ব্লগ-টগ

প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশের ঘরোয়া সূত্র

Post Page Advertisement [Top]

To Place your advertisement here call - +917980316633/+918145704098




পর্ব - ১

ঠাকুর বলেছেন,লজ্জা,ঘৃণা,ভয় তিন থাকতে নয়।সিদ্ধ ব্যক্তিদের কথা জানি না,আমি তুচ্ছমানুষ,লজ্জা,ঘৃণা,ভয়ে আটকে আছি।ছিলাম ও থাকব।

এই বাণীটি প্রথম ঝোলানো দেখতাম,দুটি দোকানে।দুটি খাওয়ার দোকান ছিল পাশাপাশি।একটি নাটোর সুইটস,পাশেই দিলরুবা।দুটি দোকানই উঠে গেছে।

নাটোর সুইটসের মালিক,নাটোরের লোক বলাই বাহুল্য।দেওয়ালে ঝুলতো একটি ছবি।তাতে নিচে লেখা ছিল,'নাটোরের শ্রীশ্রী ন্যাংটা কালীমাতা"।সেই ছবিটির তলায় আরেকটি বাঁধানো ফ্রেমে ঝুলতো শ্রীশ্রী ঠাকুরের ছবি,নিচে ঐ বাণী।লজ্জা,ঘৃণা,ভয় তিন থাকতে নয়।

ওই দোকানে আমি বাবার সঙ্গে দইবড়া খেতে যেতাম।আর বাণীটি রোজই বুঝবার চেষ্টা করতাম।কোনোদিন কাউকে অর্থ পুছি নাই।

কিন্তু এইটুকু বুঝেছিলাম,উদ্দেশ্য পূরণের জন্য,ঐসব আহ্লাদী বালাই ত্যাগ না করলেই নয়।

কিন্তু তা কীসম্ভব?সম্ভব তো নয়।বা আদৌ সম্ভব কিনা,পরে বড় হয়ে রুশোর স্বীকারোক্তি পড়েও ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারিনি।মনের কত শৃঙখল অজান্তে পাকিয়ে ধরেছে আমাকে,কত ন্যায্য কথা বলতে পারিনি অথবা বলেছি,কত তিক্ততা মেনে নিয়েছি বা নিইনি,তার যদি হিসেব করি,হেরে যাওয়ার পরিমাণ বেবাক শূন্য হবে না।


বলছিলাম,শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের কথা।আমি যখন সদ্যোচেতন,তখন কলকাতার উত্তরদিকের বৃদ্ধ বৃদ্ধারা খুব একটা ব্রাহ্মটাইপ না হলে,রামকেষ্টই বলতেন।আমি যখন ক্লাস থ্রি-ফোরে পড়ি,সাল ১৯৮১-৮২,তখন শ্রীম"র কথামৃতর ধুম পড়ল।আনন্দ ক্যাটক্যাটে লাল রঙের স্টেনসিল পেপারের মত কাগজে কথামৃত ছাপল।সবাই কিনল।কেউ কেউ পড়ল।উত্তরের ধরন ছিল বা আছেও একটু ন্যাকাবোকা,ভাবিনী গোছের।পাড়ায় শ্রীশ্রীপরমহংসভাবের আবির্ভাব হল।এদিকে খুব শিক্ষিতপাড়া আমি বলব না।অন্যত্র বলেছি বটে,এর ওর বাড়ী ছিল,সে গলিতে,কিন্তু মাস যাকে বলে,তার মান এভারেজ বা বিলো দ্য এভারেজ বললেই হয়।অভিজাত,অনভিজাত,ধনী,দরিদ্রে,ঘটি,উদবাস্তুতে স্পষ্ট সাংস্কৃতিক ও যাপনিক ভেদ ছিল।গায়েলা গোয়া ছিল বিখ্যাত বস্তি।তা এমত পল্লীতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কীরকম কী হতেন,এমন এক বিখ্যাত পণ্ডিতের বাস ছিল।বৃদ্ধ নবতিপর।দেশবিখ্যাত সংস্কৃতজ্ঞ ছিলেন।গৌরীশাস্ত্রী মশাই প্রায়ই আসতেন,পদধূলি নিতেন।একদিন এক আধাবেম্ম বুড়ী কুমারীর কাছে শুনলাম,শাস্ত্রীমশাই অনুমতি 'পেলেন না'।আমি কচি ছেলে।খুব আশ্চর্য হয়ে জিগেস করেছিলাম,কীসের অনুমতি গো?শাস্ত্রীমশাই সম্পর্কে একটা আবছা ধারণা হয়েছিল।কিন্তু কীসের অনুমতি?না সেদিন সে উত্তর পাইনি।ভাব ঢলঢল ষাট ছুঁইছুঁই বকুদি বলেছিলেন,সে কথা ভরসন্ধেতে বলব না বাছা।কাল আসিস। 


ভাবের আনন্দ সিক্ত সেই কংগ্রেসী পাড়ায় আপনার চোখে যদি স্যাটায়ারের মুগ্ধ অঞ্জন না পড়ে থাকে,তবে বুঝব আপনারই সমস্যা।সে বড় অপরূপ ন্যাকামোতে গড়া ধীর শীতের দুপুরের দিন ছিল।ধীরে আচার পাকার গ্রীষ্ম ছিল।ধীরবৃষ্টির দুপুর ছিল।ধীর শরতের ভোর ছিল।

সবই যে এত ধীর ছিল,তার একটা স্পষ্ট কারণ ছিল।ভাবের কথায় আমার মোটে আস্থা নেই।ধীর লাগবার একটা বিশেষ কারণ ছিল।সাড়ে চারটেয় ঘুম ভাঙত আর রাত দশটায় দিন শেষ হত।ফলে দিনটা হাতে থাকত বেশি।ধীরে চলত,অনেকরকম ওজন নিয়ে।

সেরকমই একসময়ে অধ্যাপক প্রবর গৌরীনাথ শাস্ত্রী মস্কোতে ভারতবিদ্যা সম্মেলনে বা ওই গোছেরই কিছু একটায় মূল শাখার অতিথি টতিথির ডাক পেলেন।
তিনি সপ্ততীর্থের অনুমতি নিতে এলেন।গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় মালতীলতার নিচে দাঁড়িয়ে কালো সরু পাড়ের সাদা শাড়ী পরিহিতা বুড়ীকুমারী বকুরাণী তাঁর গমনোদ্যতা ভাগনে বউকে অদ্ভুত মায়াবী স্বরে বললেন,শাস্ত্রীমশাই অনুমতি"পেলেন না।"এ পাড়া,এই সে পাড়া শাস্ত্রীকে ম্লেচ্ছদেশে যেতে নিষেধ করল।পাড়া বাঁচল।আভিজাত্য রইল।ছোঃ।প্রগতিশীল বৃদ্ধেরা আধো হাসি,আধো গাম্ভীর্য মুখে এনে ঈষৎ তৃপ্তিতে উচ্চারণ করলেন,সপ্ততীর্থ নিষেধ করেছেন।নিষেধ ও করেছেন শব্দ দুটির উচ্চারণে অধিধ্বনির একটা প্রত্যয়িত নিশান খেলে যাচ্ছিল।কিন্তু নাটক এরপরে।


পর্ব - ২

বুঝতেই পারছেন,আমাদের পাড়া ছিল,বিশুদ্ধ হিন্দু পাড়া।একজন মুসলিমও সেই ভূগোলে,স্থায়িভাবে,বসবাস করতেন না।এক কানের খুঁজলি পরিষ্কার করতে,বিশ্বনাথ বস্ত্রালয়ের ধাপিতে এক মুসলিম বসতেন।আর শিবদাস ভাদুড়ীর গলিতে ওস্তাগরের দোকানে দুজনকে দেখতাম,মেহেদি রঙের দাড়িওলা।আরেকজন মনে হচ্ছে,স্টার থিয়েটারের গায়ে,জর্দার দোকানে এক সওদাগর বসতেন।এছাড়া বাপু মুসলিম দেখিনি।নির্ভেজাল হিন্দুপাড়া বলতে যা বোঝায় তাই।
এ পাড়ায় কংগ্রেস ছিল।তাদের অশিক্ষিত ভাবতাম।সি,পি,আই ছিল।তাদের নির্লজ্জ জানতাম।কিছু ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল ছিল।তাদের ক্যাসুয়াল ভাবতাম।কারণ তাদের বহুৎ কুছ হেরিটেজ-গত অর্জন থাকলেও ঘর্ষণ  মোটে ছিল না।তবে তারা সবাই জাতীয়তাবাদী ভঙ্গিতে পাড়ার দুর্গাপুজোয় অধিকার লড়াই এর আন্দোলন করতেন।আমিও তার এক যোদ্ধা ছিলাম।
সুতরাং পাড়া হিন্দু বটে।সে পাড়ার মহিলাদের একদল ১৯৯৭-৯৮ অবধিও শিবরাত্রি আর পুজোর দিন,আলতা পড়ে লালপেড়েতে লজ্জাবউ হয়ে বেরুতেন।সিন্সিয়ারিটি নিয়ে চশমা পড়ে,পাড়ার পুজোয় যোগান দিতেন।বয়স্ক শিক্ষিতরা কম সোনা পড়তেন।আর টমের বোন টমী এবং মোমের মা মোম্মা,সোনার চামর ঝালর পড়ে,বোকা চোখ মেলে,না কাজ করে তদারকি করতেন।মোম্মার আবার চোখে জল আসত।কেন,জানি না।আবেগে।সেই সময় গৌর পুরুত তাঁকে কাঁদিস নে মা বলে অনুনয় করতেন।তিনি রাগ করতেন।তিনি আরো ফুলে কেঁদে উঠতেন।
আমি ভাবতাম,একটা খুব একটা ভাবের ব্যাপার আছে।কী বুঝতাম,বেশ স্পষ্ট বলতে পারি না।কিন্তু একটা উচ্চস্তরের ব্যাপার আছে বুঝতাম।
ক্রমে বুঝলাম,মোম্মা কিছু বেশি চাঁদা দেন।ওদিকে সন্ধিপুজোয় এট্রাকসান টানেন।এ এক লীলা।
তা এহেন পাড়ায়,শাস্ত্রীমশাই 'অনুমতি পেলেন না।'


