ব্লগ-টগ

প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশের ঘরোয়া সূত্র

Post Page Advertisement [Top]

To Place your advertisement here call - +917980316633/+918145704098

রাতজাগাটা আজকাল অভ‍্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রুতিলীনার।রাত দুটো-তিনটে বেজে যায়।ওর তা-ও ঘুম আসে না।চুপ করে কানে হেডফোন গুঁজে শুয়ে থাকে। রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে ফোক সঙ্গীত,লতা মঙ্গেশকর থেকে অরিজিৎ সিং,পিঙ্ক ফ্লয়েড থেকে এমিনেম...প্লে লিস্টের একটার পর একটা গানের সুর-তাল-লয় কান থেকে সোজা মন ছুঁয়ে চোখে এসে জড়ো হতে হতে একসময় চোখের পাতা ভারী হয়ে ঘুম নেমে আসে ভোরের দিকে।

আচ্ছা, বাবার কি সত‍্যি এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার দরকার ছিল?
আরেকটু থেকে গেলে হত না?
আরেকটু...

যতক্ষণ না বাবার বুকে মাথা রেখে আদর খেতে খেতে ঘুমিয়ে পরছিল শ্রুতি, যতক্ষণ না বাবার কাছে বকুনি খেয়ে বাচ্চাদের মতো ভ‍্যাঁ করে কেঁদে ফেলছিল,যতক্ষণ না মেসি ভালো খেলে নাকি রোনাল্ডো,বাবার সঙ্গে এই চিরকালীন বিতর্কটার রেজাল্ট পাওয়া যাচ্ছিল একটা,যতক্ষণ না বাবাকে ফোনে সেলফি তোলা শেখাতে পারছিল,যতক্ষণ না বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে নিজের সব কষ্টগুলো বাবাকে শোনাতে পারছিল,যতক্ষণ না বাবার সঙ্গে কালীপুজোয় বোমা ফাটানোর কম্পিটিশনে জিতে যাচ্ছিল,যতক্ষণ না বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে প্রাণভরে আদর করে নিচ্ছিল.....যতক্ষণ না বাবাকে হৃদয়ের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে ভালোবেসে নিচ্ছিল শ্রুতি...ততক্ষণ পর্যন্ত বাবাটাকে আঁকড়ে ধরে নিজের কাছে রেখে দেওয়া যেত না?

চেষ্টা তো করেছিল সে।অ্যাম্বুলেন্সে বাবার হাতদুটো ধরে বলেছিল 'বাবা!আরেকটুখানি!আরেকটু জোরে নিঃশ্বাস নাও!এই তো এসে গেছি!'

কিন্তু হসপিটালে নিয়ে যেতে যেতেই....

বাবাও চলে যেতে চায়নি।একদম চায়নি।
এমন মেয়েপাগল বাবা আর বাবাপাগলী মেয়ে..কোনোদিন একে অপরকে ছেড়ে যেতে চায়?
সেদিন যখন তুলি মাসি বাবার ফটোতে ফুলের মালা দিতে এসেছিল, মালাটা টান মেরে ফেলে দিয়েছিল শ্রুতি। ওসব তো মরা মানুষের ফটোতে দেয়।

যে লোকটা শ্রুতির ঘুম না এলে তার মাথার কাছে এসে বসে আগের মতোই,মাথায় পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ঘুমপাড়ানি গান শোনায় আগের মতোই,শ্রুতি জানে আদতে যার ফলেই নিদ্রাহীন চোখে ঝপ করে নেমে আসে একরাশ ঘুম,ওসব প্লে লিস্টের গান-টান কিচ্ছু না,তার ফটোতে কি মালা ঝোলানো যায়?

সব সময় কি ভালোবাসাতে গেলে শরীর নিয়েই হাজির থাকতে হবে?
মনটা কিচ্ছু না?
বাবাকে বুকের ভেতর অনুভব করাটা কিচ্ছু না?
হেডফোনটা খুলে রেখে বাবার ফটোর দিকে তাকায় শ্রুতি।

-'বাবা! ও বাবা! শোনো না! শুনছো তো? আমার কষ্ট হচ্ছে খুব!'
মৃদু গলায় বলে সে।
তারপর কান্নাভেজা চোখদুটো বন্ধ করে নেয়।চোখের জলটা গাল বেয়ে গড়িয়ে পরার আগেই মুছে নেয় হাতের চেটো দিয়ে।

সেবার যখন স্কুলে বসে আঁকো প্রতিযোগিতায় আঁকতে বসে কিছুই মাথায় আসছিল না শ্রুতির, ফলে সাদা কাগজ জমা দিয়ে চলে এসেছিল, বাড়ি এসে সে কী কান্না তার!

-'ও বাবা!সবাই তো পারল!আমি কেন পারলাম না!'
বাবা বলেছিল 'পরে বলছি। আগে একটু নেচে দেখা তো মা!'
বলেই টেপরেকর্ডারে 'জল তরঙ্গে ঝিলমিল ঝিলমিল, ঢেউ তুলে সে যায়' গানটা চালিয়ে দিয়েছিল।গানের সুরে মুহুর্তে কান্না থামিয়ে ছোট্ট ছোট্ট হাত ঘুরিয়ে সুন্দর করে নাচতে শুরু করেছিল শ্রুতি।নাচ শেষ হতে বাবা শ্রুতিকে কাছে টেনে কোলে বসিয়ে বলেছিল, 'পারলি তো?'

