ব্লগ-টগ

প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশের ঘরোয়া সূত্র

Post Page Advertisement [Top]

To Place your advertisement here call - +917980316633/+918145704098
 


ইছামতির তীরে প্রাচীন জনপদ টাকি। বর্তমানে মিউনিসিপ্যাল শহর আর তাও তৈরি হয় প্রায় দেড়শো বছর আগে, ১৮৬৯ সালে। রাজা প্রতাপাদিত্যের বংশধর কৃষ্ণদাস রায়চৌধুরী টাকিতে বসতি স্থাপন করেছিলেন আর তাঁর উদ্যোগেই  টাকিতে সম্ভ্রান্ত,শিক্ষিত বহু পরিবারের বসবাস আরম্ভ। ইতিহাস বলে রাজা মানসিংহ প্রতাপাদিত্যের সাম্রাজ্যে আক্রমণ শানানোর জন্য টাকিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। দু’পক্ষের লড়াই হয় বসিরহাটের সংগ্রামপুরে। প্রতাপাদিত্যের সৈন্যদলকে তাড়া করে নিয়ে যায় মানসিংহের বাহিনী। ইছামতী পার হয়ে রক্ষা পায় প্রতাপাদিত্যের দলবল। সেই পুরোনো ইতিহাসকে মনে রেখেই টাকি শ্মশান-সংলগ্ন রাস্তার নাম  রাখা হয় মানসিংহ রোড। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে টাকিতে কুলেশ্বরী কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা হয়,আজও তা দর্শনীয়। এছাড়াও টাকির সরকারি বিদ্যালয়,কলেজ, ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরী,রামকৃষ্ণ মিশন সবই শতাব্দী প্রাচীন। 
দেশ ভাগের আগে রায় চৌধুরীরা তখন জমিদার,নদী পেরিয়ে দৈনন্দিন যাতায়াত ছিল মানুষের। শিক্ষা-জীবিকা-চিকিৎসার প্রয়োজনে ওপারের মানুষ আসত এপাড়ে। দেশভাগ হয়ে গেল। ওপারের মানুষ হয়ে গেল ভীনদেশি। তবু বয়ে চলা ইছামতী থেকে গেল ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। আজও  সকাল বেলায় আকাশ রাঙিয়ে সূর্য উঠে। রোদের সোনা গুলে যায় নদীর জলে। রোদে ভেজা জল ছলাৎ,ছলাৎ ঢেউ তোলে। সময় পিছলে চলে। রুপোলী পার্শের ঝাঁক বেলা বাড়তেই নদীর বুকে ঝিলমিলিয়ে উঠে। ওপারে অন্য দেশ। তারাও বাঙলায় গান গায়,বাঙলার গান গায়। নদীর পাড়ে কেওড়া গাছের পাতায় নোনা বাতাস ভাঁটিয়ালির সুর তোলে। নদীর বুকে টহল দেয় সীমান্তরক্ষীদের স্পীড বোট। সীমান্ত বিভাজিকা,দেশভাগের ক্ষত চিহ্ন হয়ে রয়ে যায় নদীর শরীরে। 


দুপাড়ের দিনযাপনের গন্ধ মিলেমিশে যায় নদীতে আর তাই ঢেউ ওঠে। দুঃখ,ব্যথার চরা জেগে ওঠে। পলিজমা পাড়ে মাথা উঁচিয়ে থাকে বিসর্জনের কাঠামো,আর তাতে ওঁত পেতে থাকে মাছরাঙা। সাঁঝবাতির রূপকথা যখন পশ্চিম আকাশে মলাট খোলে, আনন্দরক্ত ফিনকি দিয়ে মেঘে মেঘে লাল হয়ে যায়,ইছামতীর বুকে সন্ধ্যা নামে। শিরশিরে হাওয়া বয়। ঢলঢল শশধর ঝুলে থাকে নদীর কাছে,এক চুম্বন দূরত্বে। সারাদিনের বয়ে চলার গল্প, ইচ্ছাপূরনের ইস্তেহার হয়ে ফিরে আসে রাতপড়শির পাড়ায় পাড়ায়। হিয়া টুপটুপ জিয়া নস্টাল ভরে কোন বৈরিতা থাকেনা। থাকেনা কাঁটাতারের নিষেধ। চেনা মন পানসি বেয়ে চলে অমরাবতীর পথে। আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাচজনা,আমাদের সেই নদীর নামটি ইছামতী। 


এই ইছামতী পাড়ের আর এক ঐতিহ্য নদীতে দুর্গার বিসর্জন। বরাবরই টাকির পুজোয় বনেদিআনার ছোঁয়া থাকে। জমিদার আমলে জাকজমক করে পুজো হত। বলি হত। ধুমধাম করে বিসর্জন হত নদীতে। ওপারের বাঙালীরাও সামিল হতেন সেই উৎসবে। পার্টিশানের পর রাজনৈতিক আর রাষ্ট্রীর নিরাপত্তার কারনে সীমান্ত টপকে যাতায়াত বন্ধ হলেও,বিজয়া দশমীতে সে নিষেধ থাকতো না। মিলে যেত দুই বাংলা। সে এক মিলনোৎসব বটে। প্রথা মেনে টাকির পুববাড়ির প্রতিমা নিরঞ্জন হত সবার আগে তারপর আর সব বাড়ি বা বারোয়ারি পুজোর বিসর্জন হত ইছামতীতে। এপারের মানুষ ওপারে নামত। মিষ্টি মুখ, শুভেচ্ছা বিনিময় চলত। নৌকায় ভেসে সন্ধ্যের ইছামতীতে এই একদিনের জন্য দেশভাগের যন্ত্রণা ভুলে যেত দুই বাংলার পড়শীরা। 



২০১০ সালের পর ছবিটা পালটাতে থাকে। উৎসবের সুযোগে প্রচুর বেআইনি অনুপ্রবেশ রুখতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। দুই বাংলার মিলনে অনেক শর্ত, যদি, কিন্তু আরোপিত হয়। ততদিনে লোকমুখে ছড়িয়েছে এই অভিনব বিসর্জনের গল্প। তাই বিজয়ার দিন বিকেলে নদীর পাড়ে ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা হয়। এবার আবার খুলেছে দরজা। দুই দেশ আবার মিশে যাবে উমার চলে যাওয়াকে সাক্ষী রেখে। তাই ভীড় ছিল উপছে ওঠা। দুপুর গড়াতে না গড়াতেই নদীর দুই ধারেই জমেছে মানুষ। বিডিআর আর বিএসএফের টহল দেওয়া স্পিড বোটের সাথে তিরঙ্গা শোভিত এ বাঙলার নৌকার মতন,ওপারের লাল সবুজ পতাকা ওড়ানো নৌকায় ক্রমে ভরেছে নদী। নদীতে প্রদক্ষিণ শেষে নিরঞ্জণ হয়েছে প্রতিমার। বাজির আলোয় ঝলমল করেছে নদীর জল। সব শেষে আসছে বছরের অপেক্ষা মনে ভরে দিন ঢলেছে। ইছামতীর আকাশে তখন দশমীর চাঁদ।





Photography: Riddhiman Bhattachryya

No comments:

Post a Comment

Bottom Ad [Post Page]

To Place your advertisement here call - +917980316633/+918145704098