শাস্ত্রী আসতেন তাঁর শিক্ষকের কাছে।ভাবিনীর দল তখন যেতেন,একটু,সে বাড়ীর তক্তাপোষে বসে,একটু বচন শুনতে।ওমনিতে কিন্তু সপ্ততীর্থর বাড়ী এই ভক্তিমতীরা বিশেষ যেতেন না।সপ্ততীর্থ অকৃতদার ছিলেন।তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্ররা ছিল।এক বলে ওকে দেখ।একটা গুণ্ডো।একটা মাতাল।আরেকটা সোনার বেণেকে বিয়ে করেছিল।পাড়াতেই তার শ্বশুরবাড়ী।সপ্ততীর্থ অতিবার্ধক্যে বিড়বিড় করে বহু প্রশ্নের একাক্ষরী উত্তর দিতেন।তাতে ঘোষ,বোসের মেয়েদের মন ভরত না।তারা সবাই ঘোমটা টানা  ম্যাট্রিক,কিম্বা একটি দুটি এম,এ।তাদের একটু ভাবের বিস্তার লাগত।শাস্ত্রীমশাই সেসব একটু ফেনিয়ে বলতে পারতেন।
তাই শাস্ত্রী এলেই সতীসমাগম হত।কিন্তু আমি না থাকলেও,আজো নিশ্চয় বলতে পারি,সেদিন তাঁরা নির্ঘাৎ শাস্ত্রী-সপ্ততীর্থ বচন কানে শুনলেও বোঝেননি।সপ্ততীর্থ নিষেধ করেননি।করলে শাস্ত্রী যেতেন না।শাস্ত্রীর সঙ্গে সেদিনের কথা কী নিয়ে হয়েছিল,তা বেশ কদিন পরের খবরের কাগজ পড়ে অনুমান করেছিলেম।শিক্ষক বোধয় ছাত্রকে কিছু বিধিনিষেধ আউড়ে ছিলেন।
সপ্ততীর্থের বাড়ীর উল্টোদিকে বাস ছিল,আরেকব্রাহ্মণের।তিনি এল,আই,সি-র কর্মচারী।খর্বকায়।পূর্ববঙ্গীয়।তিনিও জাতের বামুন।সাতকুলে নির্দোষ।ভাড়া থাকতেন।সেই কলকাতায় বাড়ীওলা,ভাড়াটের বিপুল ভেদ ছিল।বাড়ীওলারা নিজেদের ভাবতেন সংস্কৃতিবান।এবং তাঁরা নেহরুপন্থী।ইন্দিরা গাঁধী ছিলেন,ঘরের মেয়ে।সুভাষকে তাঁরা স্নেহ করতেন।কিন্তু নেহরু,সুভাষ ডাইকোটমি তাঁরা মানতেন না।আর ছোটলোক ভাড়াটেগুলো,সেগুলা গরীবও বটে,ছ্যাঁচোরও বটে,কিন্তু মুখে একটু বিদ্রোহী ভাব দেখালেও,অজিত পাঁজা মশাই এর জনমোহিনী প্রকল্পের আওতায়,সেগুলিও কংগ্রেসী।তখন থেকেই আমি কংগ্রেসের মধ্যে স্পষ্ট ভাঙন লক্ষ করছিলাম।কয়েকদিন পরেই দেওয়ালে ইতিউতি বাংলা-কংগ্রেসের একটা দুটো লিফ্লেটের আমদানী হবে।অবশ্য তার দেরি আছে।১৯৮৪র পর।
যাইহোক,তা উল্টোদিকের এল,আই,সি ভটচাজ ছিলেন নিখাদ সিপিএম।ভালোমানুষ।ভাণ ছিল না।তিনি আমারে তখন নয়,তার অনেক বছর পর,নিজের দুটো ছেলেই গোল্লায় গেলে(আসলে যায় নি,ওঁর মতে গোল্লায়)আমাকে স্নেহ করতে শুরু করেন।সেই ভটচাজ দুচক্ষে এই ঘটি পুষুপানা দেখতে পারতেন না।মাস ছয়েক পর,তিনি একটি ইংরেজি কাগজের হেডলাইন,নিয়ে আমাদের টি মোড়ে আমাকেই ধরেন।জীবনদেবতা যেমন নিজেই রবীন্দ্রনাথকে বরণকরে নিয়েছিলেন,চিতে ভটচাযও নিজেই তাঁর বক্তিমের জন্য আমাকে বেছে নেন।সোল্লাসে তিনি দেখান,"Sastri boiling his food on Moscow Rail Platform".
ম্লেচ্ছদেশে অন্নগ্রহণেই জাত যাওয়ার সম্ভাবনা।কী করবেন শাস্ত্রী।চিঁড়ে মুড়িও অন্ন।ফলাদিতে ওই বৃদ্ধের গ্যাস হত।কী করেন।দুটি স্বপাক।কিন্তু সেও ম্লেচ্ছদেশে চলবে না।As told by Saptatirtha দ্বার দেশে দোষনাই।রেলস্টেসন,দ্বারদেশ বটে।এয়ারপোর্ট,রেলস্টেসনে অন্নগ্রহণ চলিলেও চলিতে পারে।শাস্ত্রীকে আগুন,তৈজসের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল।তিনি মস্কো প্ল্যাটফর্মেস্বপাক খেতেন।তারপরে ম্লেচ্ছদের শ্রুতিব্যাখ্যা করতেন।
কিন্তু তাতেও দোষ ছিল।শাস্ত্রীর সেই লোভেপাপ।পাপের ফল,আমার এই রিপোর্ট।তা চিতে ভটচাজ,এতে বেজায় আমোদ পেয়েছিলেন।এবং একটি অব্যর্থ ইডিয়ম প্রয়োগ করলেন।সেই আমার জীবনের প্রথমবার সেইটি শোনা,"ঘোমটারতলায় খ্যামটা নাচা।"তখন আমি এই ইডিয়মটা বুঝিনি।শাস্ত্রী নিজে অমন কষ্ট করে খান,ভেবে,শাস্ত্রীকে খুবই সম্মান করছিলুম।অনেকপরে বুঝেছিলুম,সপ্ততীর্থ ধান্ধাবুড়া কিন্তু চিতে ভটচাজই বামুন বটে।


প্রত্যাখ্যানকে কীভাবে প্রত্যাখ্যান করতে হয়,চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্য আমাকে তা শিখিয়ে গিয়েছেন।


পর্ব - ৩

উত্তর কলকাতার কসমোপলিটানিটির মধ্যে মানুষ হলে,আপনি গবেট হতে পারেন অথবা চূড়ান্ত স্কেপটিক হতে পারেন।পাপ ও পুণ্যের এমনধারা বিমিশ্রণ উত্তর ছাড়া পাবেন না।সেই মিশ্রণে আপনার চরিত্রে অবদমন আসবেই।আমার তো তেমনই অভিজ্ঞতা।আরসেই অবদমনের ঘনঘটায় প্রব্রজনও হবে।আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।আমি সেই পাড়ায় আর থাকিনা।তার উল্টোদিকে থাকি।
সেইজন্যই উত্তরের পাড়া তার চরিত্র হারাচ্ছে দ্রুত।হুতোম একবার বলেছিলেন,কলকাতায় বনেদিরা নিকেশ হচ্ছে,অন্যদিকে পুঁটে তেলি বাড়ী করছে।হুতোমের অবসার্ভেসানকে,তাঁরই প্রভাব পরিসরে তৈরি এই কলকাতায় আপনাদের আজো সত্যবলে মেনে নিতে হবে।দক্ষিণের চরিত্র অন্য কোনো বিদ্বান গতানুগতিক ধ্রুপদী মার্ক্সবাদ দিয়ে কিছুদূর বিশ্লেষণ করেছেন,কিন্তু আজ অবধি বিস্তার করেন নি।

