- বিকাশ কল্প
পরিচালক: নন্দিতা দাস
সময়: ১:৫৭ঘন্টা
আভিনয়: নওয়াজ উদ্দীন
সিদ্দীকি,রসিকা দুগ্গল,তাহির রাজ ভাসিন,ঋষি কাপুর,পরেশ
রাওয়াল,দিব্যা দত্তা
বিষয়: জীবনী, নাটক,
ইতিহাস
আমরা আদতে কোথাও পৌঁছতে
চাই না। এই কোথাও পৌঁছতে না চাওয়ার গল্প -"মান্টো"।দেশভাগের নৃশংসতায়
মানসিক ভারসাম্যহীন, ক্ষতবিক্ষত হওয়া এক বৃদ্ধ শিখ খুঁজে বেড়ান "টোবা টেক
সিংহ"। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বৃদ্ধের মৃত দেহ পরে থাকে নো ম্যান'স
ল্যান্ডে। তিনি হিন্দুস্থান চাননি, তিনি পাকিস্তান চাননি। তিনি পৌঁছতে চেয়েছিলেন
নিজের গ্রামে, নিজের বাড়িতে- টোবা টেক সিংহ-এ। তার গন্তব্যে ছিল না কোন পাকিস্তান
বা হিন্দুস্থানের অস্তিত্ব। রাজনৈতিক নোংরামীতে ভাগ হয়ে যাওয়া এই সব ভৌগোলিক
পরিমন্ডলের আড়ালে আসলে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে এইসব মানুষের শেকড়ের অস্তিত্ব।
যতবার তোমার চোখে চোখ
রাখি,
জেগে ওঠে আজন্মের শোক।
দেশ গুলো ধর্মের নয়,
মানুষের হোক!!
এই রকমই একটা দৃশ্য
দেখি ছবিতে। চল্লিশের দশকে তৎকালীন বোম্বাই-এর বন্দর থেকে করাচি গামী জাহাজে উঠতে
উঠতে মান্টো-একজন প্রতিভাবান ও প্রতিষ্ঠিত উর্দু লেখক তথা চিত্র নাট্যকার সাদান
হাসান মান্টো(নওয়াজ উদ্দীন সিদ্দীকি) বলে ওঠেন, "হিন্দুস্থান
জিন্দাবাদ"। অপরদিকে একজন স্ট্যাগলিং হিন্দু অ্যাকটর শ্যাম চড্ডা(তাহির রাজ
ভাসিন) বন্ধু মান্টোকে শেষ বিদায় জানাতে এসে বলে ওঠে "পাকিস্তান
জিন্দাবাদ"। আসলে ধর্মীয় পোশাকের আড়ালে দিনের শেষে আমরা সবাই মানুষ বটে। তাই
মানুষ মানুষের শুভাকাঙ্খী। সেই হেতু দেশভাগের পরিপেক্ষিতে দাঙ্গাকালীন পরিস্থিতিতে
একজন ভগ্নপ্রায় দেশ ত্যাগী মুসলিম লেখককে তার সদ্য ভিন্ দেশী হয়ে যাওয়া বন্ধুকে
শুভেচ্ছা জানায়। আজ এই সাম্প্রদায়িক উগ্র জাতীয়তাবাদের পরিস্থিতিতে এমন এক
সম্প্রীতির বার্তাবাহক দৃশ্যের চরিত্রায়ন পরিচালক নন্দিতা দাসের মুন্সিয়ানার
পরিচায়ক।
শিল্পীর কোন দেশ হয় না,
মজহব হয় না, ধর্ম হয় না। তা আমরা জানি।কিন্তু এর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় বোধহয় থেকেই
যায়। তাই দেশভাগ যে কী করে একজন স্বনামধন্য লেখককে তিলে তিলে ধ্বংসের পথে নিয়ে
যেতে পারে তার অন্যতম উদাহরন মান্টো। শুধু কী দেশভাগ? একজন প্রথা ভাঙা, বাস্তববাদী
লেখকের কলমের স্বাধীনতা যখন লুন্ঠিত হয় তখন সেই লেখক ধীরে ধীরে আত্ম-ধ্বংসে
নিয়োজিত হন;হয়ে ওঠেন নিঃসঙ্গ পথিক। এই নিঃসঙ্গ যাপনের প্রতিটি ধাপ রয়েছে মান্টোতে।
সাদাত হাসান মান্টোর
আত্মমর্যাদা বোধ, তাঁর অকুতভয় মনোভাব, তাঁর স্পষ্ট এবং ছক ভাঙা নির্মম বাস্তববাদী
