আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা লুহান। স্পেনের উত্তর দিকে
অবস্থিত ফ্রান্স বর্ডার লাগোয়া সীমান্তবর্তী দুহাজার জনসংখ্যা বিশিষ্ট পুরোনো,
ঐতিহ্যশালী গ্রাম ফুয়েন্টেলবিলায় ১৯৮৪ সালের ১১ই মে জন্মগ্রহণ করেন পাঁচ ফুট সাত
ইঞ্চি উচ্চতাবিশিষ্ট বর্তমান বিশ্ব ফুটবলের 'ডন' ইনিয়েস্তা। শৈশবে স্পেনের
প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মাঠে ঘাটে প্রথম পরিচয় হওয়া ফুটবলের সাথে। মাত্র ১২ বছর
বয়সেই স্পেনের দ্বিতীয় সারির ফুটবল দল ব্যালমপাইতে খেলাকালীন সময়ে তার ফুটবল
প্রতিভা অন্যান্য অনেক দলকে তার প্রতি আকৃষ্ট করে তোলে। ছোট্ট ইনিয়েস্তার বাবা-মা
এর সঙ্গে বার্সেলোনার যুব প্রকল্প 'লা মাসিয়া' অ্যাকাডেমীর তৎকালীন কোচ এনরিক
ওরিজাওলার পরিচিতি থাকার কারণে ট্রায়ালের মাধ্যমে নিজ প্রতিভা গুণে অ্যাকাডেমীতে
নিজ নাম নথিভুক্ত করতে কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি বার্সেলোনা ফুটবলের সোনালী
ইতিহাসের প্রতিটি আখ্যানের সঙ্গে জড়িত থাকা এই অবিচ্ছেদ্য নায়ককে।
ইনিয়েস্তা
প্রথম জীবনে বার্সেলোনা অনূর্ধ্ব-১৫ দলের অধিনায়ক হন এবং দায়িত্ব সহকারে তা পালন
করেন। ১৯৯৯ সালে অনূর্ধ্ব-১৫ দলকে নাইকি প্রিমিয়ার কাপের ফাইনালে তোলেন এবং শেষ
মুহূর্তে তার করা জয়সূচক গোলের মাধ্যমে দলকে চ্যাম্পিয়ন করেন। লা মাসিয়ায় তার
সতীর্থ সেস্ক ফ্যাব্রিগাস মতো ইনিয়েস্তাও প্রথম জীবনে একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার
হিসেবেই শুরু করেছিলেন। তবে তার শারীরিক ভারসাম্য, অদ্ভুত বল নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা,
দ্রুততা, এবং ডিফেন্স চেরা থ্রু এর কারণে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে খুব শীঘ্রই
উন্নতি করতে থাকেন.. যা নজর এড়ায়নি বার্সেলোনার স্কাউটের দায়িত্বে থাকা ক্লাব
অফিসিয়ালদের। মাত্র ১৮ বছর বয়সে বার্সেলোনা সিনিয়র দলে তার অভিষেক ঘটে। ভিনসেন্ট
দেল বস্ক তার সম্পর্কে বলতে বাধ্য হন... "একজন পূর্ণাঙ্গ ফুটবলার। সে রক্ষণ
এবং আক্রমণ উভয়ই দক্ষতার সাথে সামলাতে পারেন। এমন একজন ফুটবলার যিনি গোল করতে এবং
করাতে সমান পারদর্শী।" কেরিয়ারের শুরুতে লুইস ভ্যান গল তাকে ওয়াইড ফরোয়ার্ড
হিসেবে খেলাতে শুরু করেন কিন্তু পরবর্তীকালে রাইকার্ডের আমল থেকেই ক্লাব এবং
আন্তর্জাতিক উভয় স্তরেই তিনি নিজেকে অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে মেলে ধরতে শুরু
করেন সাফল্যের সঙ্গে।
২০০৪-০৫ মরশুমে ইনিয়েস্তা ৩৭টি ম্যাচে বার্সেলোনার
হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন যার মধ্যে ২৫টি ম্যাচে তাকে বদলি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই
মরশুমে বার্সা লা-লিগা শিরোপা জেতে যার মধ্য থেকে দুটি গোল করেছিলেন ইনিয়েস্তা।
একজন অনিয়মিত খেলোয়ার থেকে নিয়মিত খেলোয়ার হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করবার সুবর্ণ
সুযোগটি আসে জাভির চোট পেয়ে দল থেকে সাময়িক ভাবে ছিটকে যাওয়ার কারণে। ইনিয়েস্তা
তার বদলি হিসেবে প্রথম একাদশে সুযোগ পেতে শুরু করেন এবং নিজ পারফরমেন্সের উন্নতির
ধারা অব্যাহত রাখেন।
বার্সেলোনার
হয়ে নয় বার লা-লিগা খেতাব জয়ের সাথে সাথে চার বার উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ী দলের
একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবেও নিজেকে তুলে ধরেন। এছাড়াও আন্তর্জাতিক স্তরে
২০০৮ এবং ২০১২ সালে স্পেন জাতীয় দলের হয়ে ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা এবং ২০১০ সালে
বিশ্বকাপ জেতার প্রবল গৌরব অর্জন করেন। তাছাড়াও.. পাঁচবার স্প্যানিশ কাপ, ছয়বার
স্প্যানিশ সুপার কাপ, তিনবার ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ জয়ী দলের নিয়মিত সদস্য ছিলেন।
আন্দ্রেস
ইনিয়েস্তা থেকে 'ডন' ইনিয়েস্তা। ফুটবল জগতে হিংস্রতা, দাপট এবং সৌন্দর্য্যের মিশেল
দেখতে হলে আমাদের চোখের সামনে হয়তো ভেসে উঠবে সত্তরের দশকের ব্রাজিল, পঞ্চাশের
দশকের হাঙ্গেরি, আশি এবং নব্বই দশকের মিলান, সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ের বায়ার্ন
কিংবা বব পেলসির অধীনের লিভারপুল; স্টেফানো, পুসকাস, জেন্টদের নিয়ে গড়া সেই হিংস্র
মাদ্রিদ। কিন্তু ধুরন্ধর ম্যানেজার পেপ গুয়ার্দিওলার হাতে গড়া মেসি, জাভি, পুয়োল,
পিকে, ইনিয়েস্তা, আবিদাল সমৃদ্ধ দলটা খুব নিশ্চিতভাবেই এযাবৎকালের সর্বশ্রেষ্ঠ
একাদশ। ইনিয়েস্তাদের সেই প্রবল দাপুটে তিকিতাকার সামনে পড়ে বিশ্বের আর বাকী তাবর
দলগুলিও ল্যাজে-গোবরে হয়েছে। একবার, দুবার নয়.. বারংবার। জাভি-ইনিয়েস্তা সমৃদ্ধ
বার্সাই হোক অথবা স্পেন দল.. মাঝমাঠ চালিত এই দুটি দলই এক শক্তিশালী,
সৌন্দর্যময়তায় সমৃদ্ধ দাপুটে ফুটবল উপহার দিয়ে গিয়েছিল বিশ্বের তামাম
ফুটবলপ্রেমীদের। মাঝমাঠ থেকে তৈরি করা পাস যে কত সহজ ও নিপুণভাবে মিসাইল বেগে
খেলার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে চলে তা ইনিয়েস্তার খেলা দেখেই আমরা চাক্ষুস করেছি।
গুয়ার্দিওলার সেই অপ্রতিরোধ্য দলের জাদুকাঠিগুলি এক এক করে সব আজ অবসরগ্রহে।
পুয়োল, আবিদাল, জাভির অবসর পরবর্তী সময়ে একই পথে কালক্রমে শামিল হতে চলেছেন আর এক
ম্যাজিশিয়ান 'ডন' ইনিয়েস্তাও। বার্সেলোনার হয়ে ট্রেবল, পেন্টা, হেক্সা জয়ী
ইনিয়েস্তা নিশ্চিতভাবেই সর্বকালের সেরা হাতে গোনা শৈল্পিক ফুটবলারদের একজন।
চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রিয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে খেলে ফেললেন জীবনের শেষ এল ক্লাসিকো।
খেলা শেষেও দর্শকেরা ইনিয়েস্তা মাঠ ছাড়ার আগ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখের জলকে
সঙ্গী করে অভিবাদন জানালেন। ক্লাব ফুটবলের বহু আদিকালের রেষারেষি কেবল তার জন্যই
নিপাতনে সিদ্ধ হয়ে বদলে গেছে অনেক আগেই। বৈরি বার্নাব্যুও তার সম্মানে দাঁড়িয়ে
যায়। রোনাল্ডো-মেসিদের গোলের পরিসংখ্যান মুখস্ত করা অব্দিই যাদের ফুটবল জ্ঞানের
ব্যপ্তি সীমিত.. তারাও বাদ গেলেন না। পায়ে যার চুম্বক লাগানো, দুই পায়ের কারিকুরি
দেখে যাকে অবলীলায় বলে দেওয়া যায় 'ম্যাজিশিয়ান' আজও যখন বিপক্ষের রক্ষণে ছুরি
চালান.. তা দেখে কে বলবে যে তিনি ফুরিয়ে গেছেন? .. ফুটবল তো অনেকেই খেলে কিন্তু তা
দিয়ে মায়ার ইন্দ্রজাল ছিন্ন করতে পারেন কজনায়?
বেলায় বেলায় বয়স হয়েছে ৩৩। ইউরোপিয়ান ফুটবলের আলো
ঝলমলে এই রাতে বার্সেলোনার ৮ নং জার্সি গায়ে আর দেখা যাবে না তাকে। তাহলে কি
ইনিয়েস্তার ইউরোপ অধ্যায় শেষ হলো? নাকি ফুটবল থেকেই ফুরিয়ে গেলো একটা অধ্যায়?
ভালো থেকো ম্যাজিশিয়ান আন্দ্রেস 'ডন' ইনিয়েস্তা।
No comments:
Post a Comment