উত্তরেরপাড়ায় সেই সেকাল,আমার কৈশোরের সেকাল বিদায় নিয়ে,আজকে অনেক স্মার্টার,সার্পার,স্ট্রংগার হয়ে উঠেছে,কিন্তু প্রাচীন ও হাফ প্রাচীনের যে একটা চোখা অথচ বিশেষভাবে বোকা একটি উঁচু নাক ছিল,সেটি উদীয়মান পূর্ববঙ্গীয় টার্ণড ব্যবসায়ীদের তৃতীয় প্রজন্মের সি,বি,এস,সি সন্তানদের হাতে কুচুৎ করে কাটাগেছে।কোথায় সেই কায়স্থের বেধবা,পাশের বাড়ীর সুভদ্র,সুপ্রতিষ্ঠিত আশু রায়ের স্ত্রীকে,'ও,আশুকামারের বউ"বলে আহ্লাদ করে ডাকতেন,আজ সেইপাড়ায় সেই ডাকের খুনসুটি উঠে গেছে।সবাই মিস্টার।এবং কুণ্ডু,সাহা ইত্যাদি।যে যুগে পাড়ায় ঘোষ, বোস,মিত্র ছিল,চ্যাটার্জী,ব্যানার্জীরা সঙখ্যা গুরুছিল,কঘর গন্ধবণিক কাচুমাচু হয়ে ঘুরে বেড়াতো। ডাঁটিয়াল সুবর্ণ বণিক কঘর ছিল। বৈদ্য ছিল।মূলত এই ডেমোগ্রাফিতে পাড়ার শাসনক্ষমতা কেন্দ্রিত ছিল।ছোটজাত,বাড়ীওলা,একটিই প্রাচীন পরিবার ছিল,মণ্ডল।

এহেন বিন্যাসের পরিবর্তন হয়েছে।পরিবর্তন মানেই যে খারাপ হয়েছে,তা একেবারেই বলছিনা।বিশ্বপ্রেক্ষিতের ভারতীয় ও পশ্চিমবঙ্গীয় চরিত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিবর্তন হবে,তা বলা বাহুল্য।নকুড়ের আগে কোনো শাখা ছিলনা।আমি যে নকুড়ের সন্দেশ খেয়েছি,তারা মালাইরোল,স্যাণ্ডউইচ,জলভরা,গোলাব রেউরি,আরগুলি সন্দেশ ছাড়া কিছু হয় জানত না।মারোয়ারি ক্রেতা ছাড়া,সে দোকান উঠে যাওয়ার জোগাড় হয়।বলতে গেলে,বলতেই হয়,উত্তুরে পল্লীগুলির ক্ষয়িষ্ণু পরিবারগুলির কালীমাতা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের টোকো ল্যাংচা ছাড়া কিনবার সামর্থ্য কমে এসেছিল।ফলে নকুড়কে হলদেসবুজ ওরাং ওটাং মার্কা সন্দেশের আমদানীতে নাবতে হয়।যে নারকোল আর বাদামের মিশ্রণকে পশ্চিমবঙ্গীয় অভিজাত কুলোত্তম এক বৃদ্ধকে "সন্দেশই নয়"বলে,সেন মশাইর একবাক্স পদ্মসন্দেশকে পদ্ম ঝিকে দিয়ে দিতে দেখেছি,সেই রুচি ও অর্থের উচ্চনাসাকর্তিত হয়েছে।
কাল সবই হরণ করেন।

সেন-মশাইর রসের মিষ্টি ভালো,ছিল,কিন্তু ভালোতম নয়।যে দোকানের মিষ্টি নকল করে,সেন-মশাই-এর উত্থান,সেই দোকান উঠে গেছে।আমি সেই দোকানে খুব অল্পবয়সে একবার ঘৃতয় ভর্জিত উত্তম ল্যাঙচা খেয়েছিলাম।সেইজন্যই"জেলার মিষ্টির মুখ"দেখিতে চাহিনা বিশেষ।ওসব শক্তিগড় আমাদের চলবে না।সে দোকানের নাম,খগেন ঘোষ।আজ আমার লোলুপ অনুজদের জন্য খগেন ঘোষের কথা ভেবে বড় কষ্ট হয়।

নকুড়ের যোগ্য আস্বাদক হতে গেলে,অনেক প্রলোভন জয় করতে হয়।অনেক উপার্জনও করতে হয়।
আজকের কোনো মাকুছাত্র যখন একই সঙ্গে হোক ওমুক এবং হোক নকুড় দুটোই করে,তখন আমার মন গভীর লজ্জায় নিহিত হয়।গভীর বেদনায় আমি ভাবি,যারা কেবল পরান্নজীবী ও পরশ্রমজীবী(বাপ মায়ের) হয়ে জীবনধারণ করে,তাদের দুটিই এক সঙ্গে হওয়ার কোনো অধিকার নেই।অথচ এদেরই একজনকে আমি চিনি,যে আমাকে দক্ষিণপন্থী ভাবে,সেনিজে মাকুমঞ্চে বক্ততিমেও দেয়,আবার পিতৃগৃহের নিশ্চিন্ত নিরাপদে,বালগোপাল সেজে,জন্মদিনের ছবি দেয়।থালার পাশে,গুনে দেখেছি,এগারোটা বাটি।এরাও নাকি বামপন্থী।কমলাকান্তের বেড়াল,থাকলে,বাটির পাশে ছেড়ে দিতাম।এত নির্বোধ,এদের ওরিয়েণ্টেসান,এত অশিক্ষিত এদের গুরুকুল,এত অপরিণত এদের বোধ,যে তর্ক করতেও প্রবৃত্তি হয় না।আমার নকুড়ের পাশের ভিখিরির মুখ মনে পড়ে।

নকুড়ের পাশে বাড়ী ছিল,স্বর্গত,বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের।তিনি সেকালের কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশুদ্ধ গণিতের অধ্যাপক ছিলেন।তাঁদের সঙ্গে আমার মা এর বিশেষ সৌহার্দ্য ছিল।পরে এমনি আশ্চর্য বঙ্কিমবাবুর পুত্রবধূ,আমার শাশুড়ির বন্ধু বেরুলেন।বঙ্কিমবাবুর বাড়ী মধ্যে মধ্যে যাওয়া হত।তিনি আমাকে মেকানিক্স পড়াতেন,বলা ভুল,দাদুভাই বলে আপন খেয়ালে ঠিক দুটি জিনিস শিখিয়েছিলেন।
একটি হচ্ছে ডিনামিক্সের প্রথমসূত্র রেসাল্ট্যাণ্টের ট্রিগোনোমেট্রি দিয়ে প্রমাণ।ঠিক দুলাইনে কাজশেষ।আরেকটি,স্ট্যাটিক্সের লিভারের আরেকটি সমাধানের পথ।সবই তো ভুলে গিয়েছি।কিন্তু হিন্দু ইস্কুলের সুধন্যবাবু তাতে খুব চমকেছিলেন,পষ্ট মনে আছে।

কালীমাতার মিষ্টির দোকানে ফিরে আসি।সে আসলে,শনি,বেস্পতিবারের মিষ্টির দোকান ছিল।ধীরে বুঝলুম,মানুষের খাদ্যরুচি,অর্থের উপর নির্ভরশীল তো বটেই,তেমনি আবার উদ্দেশ্যর উপরেও নির্ভরশীল।এই দুয়ের যুগল সন্নিবেশের উপর মিষ্টির দোকান চলে।উত্তর কলকাতায় কে বাড়ীতে কী নিয়ে এল,তার খুব বিচার ছিল।বিচার থাকাটা আমি কিছুটা সঙ্গত,কিছুটা অসঙ্গত বলব।
গরীব অতিথি আত্মীয়কে, "এ তো আমি খাইনে" বলে গৃহস্বামীকে অসম্মান করতেও যেমন দেখেছি,তেমনি ধনাঢ্য আত্মীয়কে গরীব কুটুম্বের বাড়ী ইচ্ছাকৃত বজ্জাতি করে,হাতে ধরে,জেনে শুনে পচা খাবারও নিয়ে যেতে দেখেছি।
তা এহেন পাড়ায় চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্যের সঙ্গে আমারক্রমশ ভাব জমে ওঠে।

যাবতীয় ঘোমটার তলায় খ্যামটা নাচা বিষয়ে চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্যের বিরোধ ছিল।আমি আবারো বলছি,যতদিন তিনি আমার ও তাঁর নিজের সন্তানের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত ছিলেন,ততদিন তিনি আমাকে বিশেষ আমল দিতেন না।বরঞ্চফোঁস ফোঁস করতেন।যেদিন আমার পিতৃবিয়োগ ঘটল,তার পর থেকে তাঁর নিত্যস্নেহ আমাকে অভিষিক্ত করেছিল।তিনি রিটায়ার করলেন।আমিও বাড়ী ছেড়ে,একটু কমই বেরুতাম।তিনি অফুরন্ত সময় নিয়ে,আমার সঙ্গে ঠেক মারতেন।ঠিক তেমাথার মোড়ে।
পাড়ার ভদ্র অধিবাসীদের মধ্যে প্রাচীনতম ছিলেন,প্রায়-নিরক্ষর ঘোষাল পুরুতেরা।চিতে ভটচাজ,ঘৃণায় সেদিকে ফিরেই চাইতেন না।কাকীমা ছিলেন,কোমল প্রকৃতির ও স্কুলশিক্ষয়িত্রী।তিনি শ্রদ্ধা বিলোতেন।দ্বিতীয় প্রাচীন অজিত ঘোষের গুষ্টি।এই উভয় বাড়ীর কথা ক্রমে সবিস্তারে বলব।আর ছিল অবন নাগগন কার যেন একটা জামাইবংশ।সেও বলব।