-'কিন্তু বাবা এটা তো নাচ!আমি তো আঁকতে পারিনি!'
-'তো?নাচ তো কী!!তুই এটাই ভালো পারিস।যারা আঁকতে পারে ভালো, হয়তো তারা নাচতে পারে না।ভগবান তো সবাইকে আলাদা আলাদা গুণ দিয়ে পাঠিয়েছেন।কেউ এটা ভালো পারে, তো কেউ ওটা!না হলে সব মানুষের একই গুণ থাকলে মজা হত বল?'

পায়ে পায়ে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে টেবিলে সাজিয়ে রাখা ট্রফিটা হাতে তুলে নেয় শ্রুতি। 'নৃত‍্যকলা' গ্রুপের হয়ে স্টেট লেভেলের কম্পিটিশনে জিতেছে সে এই ট্রফিটা।

যেদিন বাবাকে চুল্লিতে ঢুকে যেতে দেখছিল,বাবার পায়ের কাছে দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছিল আগুনের লেলিহান শিখা,চুল্লির দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে বাবার মুখটা শেষবার দেখার জন‍্য কান্না ভুলে ফ‍্যালফ‍্যাল করে তাকিয়েছিল শ্রুতি...ঠিক তার দু দিন পরে ছিল কম্পিটিশনটা।

'আমি কিন্তু তোকে কোনোদিন কাঁদতে শেখাইনি মা।কাঁদলে পরে সব শক্তিটুকু ধুয়ে যায় আমাদের!'
মাস্টার্সের শেষ বছরে নীলাঞ্জনের সঙ্গে ব্রেক আপের পর কোনো এক রাতে বাবার কোলে মাথা রেখে খুব কেঁদেছিল শ্রুতি।মেয়ের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে কথাটা বলেছিল বাবা।

আত্মীয়-স্বজনরা আড়ালে বলেছিল 'দু দিন আগে বাবা চলে গেল! মেয়ে এখন নাচতে যাচ্ছে! আহ্লাদ দেখো!'

শ্রুতি চুপ করেছিল।ওরা কিভাবে জানবে গত দু রাত না ঘুমিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদার পর কোথা থেকে এত শক্তি পেল বাবাপাগলী মেয়েটা এই অবস্থায় কম্পিটিশনে যাওয়ার!

কম্পিটিশন থেকে নাম তুলে নেওয়ার জন‍্য স‍্যারকে ফোন করবে বলে মোবাইলটা হাতে নিতেই বাবার মুখটা ভেসে উঠেছিল চোখের সামনে। যেন বড্ড দুঃখ পেয়েছে মানুষটা। মেয়েটা হেরে যাচ্ছে এভাবে?
এরপরও শ্রুতি যদি কম্পিটিশন থেকে পালিয়ে গিয়ে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকত,বাবাটা সত‍্যিই হেরে যেত সেদিন।প্রত‍্যেকটা ডান্স কম্পিটিশনের আগে পায়ে ঘুঙুরটা বাবাই বেঁধে দিত।এবার একলা একলা বাঁধতে গিয়ে বুকের ভেতরে আছাড়িপিছাড়ি কান্নারা জমা হচ্ছিল শ্রুতির।কিন্তু ওদের যে বইতে দেওয়া যাবে না! দাঁতে দাঁত চেপে বাবার মুখটা মনে করে স্টেজে উঠেছিল সে।

গ্রুপের সবাই বলেছিল এত সুন্দর নাচ এর আগে কোনোদিন নাচেনি শ্রুতি।

ট্রফিটা আবার টেবিলে রেখে দিয়ে জানলার পাশে এসে দাঁড়ায় সে।জানলার ঠিক নিচটাতে ঝাঁকড়া শিউলি ফুলের গাছ।ফুলে ফুলে সাদা হয়ে আছে গাছটা।বাবার খুব প্রিয় ফুল শিউলি।

'তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম'

বাবার প্রিয় গানটা গুণগুণ করে গাইতে গাইতে জানলার ধার ঘেঁষে বসে সে।বাবা বলত কখনো যদি খুব কান্না পায় চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে।আকাশ তার বিশাল ব‍্যাপ্তি দিয়ে সব দুঃখকে শোষণ করে নেয়।

তারাভরা ঝিলমিল আকাশের দিকে অপলকে তাকিয়ে থাকে শ্রুতি।বাবা-মেয়ের এমন নাড়ির টানের কষ্ট শোষণ করে নেওয়ার ক্ষমতা কি আছে এই আকাশের! কে জানে....

দেওয়ালের ফটোটা থেকে বাবা তখন বুকভরা মমতা নিয়ে চেয়ে আছেন মেয়েটার দিকে।মেয়েটা আমার ভেঙে পরছে না তো!
যতবার চোখে জল আসে,বাবার কথা ভেবে জলটা মুছে নেয় শ্রুতি।তারপর বাবার ফটোটার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, 'না বাবা।মেয়ে একদম ভেঙে পরছে না।'

কথাটা বলার পর ফটোর ভেতরে বাবার স্মিত হাসিটা শ্রুতি ছাড়া আর কেউ দেখতে পায় না।কেউ না।

No comments:

Post a Comment

Bottom Ad [Post Page]

To Place your advertisement here call - +917980316633/+918145704098