-'ওরে মাহ্!
কি জোরে কামড়ে দিল কানে! অ্যাই হতচ্ছাড়ি মেয়ে! সর!' হাঁউমাউ
করে উঠল ঈশান!
-'কতভাবে
তোর ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করলাম। কত বাবা বাছা করলাম!উঠলিই না! তাই এটা ছাড়া আর কোনো
রাস্তা ছিল না!' চোখেমুখে একরাশ দুষ্টুমি নিয়ে বলে উঠল
পূর্ণা।
'তবে
রে!' বলেই পূর্ণাকে জোর করে বিছানায় টেনে নিয়ে ঠোঁটের কাছে
ঠোঁট নিয়ে এসে ফিসফিস করে বলল ঈশান 'মা জানে তার লক্ষ্মী
বউটা মাঝে মাঝে এমন রাক্ষসী হয়ে ওঠে??'
-'ছাড়
ছাড়! কত কাজ বাইরে! লক্ষ্মী পুজোর বাসনগুলো এখনো বের করা হয়নি! মা বকবে!' ছটফটিয়ে ওঠে পূর্ণা।কিন্তু ঈশানের ভারে নড়তে চড়তে পারে না বিশেষ!
-'বাবা
ঈশান! দয়া করে পাঞ্জাবিটা পাল্টে এসো!'
-'কেন
মা! পাল্টাব কেন! ভালোই তো এটা!'
মায়ের মুখ টিপে
হাসি দেখেই পূর্ণার কেমন সন্দেহ হল।ঈশানের দিকে তাকাতেই তার চক্ষু চড়কগাছ! ও মা
কেমন ভোঁদর ছেলে দেখো!!একটু আগে শাড়ি পরার সময় পূর্ণাকে জ্বালাতন করতে গিয়ে
ধাক্কাধাক্কিতে পূর্ণার সিঁথির সিঁদুরের গাঢ় দাগ লেগে গেছে ঈশানের পাঞ্জাবিতে একদম
বুকের কাছটায়।আর হনুমানটা ওটা পরেই ঘর ভর্তি লোকের সামনে এসে হাজির! লজ্জায় মাটিতে
মিশে যায় পূর্ণা।ঈশান ফ্যালফ্যাল করে এর ওর দিকে তাকাতে তাকাতে যতক্ষণে ব্যাপারটা
বুঝতে পারল, ততক্ষণে সারাঘরে মা-বৌদি-কাকিমাদের মধ্যে চাপা
হাসি ছড়িয়ে পড়েছে।একদৌড়ে ঘরে পালাল ঈশান।আর সারাঘরে হাসির ঝড় উঠল।সবার মাঝে
কাঁচুমাচু মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল পূর্ণা।
-'বৌমা
নাড়ুর থালাটা এদিকে এগিয়ে দাও তো! আর মুড়ির মোয়ার প্যাকেটগুলো কোথায়?'
শশা কাটতে কাটতে
বললেন ইন্দ্রানী।
পূর্ণা থালায়
প্রদীপ সাজাতে সাজাতে বলল, 'মা তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করো।ও মোয়ার প্যাকেটগুলোর
আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল!তারপর থেকে আর প্যাকেটগুলো পাওয়া যাচ্ছে না!!'
-'অ্যাই
অ্যাই! আমার নামে দোষ দিচ্ছিস কেন? আমি খাইনি একটাও মোয়া।'
বলে ওঠে ঈশান।
-'উফ
তোরা ঝগড়া করা থামাবি! দেখছি আমি কোথায় আছে প্যাকেটগুলো!' ইন্দ্রানী
গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে চলে গেলেন।
বিকেলে লাল জামদানী
শাড়ি,মায়ের দেওয়া সোনার দুল-চেন আর লাল সিঁদুর-টিপে পূর্ণার দিক থেকে চোখ
ফেরাতে পারছিল না ঈশান।পুজোর সময় সবাই তাকিয়ে মা লক্ষ্মীর দিকে আর ঈশান.. পূর্ণার
দিকে।পূর্ণা দু তিনবার চোখ পাকিয়ে ঠাকুরের দিকে তাকানোর ইশারা করল।ঈশান ফিসফিস করে
বলল 'আমার মা লক্ষ্মী যেদিকে আমি তো সেদিকেই তাকাব।কিন্তু ব্যাপারটা
হল কালীপুজোর দিন-ও আমি তোর দিকেই তাকাব! মাঝে মাঝে যেভাবে রক্ষেকালী হয়ে যাস!!'
পূর্ণার কনুইয়ের গুঁতোতে ঈশান 'উফ্' করে উঠতেই সবাই পিছন ফিরে ওদের দিকে আড়চোখে তাকাল একবার।পুরোহিত মশাই আর
মায়ের কটমট দৃষ্টির সামনে দুটিতে তখন মুঠোয় ফুল নিয়ে চোখ বন্ধ করে লক্ষ্মী
ছেলেমেয়ের মতো অঞ্জলি দিতে ব্যস্ত।
যেন কিছুই জানে
না!!
-'খিচুড়িটা
কিন্তু দারুণ! এত সুন্দর ভোগের খিচুড়ি আগে খাইনি মাসিমা!' বেগুনভাজাটা
মুখে ঢুকিয়ে বললেন সামনের ফ্ল্যাটের ঘোষগিন্নি।
-'হ্যাঁ
আমার বৌমা রেঁধেছে।এমন হাতের জাদু ওর-ই আছে খালি!' সবাইকে
খাবার দিতে ব্যস্ত পূর্ণার দিকে গর্বভরে তাকিয়ে বলেন ইন্দ্রাণী।
-'আচ্ছা
একটা কথা জিজ্ঞেস করব ইন্দ্রানীদি? যদি কিছু মনে না করেন?'