এখন শুধু এটুকুই বলি,চিতে ভটচাজ অজিত ঘোষের গুষ্টিকে শ্রেণিশত্রু ভাবতেন।
অজিত ঘোষের অবিবাহিত মেজবোনের মৃত্যুর পর,শ্রাদ্ধাদি চুকে গেলে,একদিন তাঁদের বাড়ীতে বেশ শোরগোল ফেলে,এক আত্মীয়ার আগমন ঘটল।ফিসফাসে তাঁরা জানিয়ে দিলেন,এই মহিলা,তরুণকান্তি না তুষারকান্তি কোন একটার শাশুড়ি। তিনি অজিতবাবুর বাবার বৈমাত্রেয় দিদির পুত্রবধূ।তিনি আঁতেল-ধর্মপ্রাণা।প্রসাদ নিয়ে রুপোর টিপিনকারিতে চাকরসহ গাড়ী যোগে এলেন।মৃদুস্বরে,একচিলতে ঠোঁটের ফাঁকে,কি দুঃসংবাদ,কি দুঃসংবাদ বলতে বলতে সমাদরমথিতা হয়ে ঢুকলেন।শোকেরশ,বুঝিনি।আমি অকুস্থলে পায়চারি করছিলাম।
তিনি এলেন।তিনি কিছুক্ষণ বসার ঘরে বিশ্রাম নিলেন।ক্রমে উঠলেন।আদবকায়দা অনেকটা,বাকিংহামের মত।তাঁর সন্ধ্যারতির পূর্বে তিনি বিদায় নিলেন।নিবাস ভবানীপুর।
পরদিবস,চিতে ধরলে।

সে বললে,বুzলা,রাza,চীন যুদ্ধে,ভারত গোহারা হারত।চীনেরা নিজেই ঢুকে,নিজেই বেরিয়ে যায়।আপনারা ডোকালাম স্মরণ করুন।আমি স্বর্গত চিত্তবাবুকে স্মরণ করি।চিত্তরঞ্জন বলে চলেন,রাসেল zaনো,লিখেছিলেন,It is a Chinesecase,nothing of India.চিত্তরঞ্জন মুখে জর্দা ঠুসে খুব উত্তেজিত হয়ে বললেন,zaনো,এতবড় গাণ্ডু,যে পরের দিন#যুগান্তর সম্পাদকীয় লেখে"বৃদ্ধ,অথর্বরাসেল"।রাza সেইযে যুগান্তর বন্ধ করেছি,আজ অবধি আর খুলিনি"।#


এই অভূতপূর্ব,অপ্রত্যাশিত পরস্পর অ-সম্পর্কিত সাংস্কৃতিক যুদ্ধে আমার কৈশোর অতিবাহিত হওয়ায় আমি আমার ভাগ্যদেবতাকে নমস্কার জানাই।


পর্ব - ৪

কী গাব,আমি,কী শুনাবো,বলুন দেখি!সম্ভব কি সেই সব পুণ্যচরিতকথার মহিমাবর্ণন?নয়।আমার প্রত্যেকটি দিনকেই সুররিয়াল মনে হয়।এইরকমই এক দারুণ দাবদাহে,,,,,,,,
না,গরমকাল এমন ছিল না।মোহনবাগানের তরুচ্ছায়ানিবিড় বাগানবাড়ীতে নিমফুলের গন্ধে আমোদিত ভোর হত।আমতেলের দুপুর ছিল।শুঁয়োপোকা ও গন্ধরাজে মিলিত বিকেল,জোনাকরমিত সন্ধ্যা ছিল।তা সেইরকমই এক বিকেলে,অকস্মাৎ ঐ সেই সপ্ততীর্থের গুণ্ডা-নাতিটির আগ্রহাতিশয্যে সমস্ত পাড়াটিকে উন্মথিত করে,আবির্ভূত হলেন,শ্রীশ্রী বালকব্রহ্মচারী।তিনি কত নম্বর বালক তা আমি জানি না।সেই আমার খুব ক্যাসুয়ালি কোনো জীবিত ধর্মগুরুকে প্রথম দেখা।তিনি মঞ্চে বসেছিলেন।পাড়ার লাগোয়া বস্তির বৃদ্ধারা লাইন করে আসছিলেন।প্রণাম করছিলেন,উনি কানে বিড়বিড় করছিলেন।মাইক বাজছিল।তাতে নামকীর্তন হচ্ছিল।

সেই নাতিগুণ্ডাটি গলায় বাঘনখ ঝুলিয়ে,বাবরি চুল ঝাঁকিয়ে,যৌবন ফুটিয়ে পায়চারি করছিলেন।যতদূর মনে পড়ছে,তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি।কারণ সেই সন্ধেতে আমি সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ পড়ছিলাম।ক্লাস থ্রিতেই ভূগোলে তা পাঠ্য ছিল।পরদিন পড়া ধরবেন,রমাদিদিমণি।ভয়ানক সে দিদিমণি।
আমি নাগরিক,বিদ্যায়তনিক,কর্মস্থলিক ইত্যাদি ভাগে এই সন্ধিকালকে নিজেই ভেঙে দেবো।তাই রমাদির কথা পরে শুনবেন।আপাতত,আমার কাণ্ড শুনুন।অনেকক্ষণ পল্লীজীবনকে বিধ্বস্ত করে,নানা ভাবকালি হিল্লোলিত করে শ্রীশ্রীবালক প্রস্থান করবেন।দুই ভক্ত দুদিকে ধরলে।তিনি জোড়াসন থেকে উঠলেন।গৌরবর্ণ ভুঁড়ি দোদুল্যমান হয়ে উঠলো।ঠিক এসময়ে আমি ভূগোল পড়া শেষ করে,দ্বিতীয় রাউণ্ড মারতে গিয়েছিলাম।সেই গুণ্ডা-কাকুটাকে গিয়ে আমি বল্লুম,আমি শ্রীশ্রীর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।তখন,আমি ও চিতের পুত্র পড়াশুনো করি বলে,ওই মুখ্খু পাড়ায় বিশেষ খাতির পেতাম।আমার মা কোন্নগর স্কুলে পড়াতো।কোন্নগর স্টেসনে শ্রীশ্রীবালকের বাণী দেখতাম,নেতাজী আসছেন,আসবেন,এই গোছের।তখন সবে শৈলেশ দের তিনখণ্ড শেষ করেছি।নেতাজীভাবাবেগ নিয়ে কংগ্রেসী চক্রান্ত ভাঙবার জন্য আমি বদ্ধপরিকর হয়েছিলুম।তাই শ্রীশ্রীবালককে হাতের মুঠোয় পেয়ে,এই বিষয়ে একটু আলাপের সুযোগ ছেড়ে দেওয়া,ঘোর অকর্তব্য বোধ করেছিলাম।আমি তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করলুম,নেতাজী বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?তিনি সম্ভবত একটি সুবোধ বালকের কাছে ঈশ্বরভক্তি আশা করেননি।কিন্তু এইরকম প্যাঁচালো প্রশ্নও আশা করেন নি।তিনি বললেন'তুই কি নেতাজীকে চিনিস?'
আমিও এই প্রশ্নে খুব বিহবল না হয়েই বলেছিলুম,চিনি না,পড়েছি।এই না শুনে,শ্রীযুত ব্রহ্মচারী, ঠিক একলাফ দিয়ে বললেন,তবে দ্যাখ,এই সে আমি।আমি বিনা বাক্যব্যয়ে স্থানত্যাগ করি।
বাড়ী ফিরে,খুবই হতাশ হয়ে যখন ভাবছিলাম,নেতাজীর কী হবে,তখন,ভাবাতিশয্যে,বাবাকে এই বিবরণ দিতে গেলুম।বাবা তদুত্তরে আমাকে কান জোরসে মলে,আমাকে বলেছিল,স্থান,কাল,পাত্র বুঝে কথা না বললে ঘোর বিপদ।কিন্তু আমি ততক্ষণে পরিবেশ পরিস্থিতির উপর খুব খচে যাই।আমি তো কোনো অন্যায় করিনি,বিপদও ঘনাই নি।তবে একী নিষেধাজ্ঞা?আর প্রশ্ন না করলে জানবোই বা কী করে।বাবা বিষম রেগে বলল,বই পড়ে জানতে হবে।যেখানে সেখানে প্রশ্ন করলেই নাকি বাড়ীতে পুলিস এসে আমাকে নিয়ে যাবে।সেই থেকেই মনে হয়,ফিল্ডওয়ার্ককে আমি থিওরির থেকে একটু তফাতে রেখে দেখে আসছি।আমার প্রথম ফিল্ডের অভিজ্ঞতা সুবিধের নয়।

গল্প এখানেই শেষ নয়।সাধু ফিরলেন।আমিও আবার আমার ভাবজগতে ফিরে গেলুম।স্কুলে দুজন ঘোর বুদ্ধিজীবী সহপাঠীর সঙ্গে এতদবিষয়ে আলোচনা করতে গেলুম।তারা তো আমাকে আমার রুচি নিয়ে,ছ্যা,ছ্যা করতে লাগল।আমিও খুবই অপ্রতিভ হয়ে পড়লাম।কেন লোকে এমন কাল্পবিকতাকে প্রশ্রয় দেবে,এই মর্মে আমি আনন্দবাজারে একটি জ্বালাময়ী চিঠি লিখে মার সহকর্মী ছায়াবীথি মাসীর হাত দিয়ে কাগজের আপিসে পাঠানোর প্রয়াস পাই।তাঁকেই পাঠাই,কারণ এইজাতীয় বিপ্লবী ক্রিয়ায় আমার মার একটা গোপন উৎসাহ সর্বদাই ছিল।মার থেকে জানা গেল,ছায়াবীথি দেবীর স্বামী আ,বা,পর কর্মী।