লেখনী শৈলী, তাঁর আত্মবেদনা, আজীবন দেশভাগ মেনে নিতে না পারা, তাঁর দোটানা,
দোলাচাল, অনিশ্চয়তা,পিতৃতান্ত্রিকতা,বোম্বের প্রতি দুর্বলতা, ধর্মীয়
অসহিষ্ণুতা,তাঁর মাদক আসক্তি,আর্থিক অনটন,আত্মবিলুপ্তির চেষ্টা, পুরনো বন্ধুদের
ফিরে পাওয়ার আর্তি, চল্লিশের দশক, অশোক কুমার, স্বাধীনতা,গান্ধী হত্যা,
"ঠান্ডা গোস্ত" সবই এই সিনেমার উপজীব্য বিষয় আর আছে
"হিপতাল্লা"রহস্য। সর্বপরি এক অভিমানী আত্মঘাতী বিতর্কিত গল্পকারের জীবন
ও কাজকে এক ঘন্টা সাতান্ন মিনিটে সেলুলয়েডের পর্দায় সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন
পরিচালক।
সাদাত হাসান মান্টোর
"ঠান্ডা গোস্ত" একটি বহু বিতর্কিত ও বহু সমালোচিত গল্প।দাঙ্গা বিধ্বস্ত
এক শিখ ঈশ্বর সিংহ মাঝরাতে তার স্ত্রী কুলবন্তকে(দিব্যা দত্তা) ছেড়ে লুটপাট করতে
বেড়িয়ে পরে। সাত সদস্য সমন্বিত এক মুসলিম পরিবারের ছয়জনকে হত্যা করে সপ্তম সদস্যা
একজন অপরূপ মেয়েকে ভোগ করার জন্য হত্যা না করে তুলে নিয়ে আসে। মাঝ রাস্তায় এসে এক
ঝোপের আড়ালে ঘাড় থেকে সেই মেয়েকে নামিয়ে সে আবিষ্কার করে এতক্ষণ যাকে সে বয়ে বেড়াচ্ছে
সে আসলে লাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। উষ্ণতার পিয়াসী দাঙ্গাবাজ চমকে যায় এক হাড় হিম করা
শিতল লাশ আবিষ্কার করে। দেশ ভাগ,হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা যে কী করে একটি জাতীকে ভিতরে
ভিতরে ক্ষত-বিক্ষত, পাশবিক করে তুলতে পারে তার মন্মান্তিক দলিল " ঠান্ডা
গোস্ত"।
তবে সিনেমাটা দেখতে হলে
একটু হোম ওয়ার্ক করে গেলে বোধহয় ভালো হয়। অর্থাৎ অন্যতম সেরা উর্দু লেখক ও তাঁর
গল্প সম্পর্কে ওয়াকিবহল থাকলে ছবি বুঝতে সুবিধে হয়। কারণ পরিচালক হঠাৎ হাঠাৎ
লেখকের গল্পগুলি পর্দায় তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ মান্টোর জীবন ও তাঁর কাহিনীগুলি
পরিচালক এক কোলাজে আনতে চেয়েছেন আয়োজনবিহীন এক ব্যতিক্রমী মুন্সিয়ানায়। যা একই
সঙ্গে ভালো লাগতে পারে আবার বুঝতে না পারলে খাপ ছাড়া কিংবা চিত্রনাট্যের দুর্বলতা
মনে হতে পারে।
চিত্রনাট্য,
নির্দেশন,সম্পাদনা এবং কার্তিক বিজয়-এর চিত্র গ্রহণ ও রীতা ঘোষের প্রোডাকশন ডিজাইন
প্রশংসাযোগ্য।ব্যাক গ্রাউন্ড স্কোরে জাকির হুসেন অনবদ্য। অভিনয়ে নওয়াজ উদ্দীনের
দক্ষতার কথা তো আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। মান্টোর স্ত্রী সাফিয়ার চরিত্রে
রসিকা দুগ্গল যথাযথ। ছোট্ট কয়েকটি চরিত্রে ঋষি কাপুর, পরেশ রাওয়াল, দিব্যা
দত্তা,ইলা অরুন, শশাঙ্ক আরোরা,গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স জাভেদ আকতার অসাধারণ।
No comments:
Post a Comment