে দক্ষিণ।
তথ্য সংগ্রহ : কলিকাতার রাজপথ, ৭০ বছরে কলেজ স্ট্রীট, উইকি।
...ক্রমশ
No comments:
Post a Comment