সে চিঠি বলা বাহুল্য ছাপা হয়নি।পরেও কয়েকবার পাঠিয়েছি।কখনোই মনোনীত হয়নি।তাতে অবিশ্যি আমার দুঃখ বিশেষ আর নেই।পাপস্পর্শ কমেছে,ভালোই হয়েছে।কিন্তু সেই চিঠিটি পড়ে,মেসোমশাই আমাকে নেতাজীর পিক্টোরিয়াল বায়োগ্রাফি উপহার দিয়েছিলেন।তা আমার আশাতীত ছিল।পরে এক অকালকুষ্মাণ্ড ছাত্র,বইটিতে নজর দেয়।কিন্তু বইটি খুবই আমোদ দিয়েছিল।ক্লাস সিক্সের পর থেকে নেতাজীপ্রীতি,মার্ক্সপ্রীতিতে পরিবর্তিত হল।সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।

কিন্তু কুহকিনী মোহনবাগান কেন্দ্রিক কলকাতা নিত্যনবায়মান আইটেম নিয়ে উপস্থিত হতে লাগলো।ছাব্বিশ নম্বরের ঠিক উল্টোদিকের মাঠে মোহনবাগান ক্লাব খেলতো।আমি সেই মাঠের উপরে গড়ে ওঠা খোপে খোপে বিভক্ত একটি ভাড়াবাড়ীই দেখেছি।তার বাকি অংশে ছিল,ধোপারা।তাদের সঙ্গে অদ্যাবধি আমাদের সখ্য বর্তমান।তাঁরাও অজিতদাক্ষিণ্যে ক্রমশ উচ্চাভিমুখী চলনের অঙ্গীভূত হয়েছেন।পল্লীর হৃদয়হরণকারী সুপুরুষ রজকযুবা,আজ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।তার পুত্র এম,বি,এ পড়ছে।আর ভোঁসেদের(BOSEএর কুল)ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে।তাঁদের সুরম্য সুবিপুল অট্টালিকা ফ্ল্যাটে পরিণত হয়েছে।তাদের বাড়ীর বাহিরঘরে একসেট এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ছিল।মধ্যে মধ্যে সেগুলি নাড়তে যেতাম।সেসব ফালতু ব্যাপার।আদপে সে বাড়ীতে ঘন ঘন আমায় যেতেই হত,গৃহকর্তার স্ট্যাম্প এবং মুদ্রার কালেক্সান দেখতে।আর দেখতে পোর্সিলিনের বিলিতি পুতুল।গৃহকর্তা খর্বকায় ভোঁস সদাশয় মানুষ ছিলেন।সুবিপুল সম্পত্তির একচ্ছত্র অধিপতি হয়েও,তাঁর শরীরে মনে আত্মকুণ্ঠা ছাড়া কিছু ছিল না।আজকের সঙ্গ্রাহক বন্ধুদের দেখলে,আমার তাঁর কথা মনে আসে।তিনি তাঁর বিদেশী আত্মীয়দের চিঠি থেকে স্ট্যাম্পকালেক্ট করতেন।আর কিছু সোর্স ছিল,যেখান থেকে কিনতেন।প্রচুর প্রাচীন মুদ্রা তাঁর সঙ্গ্রহে ছিল।তিনি আমায় অত্যন্ত স্নেহ করতেন।মুদ্রার নেশাটি তিনিই ধরান।আমিও কিছু সঙ্গ্রহ করি।সাত আটবার বাড়ী বদলাতে গিয়ে হারিয়ে গেছে,অনেক।সবই এখন কেনা যায়।কিন্তু মা'র ভাষায় ভিক্ষাবৃত্তি করে জমানো সে কয়েনএলবাম আজ অনেক ফাঁকা।তাঁর অতীব ভদ্র আমার থেকে ছোট ছেলেটি কেন আত্মহত্যা করেছিল,আমি জানি না।তখন আমি কলেজে পড়ি।

ভোঁসেদের বাড়ী থেকে একটু পুবদিকে হেঁটে এসে,বুঁচুদের বাড়ী।বুঁচুর বাড়ীর ছাদে শীতকাল বড় আতুর হয়ে কেটে যেত।তার এক দিদি আসতেন।তাঁর মুখটি শুধু মনে আছে।তিনি সেই ৮২,৮৩ সালে গ্রীমসের রূপকথা উল বুনতে বুনতে বলতেন,এইটুকুই।বুঁচুর জেঠতুতো দাদার অপূর্ব একুয়ারিয়াম ছিল।ওরম একুয়ারিয়াম ভূতকালেও হয়নি,ভবিষ্যতেও হবে না।সেই জলাধার ছিল,একটি ইকোসিস্টেম।বৃষ্টির জল ধরে,শ্যাওলা ধরবার পর,সেই কাচনির্মিত জলাধার বছরে একবার ঘরে ঢুকতো।জল আর বদলাতে হত না।তাতে নিজেই জলজ উদ্ভিদ হত।তারপরে মাছ ছাড়া হত।তিনি রাখতেন হয় ব্ল্যাক এঞ্জেল নয় নিয়নটেট্রা।একটি মাত্র বাবল চলত,তাও লাগত না।কারণ অক্সিজেন প্রাকৃতিক ভাবেই প্রচুর।এঞ্জেলের বাচ্চাকাচ্চা হত।মাছেদের প্লেহাউসগুলি,অতীত ডুবে যাওয়া জাহাজের মত দেখতে লাগত।তিনি আমায় বালি দেওয়া শিখিয়েছিলেন।পেছন থেকে সামনে ঢাল থাকবে।বালি সাদা হলে ভালো।কোন মাছের কেমন স্বভাব জানাতেন।রঙিন পাথর দিলে মাছেদের চোখ নষ্ট হয়ে যায় তা বুঝিয়েছিলেন। কালো বা সাদা পাথর।কাচের ছত্রাক শুধু একদিকে (অর্থাৎ যেদিক দিয়ে দেখা যাবে,সেদিকে)ব্রাস দিয়ে মৃদুভাবে পরিষ্কার করতে হয়,বলেছিলেন।যথাসম্ভব কম মেথিলিন ব্লু ব্যবহার করার নির্দেশ দিতেন।তাঁর ওই বাস্তুতন্ত্রে মাছের পটিও খুব মন দেওয়ার বিষয় ছিল না।কারণ সেসবই বাস্তুতন্ত্রের অধীন।না গোল্ডফিসের মত ঢ্যাবা,কুশ্রী,বিশ্রী ব্যাপার সেখানে ভাবাই অসম্ভব ছিল।কাক্স্বচ্ছ জলে,অজস্র সবুজের মাঝে চার পাঁচটি মসৃণ চিকন এঞ্জেল ডানা ছড়িয়ে উড়ে বেড়াতো।আর কর্ণ বরাবর একঝাঁক নিয়নটেট্রা দৌড়োদৌড়ি করত।আজকের একুয়ারিয়াম সংস্কৃতিও বদলে গেছে।শখ আছে।কিন্তু শখ নিয়ে স্বপ্নপুরী রচনার তাগিদ কম।মনে হয়,পুঞ্জ পুঞ্জ সামুদ্রিক জীব ভরে একটি জলীয় খাঁচাই আজকের আসবাব।আমারো একটা একুয়ারিয়াম ছিল।ক্লাস সিক্সের পর ওসব অযথা উপসর্গ আমিই একদিন কেন জানি না,বুলানকে ডেকে দিয়ে দিই।আমার শৈশবকে আমিই বিদায় করেছিলাম।তবে হাতিবাগান বাজার তখন মাছ,পায়রা,কুকুর,সাপ,শকুন,বাজ,টিয়া,ময়না,খরগোস, এমনকী হরিণ নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসত।


সেই মধুপুরী বিগত।


পর্ব - ৫

জামাইষষ্ঠীই বলুন,আর ন্যাকাষষ্ঠীই বলুন,জীবনে পয়সা না থাকলে কোনোটাই ঠিক জমে না।আধিপত্যবাদ ইত্যাদি ওসব ফিকে হয়ে গেছে,বহু আগেই।যারা মানিকের গল্প পড়েছেন,তাঁরা যে কীকরে,স্নেহ,প্রেম,সহানুভূতি,ভদ্রতা,কোমলতা,দয়া ইত্যাদি সুকুমার বৃত্তির মধ্যে অর্থবল ছাড়া অন্য কিছু খোঁজেন,বুঝে পাইনা।আগে এইসব সুকুমার বৃত্তির প্রয়োজনীয় অর্থাগম হোক,তারপরে নয়,মার্ক্সের তলায় কতটা ফ্রয়েড আর কতটা ফুকো কত শতাংশে আছে,তা দেখব।

