ভারতের ফুটবল সাপ্লাই লাইনটা এইমূর্হুতে নর্থ-ইস্ট নির্ভর এটা আলাদা করে বলার আর প্রয়োজন নেই।মিজোরাম,মেঘালয়, সিকিম,মনিপুর,আসাম থেকে বহু উদীয়মান তরুন ছড়িয়ে রয়েছেন ভারতের বিভিন্ন প্রথমসারির ক্লাবে।কিন্তু ভারতবর্ষের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে থাকা এক অন্যতম রাজ্য নাগাল্যান্ডের ফুটবল কিন্তু আজও হতাশার অন্ধকারেই ডুবে আছে।পাশের মিজোরামে পাঁচটি,মনিপুর ও মেঘালয়ে প্রায় তিনটি করে উন্নতমানের টার্ফ স্টেডিয়াম থাকলেও নাগাল্যান্ডের ভাগ্যে এখনও শিঁকে ছেড়েনি।সবেধন নীলমনি ইন্দিরা গান্ধী স্টেডিয়ামের গায়েও রাজনীতির ছোঁয়া পড়ে যাওয়ায় তার প্রবেশদ্বারও প্রায় বন্ধ হতে বসেছে।নাগা কিংবদন্তী ডাক্তার-ফুটবলার তালিমেরান আও-এর শতবর্ষ উপলক্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বিশেষ প্রস্তাব দিয়ে পাঠিয়ে ছিলো নাগা কাউন্সিল গতবছর।স্টেডিয়ামের নাম বদল ছাড়া আর কোনো কিছুই মানতে রাজি হয়নি কেন্দ্রীয় সরকার।ক্ষোভ কমাতে আসাম রাইফেলসকে কাজে লাগানো হয়েছে মকোচুং জেলার অশোকা গ্রামে একটি স্টেডিয়াম নির্মাণের কাজে।নাগাল্যান্ডের মানুষ এই প্রতিশ্রুতির উপর ভরসা রাখতে পারছেনা কারন ২০১৬-এ "খেলো ইন্ডিয়া'-প্রজেক্টের অন্তর্ভুক্ত ১০০ টি ফুটবল মাঠের পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজই এখনও শুরু হয়নি যার মধ্যে ১০ টি ইন্ডোর সমেত আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম নতুন করে করার কথাও বলা আছে।বর্তমানে পেরেন জেলার জালুকিতে রাজ্য সরকারের পরিকল্পনায় একটি টার্ফ বানানোর প্রক্রিয়া হলেও তার ব্যবহার কতোটা ফলপ্রসূ হবে সন্দেহ আছে কারন রাজ্যের অধিকাংশ ফুটবলটাই এখন কোহিমা কেন্দ্রিক।উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে নাগাল্যান্ড ফুটবলের সর্বময় কর্তারাও হাল ছেড়ে বসে আছেন।যতদিন লিগ চলতো তার কোনো সম্প্রচার ছিলোনা,অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইটে তথ্য দেওয়ার কথা থাকলেও সেটার হালও ছিলো তথৈবচ।সবকিছু দেখার পরে ২০১৩ তে নাগাল্যান্ড প্রিমিয়ার লিগ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তারা।
আশ্চর্যের হলেও সত্যি এই নাগাল্যান্ডেরই অনুর্ধ্ব ১৪ ও ১৭ স্কুল দলগুলো সুব্রত কাপে বেশ কয়েকবারের বিজয়ী।কিন্তু সন্তোষ ট্রফির মূলপর্বে আসতে প্রায় প্রতিবারই ব্যর্থ।জুনিয়র দলে দুরন্ত খেলে আসা প্লেয়াররাই সিনিয়র দলে ব্যর্থ নিয়ম করে।বয়স ভাঁড়িয়ে ট্রফি জেতার আশায় মগ্ন দলগুলি পরবর্তী কালে আর এদের কোনো খোঁজই রাখেনা বলে একেবারে তৃনমুল স্তরেই ভবিষ্যৎ প্লেয়ার তুলে আনার প্রক্রিয়া গোড়াতেই বন্ধ।পাশাপাশি এই মুর্হুতে নাগাল্যান্ড ফুটবলের সবচেয়ে শক্তিশালী দলগুলোর একটা নাগাল্যান্ড পুলিশ রাজ্যের মধ্যেই ছোট ছোট টুর্নামেন্ট খেলে রাফ-এন্ড-টাফ ফুটবলে জিততে যতোটা আগ্রহী রাজ্যের বাইরে আমন্ত্রনী ফুটবলে ততোটা উৎসাহী নয়।
তাই নাগা ছেলেদের বাইরের রাজ্যের ক্লাবগুলির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে নিজেদের শক্তি-দুর্বলতা যাচাই করার কোনো উপায়ও নেই।