পাশ থেকে বললেন আরেকজন প্রতিবেশী মহিলা,হালদার
গিন্নি।
-'বলুন'
-'পূর্ণার
তো..মানে বছর তিনেক আগে রেপের ঘটনাটা..মানে তারপরেও ওকে বউ করে ঘরে তোলা..আপনি
মেনে নিলেন? মানে অনেকেই এমন মেয়েকে..'
-'এমন
মেয়ে বলতে?'
-'না
মানে এমন ধর্ষিতা মেয়েকে..এভাবে ঘরের বউ করে আনাটা...'
ইন্দ্রানী একটু চুপ
করে থাকলেন।তারপর বললেন, 'হুমম ঠিকই বলেছেন।এমন মেয়েকে ঘরের বউ করে আনাটা
মানায় না।তাই তো ওকে আমার মেয়ে করে এনেছি।'
-'সেটা
আপনার বড়ো মন। কিন্তু এমন রেপড মেয়ের সঙ্গে আমরা তো বাবা ছেলের বিয়ে দেওয়ার কথা
ভাবতেও পারি না!'
-'সেটাই
তো সমস্যা, বুঝলেন কিনা হালদার গিন্নি! আপনার জামাই
শুনেছিলাম গতবছর ঘুষ খেতে গিয়ে ইনকাম ট্যাক্সে ফাঁকি দিয়ে ধরা পরে জেলে গেছিল।তা
ও কি এখনো আপনার জামাই আছে? না ডিভোর্স করিয়ে দিয়েছেন মেয়েকে?'
জিজ্ঞেস করেন
ইন্দ্রানী।
-'না
মানে ওই ব্যাপারটা আর রেপ ব্যাপারটা কি এক হল?'
-'না!
একদমই এক নয়।তাই তো পূর্ণার অপরাধীরা যাবজ্জীবন জেল খাটছে আর আপনার জামাই একবছরেই
ছাড়া পেয়ে গেছে।যদিও চাকরিটা খুইয়েছে।যাই হোক! আচ্ছা,ট্রামে-বাসে-ট্রেনে
ভিড়ের মধ্যে কোনো লোক অসভ্যতা করেছে আপনার সঙ্গে?'
-'বাবা!
আর বলবেন না! যা অসভ্যতা করে লোকগুলো! ঘরে বউ-বাচ্চা আছে সে খেয়াল থাকে না!'
ঠোঁট উল্টিয়ে বলেন হালদার গিন্নি।
-'হুমম।এদের
মধ্যেই কেউ পরবর্তী কালে এক-একজন রেপিস্ট হয়।তা এদের কি তাহলে বউ-বাচ্চা নিয়ে ঘর
সংসার করার অধিকার আছে? যেমন আপনাদের মতে রেপড মেয়েদের বিয়ে
করার অধিকার নেই।কিন্তু ব্যাপারটা কি বলুন তো, আমাদের দেশে
মলেস্টার-রেপিস্টদের বিয়ে হয়,বউ-বাচ্চা হয়,কিন্তু রেপড মেয়েদের মানুষ বলে মনে করা হয় না।যারা মুখে অ্যাসিড ছুঁড়েছে
তারা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, যে মেয়েটার মুখটা ঝলসে গেল,
ঘরে লুকিয়ে থাকে সে।এমন সমাজে থাকতে থাকতে কি আমরাও অমানুষ হয়ে
যাচ্ছি হালদার গিন্নি?'
-'ইন্দ্রানীদি!
আমার কথাটা খারাপ ভাবে নেবেন না! আসলে এমন দেখি না তো! তাই..' আমতা আমতা করে বলেন হালদার গিন্নি।
-'জানেন
তো,এত কথা বলতাম না।পূর্ণাই একদিন বলেছিল, মা এখন আমি সবাইকে জবাবদিহি করা বন্ধ করে দিয়েছি।আমার সাথে যা হয়েছিল তার
কষ্টটাও আমি সহ্য করেছি,দাঁতে দাঁত চেপে পরবর্তী লড়াইটাও
আমিই লড়েছি।বাকিদের কোনো অধিকার নেই আমাকে একটাও প্রশ্ন করার।কিছু জিজ্ঞেস করতে
হলে জেলে গিয়ে ঐ অমানুষগুলোকে প্রশ্ন করুক।জবাব দেওয়ার দায় ওদের, আমার নয়। কিন্তু তবুও হালদার গিন্নি আজ আপনাকে এতগুলো কথা বললাম একটাই
কারণে, পূর্ণার চেয়ে ভালো বউ আমার ঈশান আর পেত না।না,পূর্ণার সঙ্গে ঐ ঘটনাটা ঘটেছে বলে দয়ার সুরে বলছি না কিন্তু! কারণ পূর্ণার
মধ্যে যে জেদ বা যে শক্তিটা আমি দেখেছি তা অনেক মেয়ের মধ্যেই দেখতে পাইনি।শুধু কি
লক্ষ্মী হলেই চলে? দরকার পরলে দুর্গা বা কালী হতেও তো জানতে
হবে!'
এতদূর বলে থামলেন
ইন্দ্রানী।তারপর স্মিত হেসে তাকালেন পূর্ণার দিকে।ঈশানের সঙ্গে মিলে সবাইকে পায়েস
দিতে দিতে মায়ের চোখে চোখ পরতেই একগাল হেসে দিল পূর্ণা।
'সোনা
মেয়ে আমার'
মনে মনে বিড়বিড়
করলেন ইন্দ্রানী।
বাইরে কোজাগরী
চাঁদের আলোয় ভগবানের সবটুকু আশীর্বাদ যেন তখন ঝরে পরছে ঈশান আর পূর্ণার উপরে।
No comments:
Post a Comment