সেইটি না দেখে,সমালোচনা,অনুচিত।এইসব দেখে দেখেই আমার জীবন কেটে গেল।বিপুল ধনাঢ্য বা অন্য কারণে সামাজিক মর্যাদায় উঁচু শ্বশুরকুল যখন,জামাইষষ্ঠীতে,জামাইকে অস্বস্তিতে ফেলেন,তার নিখুঁত ছবি কি আপনারা প্রতাপাদিত্যর গল্পে পড়েননি?অথবা জামাইষষ্ঠীতেই গর্বিতা কন্যা,যখন পিত্রালয়ে উপহারসামগ্রী নিয়ে স্বামীসোহাগ দেখান,তখন ছোটকাকা,তার মেয়ের অবস্থা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে,সেই ছবিও কি আমার মনে ভেসে আসেনা?এইসব উদাহরণের উপরিস্তরের আবরণভঙ্গ করতে করতে যখন ভিতরে পৌঁছোবেন,তখন,আধিপত্যের গল্পটি ফিকে।

জামাইষষ্ঠী,ভাইফোঁটা উত্তরে ছিল পাল্টাপাল্টি।উৎসবের সমাজতত্ত্ব নিয়ে আমি ভাবি তো নিশ্চয়ই।লক্ষ করবেন,উত্তরায়ণে,দক্ষিণায়নে এইদুটি ঠিক পালটি উৎসব।একটির দেবতা প্রজননের দেবী ষষ্ঠী,আরেকটির নিয়ন্ত্রক মৃত্যুর অধিপতি যম।ষষ্ঠীর সঙ্গে আছেন,কার্তিকেয়,অন্যদিকে যমের সঙ্গে যমুনা।দুটিই ব্রত।দুটিই যোষিতাকৃত্য এবং দুটিই সংহিতার চূর্ণ দিয়ে তৈরি।একটিতে এবাড়ীর খরচ,আরেকটিতে ওবাড়ীর খরচ।

তা উত্তরের ব্যবসায়ী বনেদি এবং চাকুরিরত বনেদির উভয় উৎসবের গেট আপে একটু ভেদ থাকলেও,অর্থব্যয় একই রকম হত।অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ পুষুমণিদের একটু বিশেষ ছিল।তাঁরা সবই মানবেন,কিন্তু মানবেন না।তাঁদের নানা মজার ক্রিয়াকলাপ ছিল।
মনে করুন,গ্রহণ।বেশ বাবা,তোরা সব গালিলিওর অবতার।তোদের গ্রহণে খেতে আছে।আমাদের নেই।এসব বলে,আপনি ছাড় পাবেন না।ধর্মনিরপেক্ষ, বিজ্ঞানমনস্ক ঘোষবাবুর ছোটবউ (তাঁর দুই স্ত্রী।বড় বউয়ের "বাচ্ছা"হয় নি।)যেন তৈরি হয়েই থাকতেন।গ্রহণ লাগল,এবং তৎক্ষণাৎ তাঁর চিলকণ্ঠে শোনা গেল,'ঠাকুর,নুচি এবার ঘিয়ে ছাড়ো গো'।এর কোনো ব্যতিক্রম দেখিনি।সময়ের উপর,লুচি,জল,বা ভাত নির্ভর করত।অর্থাৎ ওঁকে সারা পাড়াকে জানাতে হত,উনি গ্রহণ মানেন না।তেমনি ছিল,আরেকটি পরিবার।তাঁদের জামাতাপূজাও আছে,ভ্রাতৃপূজাও আছে।কিন্তু কোনোটাই দিনেরটা দিনে নয়।ষষ্ঠীতে ষষ্ঠী,দ্বিতীয়ায় ফোঁটা হলেই যেন গভীর অনর্থ হবে।হয় সাতদিন আগে নয় সাতদিন পরে।কিছুতেই সেই দিনটিতে তাঁদের লোকেরা সময় পায় না।দেখুন আমার মন পাপিষ্ঠ।আমি বুঝি,দিনেরটা দিনে করলে খরচ বাড়ে।

তবে ঘটি কিপটে,বাঙাল খরচে,এই মত অতি অতি অতি সরলীকৃত।সবই অর্থনৈতিক সামর্থ্যের ওপর নির্ভরশীল,এবং আমি বলতে বাধ্য,রুচিসুন্দর শোভনশ্রীর সঙ্গে বাঙালের যোগ একটু কমই দেখেছি।বিশেষত ভাড়াটে বাঙালদের।যতদিন না,কলকাতা দক্ষিণে প্রসারিত হয়েছে,বাঙালরা তীব্র জীবনযুদ্ধে জীবনকে নতুন করে গড়ে তুলেছেন,ততদিন সৌন্দর্যরুচি,বস্তুরুচিতে বিবর্তিত হতে দেখিনি।এবং সাংস্কৃতিক রুচিও তত উন্নত হয়েছে।দমদম,বাঙ্গুর,লেকটাউন সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য।এই বিবর্তন সব পরিবারে একসঙ্গে হয়নি বলা বাহুল্য।এখনো তা হয়ে চলেছে।কলকাতায় উপনিবিষ্ট,সোঁদরবনী,মেদিনীপুরী, পুরুল্যা,মুর্শিদাবাদীদের ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য।

কিন্তু কলকাতার অপচীয়মান ঘটি পরিবারগুলির এইসব অনুষ্ঠানের পারিপাট্যের কথা এখনো লিখিনি।সেসব স্থানে অবশ্যই কালীমাতার টোকো ল্যাংচার বদলে,সেদিন ছ্যাতলাপড়া তালশাঁস আসত।সেনমশাই এর খাস্তাকচুরি কোনোদিনই সাধ্যে কুলোতো না,নলিনী সরকারের মুখের দোকানের রেপসিডে ভাজা আসত,খুব বেশি হলে,কে,সি,গোপের ক্লোরিনের গন্ধওলা ছিবড়ে চমচম আসত,কিম্বা উঠে যাওয়া গোপালের দোকানের অম্বলবিধাতা ঢাকাইপরোটা আর ঘুংনিদানা আসত।সমপর্যায়ের বাঙাল বাড়ীতেও তাই।কিন্তু গল্পটির ভরকেন্দ্র হচ্ছে পরদিনের কিছু আবশ্যক লোকাচার।বড়লোক ঘটি গিন্নিটি প্রতিবেশী কেরানিবউকে পরের দিন জানলা টু জানলা বলবেনই,খোকনের মা,কাল তোমার জামাই এল না গো?
-হ্যাঁগো এলো।
-তাই দেখলুম,খোকনের হাতে গোপালের বাক্স।

এই কথোপকথন কিন্তু নির্বিষ নয়।কারণ ওই বাঁড়ুজ্যের চাকর ঠিক সেসময়েই পাঁচ বাক্স নকুড় নিয়ে হেদো থেকে শ্যামবাজার হেঁটে ফিরেছে।
কিন্তু এটুকু বিষ ছাড়া বাঁড়ুজ্যের বউ,ওমনিতে খুবই উদার হৃদয় ছিলেন।সত্যই তিনি অন্নপূর্ণার মত খাওয়াতেন।পল্লীর বিবিধ বাড়ীতে,এমনকী খোকনের বাড়ীতেও তিনি কারণে,অকারণে প্রচুর খাদ্য পাঠাতেন।কিন্তু ওটুকু বিষ তাঁর দেওয়া চাই।ঐটুকু মেনে নিলে,বাকিটুকু অমের্ত্ত্য।
তা বাঁড়ুজ্যে গিন্নির সঙ্গে আমার বিশেষ সখ্য ছিল।তিনি আদিকালে সংস্কৃতয় এম,এ করেছিলেন।দর্শন তাঁর বিশেষপত্র ছিল।আমি তাঁকে তাঁর বিধবাবস্থায় আমার ছাব্বিশ বছর বয়স অবধি দেখেছি।একটি সাদা চাদরে তিনি মস্তক আবৃত রাখতেন।রামকৃষ্ণদেবের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ছিল।কিন্তু দীক্ষিত ছিলেন না।কিছুটা নাস্তিক্য ছিল।তাঁর বাড়িতে প্রচলিত রীতি মানতেন,কিন্তু অতিপ্রাকৃতে বিশেষ আস্থা ছিল না।তিনি আমাকে নিবেদিতা ইস্কুলের নষ্টামির গল্প বলতেন।পরবর্তী মহাসাধিকারা পূর্বাশ্রমে কেমন লুচি খেতে লুব্ধ ছিলেন,তার গল্প বলতেন।বিবেকানন্দ যে রবীন্দ্রনাথকে ভয়ানক হিংসে করতেন,তা সবিস্তারে জানিয়েছিলেন।
তিনি খুব ভালোবাসতেন মৈত্রেয়ী দেবীর কেচ্ছা করতে।সুরেন দাশগুপ্তর তিনি ছাত্রী ছিলেন।সুরেন দাশগুপ্তর মাথায়,তাঁর বড়মেয়ে ও বড়বৌ কীভাবে গরম জল ঢেলে দিয়েছিলেন,সেকথা বলতে তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠতেন।এই সময় আমি ক্লাস থ্রিতেই মনে হয় পড়ি।নহন্যতে মা পড়ত।আমি বইটি তখনো পড়িনি।বাঁড়ুজ্যে আমায় নির্দেশ দিয়েছিলেন "মোটে পড়বি না।সব ঐ 'ভাবুনে' মেয়ের মিথ্যে কথা"।তাঁর প্রামাণ্যেই আমি স্বর্গের কাছাকাছি,আর মংপুতে রবীন্দ্রনাথ আগে পড়েছি।নহন্যতে পরে।মৈত্রেয়ী দেবী মুজিবের ঘাতক,ডালিমকে আশ্রয় দিয়েছিলেন,এ তথ্য দিতে তিনি খুব আনন্দ পেতেন।

