১৯৮৫ সালের ভোপাল গ্যাস
দুর্ঘটনার রেশ তখনো মোছেনি মানুষের মন থেকে। বিশ্বজুড়ে চরম অর্থনৈতিক মন্দা,
রাজনৈতিক অরাজকতা মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। এর মধ্যেই এল ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর। ১৯৮৬
বিশ্বকাপ। তৃতীয় বিশ্বের এক উন্নয়নশীল দেশ পেলে-গ্যারিঞ্চাতে মাতোয়ারা তখনও।
টর্নেডোর মতো শুধুমাত্র
একজন বদলে দিলেন গোটা বিশ্বের ভালোবাসার সংজ্ঞা। সারা বিশ্ব লাতিন আমেরিকার আরো এক
গরিব দেশকে ভালোবেসে ফেললেন অজান্তেই। শুধুমাত্র তার ফুটবল মাদকতার প্রেমে পড়ে।
দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা।মাথার উপর নীল আকাশে স্বপ্নে দেখা দেশটাই তার দেশ। তার
ধর্ম। তার আর্জেন্টিনা।
মাইথোলজি বলে, মানুষের
ব্রাইট সাইড যেমন থাকে, তেমনি থাকে ডার্ক সাইডও। তাই ড্রাগ অ্যাডিক্ট নেশাখোর
দিয়েগোকেও অনেকে সমালোচনায় বিদ্ধ করেন, কিন্ত তার ফুটবল জাত নিয়ে প্রশ্ন তোলার
সাহস পায়না কেউ। কারণ তিনি শক্তির বিরুদ্ধে শিল্পীর বাহক।
তিনি যুদ্ধকামানের
বুলেটের সামনে গিলোটিনে মোড়া এক আস্ত চাবুক। তিনি ডেমনের দেশে সৌন্দর্যের বাণীতে
দোলা প্রেমের দূত। তিনি নজরুলের বিদ্রোহের আগুনে রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিসিজম।
তিনি খেতে ভুলে যাওয়া
৮৬ এর মেক্সিকোতে সবুজ গালিচায় মোড়া এক আস্ত কাব্যগ্রন্থ। আজও যিনি ব্যর্থ
প্রেমিকের মনে শুধু ইউটিউবেই সন্ধ্যার নিকোটিন হিসেবে আগুন জ্বালেন।
তিনিই মারাদোনা। দিয়েগো
আর্মান্দো মারাদোনা। জাত শিল্পী। পৃথিবীতে যুগে যুগে এমন কয়েকজনকে ঈশ্বর দেবদূত
হিসেবে পাঠান, যারা দেশ-কাল-যুগ-সীমানার উর্ধ্বে উঠে মানুষের। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের।
পেলে, মারাদোনা, মেসিরা তেমনই।
তবু যুগে যুগে কিছু কীট, সভ্যতার বুকে কলঙ্কের মতো অসভ্যরা প্রতিনিয়ত এদের নীচু দেখানোর চেষ্টা করেন, শিল্পীসত্ত্বার কদর করতে চান না।
এরা জানে না ফকল্যান্ড
বিধ্বস্ত আর্জেন্টিনার মানুষ সান্ধ্যকালীন আড্ডায় এলভিস প্রিসলেতে বুঁদ হয়ে থাকেন।
এরা জানে না ইজরায়েলের
স্কুল ফেরত কিশোর বিকেলে খেলতে না গিয়ে প্যালেস্টাইনের মহম্মদ আসাফে মজে থাকেন।
এরা জানে না রাশিয়ার
ডিমা বিলানের গান শুনে ইউক্রেনের মানুষ "আহা!" বলে ওঠেন।
এরা জানে না কাঁজের
ফাকে করাচির কোনো এক সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসের যুবক যুবতীরা ইউটিউবে সচিনের
স্ট্রেট ড্রাইভ দেখে বলে ওঠে "কাশ, ইয়ে বান্দা হামারা হোতা!"
এরা জানে না কাবুলের
কোনো এক অখ্যাত মজলিসে ভারতের হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশির সুর পড়ন্ত গোধূলিতেও
পাখির কলতান হয়ে বেজে ওঠে।
এরা জানে না এই পোস্টের
লেখকের মতো আরো কত ভারতীয়ের প্লেলিস্টে পাকিস্তানের নুসরত ফতেহ আলি খান সবার
প্রথমে থাকেন।
এরা জানে না যে এযুগের
ফুটবল ঈশ্বর লিওনেল আন্দ্রেস মেসি স্বয়ং বলে দিয়েছেন যে " ইভেন ইফ আই প্লেড
ফর আ মিলিয়ন ইয়ার্স, আই উড নেভার কাম ক্লোজ টু মারাদোনা। হি ইজ দ্য গ্রেটেস্ট
দেয়ার ইজ এভার বিন।"
এরা অনেক কিছুই জানে
না। নাহলে আটের দশক আর নব্বইয়ের দশকের কিছুটা যে মারাদোনা নামে নীল-সাদা জার্সি
গায়ে এক ফুটবলের ঈশ্বর সবুজ গালিচায় ফুল ফুটিয়েছে এটা অতিবড় ব্রাজিল-জার্মানি
সমর্থকরাও জানে। আর এরা জানবে না এটা হতে পারে না। আসলে এরা ফুটবলকে ভালোবাসতেই
জানে না।
এদের ক্ষমা করে দিও,
ঈশ্বর। ক্ষমা।
শুধু একটাই আক্ষেপ,
তোমাকে খেলতে দেখতে পাইনি বলে। থাক, যেটা ছিল না ছিল সেটা না পাওয়াই থাক। সব পেলে
নষ্ট জীবন। পরের জন্ম বলে যদি কিছু থাকে, তবে চাইব তুমি, পেলে, ক্রিশ্চিয়ানো আর
লিওনেলকে যেন একসাথে খেলতে দেখতে পারি। আহা, সে যে কি সুখের হবে এখন থেকেই ভেবে গায়ে
কাঁটা দিচ্ছে। এত সুখ সইবে তো?? কি জানি, উত্তর নেই আমার কাছে।
যাই হোক, শুভ জন্মদিন
বিতর্ক। শুভ জন্মদিন নেশাখোর। শুভ জন্মদিন গ্রেটেস্ট।
শুভ জন্মদিন দিয়েগো
আর্মান্দো মারাদোনা।
রাতের অন্ধকারে ঝিঁঝিঁ
পোকার ডাকের মাঝেও মন ভালো করা ভাটিয়ালির সুর থাকে। ঘাত প্রতিঘাতে মোড়া প্রতিটি
ভালোবাসার রূপকথায় যেমন জ্যোৎস্নার আতরে মোড়া মহামিলন থাকে, ঠিক তেমনি আজও কিছু
কিছু উপন্যাসের পাতা জীর্ণ ও অসমাপ্ত থাকে। সেই অসমাপ্ত উপন্যাসের
প্রতিটি পাতা পরতে পরতে, প্রতিটি হাহাকার আজও একটাই নাম বিড়বিড় করে,
দিয়েগোওওওওওওও......
আর্মান্দোওওওওওওওওওও.....
মারাদোনাআআআআআআ.....
No comments:
Post a Comment