- সুপ্রতীক চক্রবর্তী
মফস্বলের একটা অন্যরকম গন্ধ আছে। গন্ধটা ভেজা মাটির মতো কিংবা রোদে শুকোনো
খটখটে জামার মতো ভুরভুরে একটা সুবাস। যাই বলুন, মফস্বলের ছোটো ছোটো গলি গুলোয় একটা
প্রানবন্ততা আছে।
আমাদের ছেলেবেলা গুলো কেটেছে ঠিক এমন অজস্র গলিতে,মাঠে। গলি গুলোয় ইট সাজিয়ে
উইকেটোচিত ক্রিকেটে তখন আমোদ ছিলো, নাক আর ঠোঁটের মাঝখানের
স্বল্প জায়গায় বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরতো, চেটে নিলে নোনতা
লাগতো। বল ছুটতো ড্রেনের দিকে, আমরা ছুটতাম তড়িতবেগে। ঝপ করে
নালার জলে বল পড়তো, আমরা রাস্তার ওপর শুয়ে প্রানপনে হাত
বাড়িয়ে বল নেওয়ার চেষ্টা করতেই হঠাত পাশের বাড়ির কাকিমা বলে উঠতো "ছি!! এদো
নালা থেকে বল তুলছিস???তোর মাকে বলে দেব"। বল তো নিতামই,
তার সাথে সেই কাকিমার অনুপস্থিতিতে তার বাড়ির দেওয়ালে ভেজা বলের
বাড়ি মেরে ছাপ বসিয়ে আসতাম। আক্রোশ এরেই কয়। মফস্বল এরকমই।
মফস্বল অন্যরকম। ম্যারাপ বেধে ফাংশন হয়। বান্টি কবিতা বলতে মঞ্চে উঠলে বান্টির
মা টেনশনে কাঁপে। কিসের টেনশন!!বান্টি একটা শব্দও যদি ভুলে যায় পাশেই বসা বিট্টুর
মা মনে মনে হাততালি দিয়ে উঠবে কিনা!!দুজন একই সাথে কবিতা শেখে তো! আতিথেয়তা বা
খাওয়াবার একটা প্রবনতা ছেলেবেলায় ঢের দেখেছি। পাশের বাড়ির কাকিমা টিফিন বাটিতে
শুক্তো রেঁধে দিয়ে যেতো মায়ের হাতে, মা ফেরত দেবার সময় সেখানে আলুপোস্ত করে
দিত। বাটিতে কিছু ভরে ফেরত দিতে হয়। খালি দিতে নেই।
মফস্বলে যে ছোট ছোট টিনের চালের বাড়ি গুলো পাশাপাশি বসত করে, এক জানলা দিয়ে পাশের বাড়ির
কেচ্ছা দেখা যায়, বৃষ্টি পড়লে ডাক দেওয়া যায় "ও মিলির
মা!কাপড় গুলো তুলে নাও", এক অদ্ভুত আত্মীয়তা সুত্রে
বেধে থাকে শিকলের মতো। মনে পড়ে ছেলেবেলার কথা, একটা টিভিতেই
প্রতিবেশীরা সবাই মিলে ক্রিকেট বিশ্বকাপ দেখছে, চা বিস্কুট
জুগিয়েই যাচ্ছে মায়েরা। ক্লান্তি বিরক্তিও হয়তো ছিলো, কিন্তু
সেটা প্রকাশ্যে আসতো না। তাই সেটা ছিলো সব পেয়েছির দেশ।
অনেক দিন পর বাড়ি ফিরে এলে কেমন একটা লাগে। সারাক্ষন সেই উত্তাপটা খুজে বেড়াই।
সাইকেলে এক ঝুড়ি সবজি নিয়ে ফেরিওয়ালা মোক্ষম সময়ে ডাক দেয় "ভেন্ডি বরবটি
আলু...." মা কাকিমারা যেনো এই ডাকের জন্যই অপেক্ষা করে, যে যার গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে
জড়ো হয়, শুরু হয় দরদাম। আমি ভিড় এড়িয়ে বেরোতে চাই, বেশ বুঝি ভিড়ের কেউ কেউ আমায় দেখেছে, এখন তাদের কাছে
বরবটির থেকেও আমি বেশী আলোচ্য। আমিও ভদ্রতার খাতিরে ঢিপ করে প্রনাম করে বলি
"কাকিমা,কেমন আছো?" হেসে উঠে
উনি হয়তো বলেন "ভালো, বাবা,একদিন
আসিস সময় করে"। আমার ভালো লাগে। এটাই তো আমার শেকড়। রোজ বিকেলে পাড়ার মোড়ে যে
জটলা জমে, বাছাই করা কারোর রীতিমত পোষ্টমর্টেম করেন ওনারা,
আগে বিরক্ত লাগতো। এখন বেশ লাগে। কেন জানিনা মনে হয়, আমাদের মনটা কখোনোই ছোটো নয়, যেখানে রোজ বাঁচছি সেই
পরিসরটা সংক্ষিপ্ত বরং। এতে আমাদের দায় নেই। আমরা মফস্বল বা ছোটো ছোটো গেঁয়ো শহরের
লোকেরা বাঁচতে ও বাঁচাতে এখনো ভালোবাসি। এখনো জীবনের খাতায় আঁকিবুকি করি,হিজিবিজি কাটি, এখনো রবীন্দ্রনাথকে রাখি বালিশের
তলায়। বিশ্বাস করুন আমরা এখনো পুরো যন্ত্র হয়ে যাইনি। আমরা প্যাডেল করে সাইকেল
চালাই, খোলা বাজারে কানকো দেখে মাছ কিনি, চায়ের ঠেকে হাজিরা দিই। আমাদের মাল্টিপ্লেক্স নেই, কে
এফ সি নেই, নাইট ক্লাব নেই। আমরা আমাদের নিয়েই খুশি।
যতো দিন
সেই বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধটা গায়ে মেখে থাকবে হয়তো বেঁচে থাকবো। আমি এখনো স্বপ্নে
শুনি টিনের চালে বৃষ্টির বাড়া-কমার আওয়াজ। শুনেছেন? শোনেন নি
কোনোদিনও?? কি আর করলেন জীবনে? কলতলায়
বালতি রেখে লাইন দিয়েছেন?? পাশের বাড়ি তে হঠাৎ হাজির হয়ে
বলেছেন "বৌদি, সিঙ্গারা এনেছি, চা
করো"। বলেন নি??ধুর!! কি আর করলেন তাহলে জীবনে?
No comments:
Post a Comment