পাড়ার লোকেরা বিশেষত খোকনের মা ষাটোর্ধা বাঁড়ুজ্যের সঙ্গে দশ বছরের আমার কয়েকঘণ্টার দৈনিক ঘষটানির কারণ নিয়ে বিপুল আগ্রহপোষণ করতেন।।সে বাড়ীর অভ্যন্তরে স্কুল থেকে ফিরে,মা ফেরার আগে অবধি আমি আশ্রয় নিতুম ।বাঁড়ুজ্যে রাঁধতেন।আমি তাঁর বিস্তৃত রান্নাঘরে বসে তাঁর বাণী,খাদ্য এবং বিপুল, রূপকথার বইএর সম্ভার গিলতাম।একদম গিলতাম।তাঁর বাড়ীতে তিন আলমারি শিশুপাঠ্য রূপকথা ছিল।তিলু নামে,একটি বেড়াল ছিল।মধ্যে মধ্যে তিলুকে গলায় সুড়সুড়ি না দিলে,বাঁড়ুজ্যের গোঁসা হত।বাঁড়ুজ্যে সারা বাড়ির রান্না সেরে নিজে খেতে বসতেন।সেই পবিত্র ভোজনপর্বের বিবরণ দেওয়া আমার সাধ্যাতীত।ঠিক দুচামচ গোবিন্দভোগ,একটি আলুসেদ্ধ,একটি ছোট বেগুনসেদ্ধ,একচামচ ডাল,এবং এবং তার সঙ্গে এক হাতা গরুর দুধ মিশিয়ে কী যে মণ্ড উনি খেতেন উনিই জানেন।নুন,চিনি,লঙ্কা,লেবুর কোনো স্থান নেই।এই উনি খেয়েছেন,১৯৯৮ এর পয়লা জানুয়ারি অবধি।আমার এম,এ,র রেসাল্ট বেরোবার পূর্বদিন তিনি প্রয়াত হন।তিনি নিজে অসম্ভব ভালো রাঁধতেন।একমাত্র আমার প্রয়াত শাশুড়ি ছাড়া তাঁর হাতেই আমি ভালো খেয়েছি।তাঁদের আদিবাস ছিল শান্তিপুর।শান্তিপুরী সৌজন্যের তিনি প্রতীক ছিলেন।তাকে যদি কেউ কৃত্রিম আতিথ্যের স্থান বলে,আমার অভিজ্ঞতা তার পূর্ণ বিপরীত।



কবি লিখেছিলেন,"প্রলয়সমুদ্রবাহী সৃজনের স্রোতে/নিত্যনব নামরূপ ক্ষণে ক্ষণে ডোবে আর ওঠে"।এই চিত্রকল্প চোখ বন্ধ করে ভাবুন।যদি ঘটে দেশকালবিস্তারী চেতনার বিস্ফারণক্ষমতা থাকে,বুঝবেন,এই সৃষ্টিবিশ্ব ও তার মধ্যে বসে থাকে একলা মানুষের মর্মন্তুদ ও অনতিক্রম্য বিলোপের এমন প্রকাশ,মহাকবি ছাড়া সম্ভব নয়।রবীন্দ্রনাথ নির্বিকল্প বিশ্বাসী ছিলেন না,নির্বিকল্প অবিশ্বাসীও ছিলেন না।অসহায়তায় ভঙ্গুর একটি মানুষ ছিলেন মাত্র,যিনি নিজেকে প্রকাশ করতে পারতেন।সকলেই কিন্তু প্রকাশ করছেন।যে যাঁর মত করে।তাইতো ঐ মহাকবি যিনি মহত্তম পুরুষও বটে,তিনি,অবলীলায় প্রেম ও প্রকাশকে পর্যায়শব্দ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন।ইচ্ছা,ক্রিয়া,জ্ঞানশক্তিতে সদাশিবও নিজেকে প্রকাশ করে চলেছেন।আমরাও আমাদের শক্তির মধ্যে আপনাকেই দেখি,তিনিও তাঁর নিত্যশক্তির প্রকাশিত মহাশক্তিবিগ্রহের মুকুরে নিজেকে দেখেন।

এই দেখার মধ্যেই লুকিয়ে আছে প্রেম।সে প্রেম কীরকম?আমার ওই শক্তির প্রকাশের মধ্যে আমি আছি।আর আমার মধ্যে আমার শক্তি আছে(ন)।এ যেমন বোধেরও বিষয়,তেমনি এ দর্শনেরও বিষয়,তেমনি,ঠিক আমি যেভাবে লিখলাম,ঠিক সেভাবেই পড়লে,এইটি কাব্যতত্ত্বেরও মোস্ট সেকুলার অথচ মোস্ট ইথরিয়াল দৃষ্টিভঙ্গীও বটে।কোনো এক সত্যকারের পণ্ডিত বিদেশী ভারততাত্ত্বিক তন্ত্রদর্শনে প্রেম নেই বললে,আমি তো মানব না।কারণ তিনি ধর্মদর্শনের সঙ্গে তার প্যারালাল কাব্যদর্শনটিতে অধিকারী নন।

হ্যাঁ,আমি গভীর প্রেমের সৃষ্টিসৌন্দর্যে উদ্ভাসিত,সাধারণ মানুষকে দুচোখ ভরে দেখেছি।দেখেছি বলেই,আমি স্বীকার করি,রাজনৈতিক-বিশ্বাসী খোপে আঁটা কিছু সহপাঠীদের সঙ্গে আমি অসোয়াস্তি পেয়েছি,কিন্তু সমগ্র চারণভূমিতে অর্থাৎ ধরে নিন,কলেজস্ট্রীটের মোড় থেকে বাগবাজার বাটা অবধি,গঙ্গা বরাবর,সেণ্ট্রাল এভিনিউ বরাবর,বিধান সরণী বরাবর,কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট বরাবর,সার্কুলার রোড বরাবর,খালপাড় বরাবর,আমার বন্ধুতে ঘেরা ছিল।হয়তো আছেও।তাদের শ্রেণি,বয়স,লিংগ আমার কাছে বিচার্য বস্তু ছিল না।আজ এই বয়সে এসে তার কিছু সুফল পাই বটেক।ঝঞ্জটিও আছে তার।কিন্তু হ্যাঁ,বদমাইশ পাতিবুর্জোয়া হওয়ার থেকে সামন্ততান্ত্রিক হওয়া ঢের ভালো,এই বিবেচনায়,আমি সেসব মেনটেনও করে চলেছি।কিন্তু ওই যে,নিত্য নব নামরূপ ক্ষণে ক্ষণে ডোবে আর ওঠে,সবই তো এক মহানিয়তির খেলা,তাই কখনো কখনো সবই আমি আমার ঈশ্বরকে সমর্পণ করে বসে থাকি।

হ্যাঁ,আমি এই যে আধা-জীবনী লিখতে নামলাম,তার দুটি উদ্দেশ্য আজ স্পষ্ট করে দিই।এক,আমার অফুরন্ত সময়।দ্বিতীয়ত,এই যে আমার পরমাত্মীয়রা পরমসুখে আমাকে লালন করেছেন,তাঁদের প্রকাশবিমর্ষের প্রতি এক বিনম্র প্রণামও আমার কৃত্য।সে প্রণাম,সীমাবদ্ধ ব্যক্তির আপন অস্তিত্বের সীমায় সীমিত হলেও,প্রণাম বটে।
হ্যাঁ,নাম আমি এই পর্ব থেকে একটু ঘেঁটে দিচ্ছি বটে।দেখবেন,ইতোমধ্যেই সপ্ততীর্থর ভাইপোকে আমি নাতি বানিয়ছি। ভাইপো নয়।ভাইএর নাতিই বটে।স্মৃতি ছাড়া অন্য কিছুর উপর ভরোসা করব না বলে,নিজেকে নিজে কথা দিয়েছি।
বাঁড়ুজ্যেগিন্নির কথায় ফিরে আসি।সেই অসামান্যা,তাঁর জীবনের নানা বেড়ি থাকলেও,আমার জীবনকে উঁচু তারে বেঁধে দিয়েছিলেন।তিনি অজস্র বোকা কথাও বলতেন,ভুল ধারণাগত সিদ্ধান্ত করতেন,ঠোকন দিতেন কিন্তু যে হৃদয়বৃত্তি নিয়ে,তিনি সংসার চালাতেন,হয়তো অর্থবানের পক্ষেই তা সম্ভব,কিন্তু থাকলেই তো মানুষ দিতে পারে না।আমি অনেক সিপিয়েম দেখলাম।অনেক সমাজবাদীও দেখলাম।আমার ফ্ল্যাটেই দেখি।কাজের লোককে একটা বিস্কুট দিতে,মুখঝামটা দেওয়া সহকর্মী কলেজে দেখেছি।তারা সবাইই সিপিএম,একথা না বলতে পারলেই খুশি হতাম।কিন্তু,পূর্ণ সামন্ততান্ত্রিক বাঁড়ুজ্যেগিন্নি,যখন,তাঁর চার ঝি চাকরের জন্য চাররকম জলখাবার বানাতেন,এর তরকারি,তো ওর জন্য একটু আলুভাজা,এর চাই একটি ডিম,তো পোয়াতি বাসনমাজার ঝিয়ের জন্য আলাদা একবাটি দুধ,তখন আমার স্কুল,কলেজের অন্য সব বিত্তবান কম্যুনিস্টিকে দেখলে,ওয়াক আসত।