নাগাল্যান্ড ফুটবলের পিছিয়ে থাকার আরো একটা বড় কারন কোনো লিগ না থাকা।স্পনসরদের আগ্রহের অভাবে বহুদিন আগেই বন্ধ হয়েছে প্রিমিয়ার লিগ। ২০১১ সালে শুরু করে ২০১৩ সালে শেষবারের মতো নাগাল্যান্ড প্রিমিয়ার লিগ অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে নানাবিধ কারনে তা আজও বন্ধ।বর্তমানে যদিও কিছু উৎসাহী মানুষের উদ্যোগে শুরু হয়েছে কোহিমা প্রিমিয়ার লিগ যার অধিকাংশ খেলাই হয় কর্দমাক্ত, অসমান মাঠে।ফুটবল দলগুলি অধিকাংশ চলতো রাজনীতিবিদ ও বিভিন্ন ঠিকাদারদের মদতে।লিগ বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেই এদের অনেকেরই ফুটবল থেকে আগ্রহ সরে গেছে বহুদিন আগেই।
ভাবতেও অবাক লাগে এই নাগাল্যান্ডের মাটি থেকেই উঠে আসা টি আও লন্ডন অলিম্পিকে ভারতের জাতীয় দলের নেতৃত্বে ছিলেন।দীর্ঘসময়ের খরা কাটিয়ে এই সেদিন উত্থান হয়েছে ভারতীয় ফুটবলের নবতম নক্ষত্র ও নাগাল্যান্ডের ইতিহাসে প্রথম আইএসএল খেলা ফুটবলার কিভি ঝিমোমির।গতবছর গোকুলমের হয়ে ভালো খেলার পর এবছর আইএসএলে নাগাল্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করতে নর্থ-ইস্ট ইউনাইটেডে যোগ দিয়েছেন তিনি।ছোটবেলায় মার্শাল আর্টসে রাজ্যের হয়ে মেডেল জেতা কিভির ফুটবলে আসা বাবার ফুটবলপ্রেম দেখে।ডিমাপুর ফুটবল অ্যাকাডেমির কোচ মুগতো আয়ের কাছে ট্রেনিং করা থেকে মহামেডান, রাংজাদিয়েদ হয়ে গতবছর গোকুলমে পা রাখা পর্যন্ত সময়টা অনেক কঠিন লড়াই লড়তে হয়েছে তাকে।কদিন আগেই জাতীয় অনুর্ধ্ব ২৩ দলের ক্যাম্পে ডাক পাওয়া ফুটবলারের মতে এই মুহূর্তে নাগাল্যান্ড ফুটবলকে বাঁচাতে হলে হোম-অ্যাওয়ে ভিত্তিতে লিগ ও প্রতি জেলায় টিম ও স্টেডিয়াম সুনিশ্চিত করতে হবে।একান্তই সেটা সম্ভব নাহলে কোহিমা-নির্ভর লিগ করে গোটা নাগাল্যান্ডের প্রতিটা জেলায় একটি দল তুলে আনতে হবে ও প্রতিটি দলের সাথে জুড়তে হবে ফুটবলে আগ্রহী স্পনসরদের।পাশাপাশি প্লেয়ারদেরও পেশাদারী মনোভাব বজায় রাখতে হবে।বর্তমানে নাগাল্যান্ডের প্লেয়াররা বছরে তিনমাস ক্লাসিক কাপ,এন এস এফ স্মৃতি টুর্নামেন্ট ,রয়্যাল গোল্ড কাপের মতো টুর্নামেন্ট খেলে বাকি সময়টা অন্যান্য কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেন।লিগ বন্ধ থাকায় এখান থেকে দ্বিতীয় ডিভিশন আইলিগ খেলার কোনো সুযোগ থাকেনা।তাই তাদের উচিত পাশের ফুটবলে এগিয়ে যাওয়া রাজ্যগুলির দিকে পা বাড়ানো।পাশের রাজ্য মিজোরাম, মনিপুরের ছেলেরা যখন কোলকাতায় সামান্য পাঁচ-ছয় টাকার জন্য ছোট ছোট ক্লাবে খেলতে চলে এসে দাঁতে দাঁত চেপে লড়তে থাকে তখন নাগাল্যান্ডের ফুটবলারদের একটা বড় অংশ নিজেদের রাজ্যের বাইরে পা বাড়াতে এখনও আগ্রহী নয়।অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সাথে লড়াই করে এখনও পেশাদার ফুটবলার হওয়ার চ্যালেঞ্জটা নেওয়ার মতো সাহসটা এখনও নিয়ে উঠতে পারেননি তারা।
তাই এতোবছরের ব্যবধানে আইজলে খেলা কুয়েথেলি থোপি ,চার্চিলের জেমস কিথান,ভিসাইল মেজু ,লাজংয়ের নেইথোভিল চালিউ ও গোকুলমের কিভি ঝিমোমির মতো কয়েকজন ছাড়া ভারতীয় ফুটবলের মানচিত্রে নাগাল্যান্ডের কোনো চিহ্নমাত্র নেই।টি আও আজ বেঁচে থাকলে নিজের রাজ্যের এই হাল দেখলে সত্যিই কষ্ট পেতেন।মেঘালয়, মিজোরাম, মনিপুর যেখানে ভারতের বিভিন্ন ক্লাবে ফুটবলার সাপ্লাই করার পরেও নিজেদের ক্লাব তৈরি করে রীতিমতো যোগ্যতাঅর্জনের মাধ্যমে আইলিগ খেলছে সেখানে নাগাল্যান্ড টিমটিম করে বেঁচে আছে কোনোভাবে।খুব তাড়াতাড়ি নাগাল্যান্ড প্রিমিয়ার লিগ আবার চালু হলে ভারতীয় ফুটবল কিভিদের মতো আরও নতুন প্রতিভাকে পাবে এই কামনাতেই আপাতত বুক বাঁধা ছাড়া আর কোন গতি নেই।
No comments:
Post a Comment