পর্ব - ৬


যে সামান্য একটুখানি আমি লিখছি,তা পড়ে,আমার গূঢ় এক বান্ধবী বলেছেন,এমন ইতস্তত জীবনী পড়িনি।আমি তাতে যারপরনাই সুখী হয়েছি।ইতস্তত,ইতঃ নষ্টস্ততঃ ভ্রষ্টঃ এই জীবন।আজ অবধি আটটা বাড়ী বদলেছি।চারদিকে যা দেখেছি,তা পরস্পর অসংলগ্ন অথচ শাখান্বিত, তাকে বাঁধতে যাওয়া মূর্খতা।তা সম্ভব নয়।অথচ এই সমস্তটুকুর মধ্যে একটি সূত্রসদৃশ আমি আছে।সেই "আমি"কে রাত বাড়লে আমি রোমন্থনের হাতে ছেড়ে দেব ভেবেছি।তবে তাকে নস্ট্যালজিয়া বলবেন না।আমি গতদিনকে কখনোই প্রশান্ত সুন্দর ভাবি না।খারাপও ভাবি না।আমার অবস্থানটা কী হবে,আমি নিজেই ঠিক করে নেব,এত বড় দার্শনিক প্রজ্ঞাও আমার নেই।কর্মফলবাদ,না,ক্ষণভঙ্গুরতা সে কি আমি বুঝব?আমি শুধু অপসৃয়মান স্মৃতিকে মুকুরিত করছি মাত্র।

বাঁড়ুজ্জে গিন্নির কথা বলছিলাম।তিনি সুন্দরী ছিলেন না,কিন্তু সুন্দর ছিলেন।তিনি সবকিছুকেই অত্যুচ্চ ভাবমার্গে নিয়ে করুণা,স্নেহ,নীতি,আদর্শ ইত্যাদি কনস্ট্রাক্টে জীবনকে বেঁধে ফেলতে খুবই পটীয়সী ছিলেন।ফলে সেই বয়সে না হলেও আরেকটু পর থেকে,আমি তাঁকে বোকা-বোকা ভাবতে শুরু করলুম।কিন্তু ভালোবাসার একটি চোখ আছে তো,সেই ভালোবাসা তো আজো ভুলিনি,বলে,লিখছি,তাঁর গল্প।তিনি খাঁটি শান্তিপুরী রান্না করতেন।তাঁর কড়াইশুঁটির খাস্তাকচুরির রেসিপিটি দিই।কড়াইশুঁটি ভিজিয়ে তিনি হালকা সেদ্ধ করে,হাত দিয়ে আধো আধো গুঁড়ো করতেন।দানা দানা থাকত।তারসঙ্গে জিরে,শুকনোলঙ্কার ভাজাগুঁড়ো,একটু লবঙ্গ,একটু জয়িত্রী,আর পরিমাণমত নুন,চিনি,টক(ওসব ভিনিগারের কারসাজি ওবাড়ীতে চলবে না,তেঁতুলের রস)দিয়ে,একটু (বেশি নয়)ঘৃতে সে পুর পাক হত।

গন্ধটি খাসা হত।তারপর খোলে ভরে ভাজা।সেই খোল,সেনমশাই,আর ফেলুমোদকের পক্ষে বানানো অসম্ভব।ময়দায় মোয়াম পড়ত,বেশ বেশি।গরমজল দিয়ে ধীরে সেই ময়দা মাখা হত।তার মাপটি ছিল,এক কেজি ময়দায় দুকাপের একটু কমবেশি জল।সেই ভর্জিত কড়াইশুঁটির খাস্তা কচুরি খাওয়াতে খাওয়াতে,তিনি বলতেন,পূর্ববঙ্গীয় (তিনি বাঙাল বলতেন না।)রন্ধনপদ্ধতিতে ঝোল ঝাল ভালো হয়।কিন্তু ভাজাভুজিটা এদিকের।আমি এসবে অযথা তর্ক করে কোনোদিনই উদ্দেশ্যভ্রষ্ট হইনি।এবার আসি ওঁর মাংসের কাটলেটে।মাংস,সেতো যে সে দোকানের হলে,ওঁর কাটলেট হবে না।

নির্দিষ্ট একটি দোকান ছিল।হাতিবাগানের ওমুখে বেরেলির মাংসর দোকানের কিমার থেকে একটু বড়,কিন্তু কুচো পাঁঠা আসত।বুঝতেই পারছেন,আজকে যাকে বলে স্লাইস।চর্বিও কম থাকত।সে ভেজানো থাকত আটঘণ্টা।নুন,সুপ্রচুর লেবুর রস,রসুন বেশি,পেঁয়াজ কম,এবং কাবাবচিনির গুঁড়ো দিয়ে সিক্ত।উনি ম্যারিনেট শব্দটি জানতেন না।আমি একবার দইএর প্রস্তাব দিয়েছিলাম।উনি বলেছিলেন,'বল,তবে একটু পেঁপেই দিই।কী চাও কাটলেট না ঘ্যাঁট?'কথা বাড়ানোর প্রশ্নই ওঠে না।তারপরে একটু,বেশি নয়,কষিয়ে,ডিমের সাদা অংশে ডুবিয়ে,বিস্কুটগুঁড়োয় সেপ দিয়ে,ভেজে,সেইটি পরিবেশিত হত,সেদ্ধ আলু ও কাসুন্দি দইএর মিশ্রণের সঙ্গে।যেদিন এটি হত,সেদিন বোধয়,সে বাড়ী জনা দশেক নিমন্ত্রিত।আমি সে বাড়ীর সর্বকর্মে উপসর্গের মত বিরাজিত থাকতুম।

নিঃসন্তান বাঁড়ুজ্জে অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ ছিলেন।যত ভাইপো,বোনপো,ইয়েপো,টিয়েঝি তাঁর স্নেহলাভ করেছিল।শেষজীবনে,আমিই সর্বাধিক।আমার বিয়ে তিনি দেখে যাননি।মাত্র একবছরে সেই পরিবার ধূলিসাৎ হয়।আমি তাঁর স্মৃতি হিসেবে,একটি সামান্য আসবাব,আমার কাছে,প্রোমোটেরের চোখের আড়ালে রেখে দিয়েছি।

বাঁড়ুজ্জের কিন্তু এটি পিত্রালয়।অল্পবয়সে বিধবা হয়ে ফিরে আসেন।ফিরে আসার পর সে যুগের এম,এ,পাস।তাঁর শিক্ষকসম্প্রদায় নিয়ে বলবার কিছু নেই।তাঁর বন্ধু ছিলেন,বাংলার দেবীবাবু।দেবীপদ ভট্টাচার্য।তিনি তাঁকে দাদা বলে ডাকতেন।বাঁড়ুজ্জের বছরে এম,এ,তে বাংলায় প্রথম হন,অবন্তীকুমার সান্যাল।দেবীবাবু একবছর সিনিয়র ছিলেন।সেইসূত্রেই পাড়ার মেয়ে বলে,মায়েরা কয়েকজন টিউটর হিসেবে,দেবীবাবুকে পায়।মাসমাহিনা দশটাকা।সে নোট,আমার পেটেই গেছে।বাঁড়ুজ্জের দাদা ছিলেন গৃহকর্তা।দাদা আর বোনের ঝগড়া লাগত,সপ্তাহে একবার।সে যতনা শ্রোতব্য,তার চেয়েও বেশি অনুধাবনযোগ্য।

পাঁড় কংগ্রেসি বাড়ী।আরম্ভ হত,কোনো আদর্শগত ইস্যু নিয়ে।দাদাটি তিনিও এক চরিত্র,তাঁর গল্প পরে বলব।তা,দাদাটি হয়তো জ্যোতিবাবুর নিন্দেমন্দ দশটার সময়ে,গোটা চারেক কাগজ পড়ে শুরু করলেন।তখন বোন,হঠাৎ বললেন,জ্যোতিবাবুর পেন্সান পাই,দাদা,আমি ওঁর নিন্দে শুনবো না।এই বলা মাত্র,তৈলে বার্তাকুনিক্ষেপের মত,দাদা জ্বলে উঠতেন।তিনি বললেন,জ্যোতিবাবুর টাকা,না পাব্লিক মানি?তিনি বলতেন,তা জানিনে।আমি সকালে অন্নদাতার নিন্দে শুনব না।দাদা-ভোট তুই কাকে দিবি?বোন-সেকি তুমি বলে দেবে?এখান থেকে পুরো রগড়।জিনিসটা নামত ক্রমবর্ধমান দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি ও বাজারদরের চুলচেরা বিচারে।এর ফল দাঁড়াতো তিনি দিন কয়েকের জন্য,দুধ কর্ণফ্লেক্সে নেমে আসতেন।এর দিন দুয়েক পরে,তাঁর দাদা,তাঁকে কর্ণফ্লেক্সের দাম,ঐ মণ্ডের থেকে বেশি বললে,আরেকদফা উচ্চগ্রামে ঝগড়া ও রুটিনে প্রত্যাবর্তন।আরেকদিনের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে।আমি সবে,নিজগৃহে বই খুলেছি,কানে ভেসে এলো, "দাদা,তুমি তঞ্চক,বঞ্চক,প্রতারক "।এগুলো সবই এগারোটা নাগাদ শুরু হত।বিপত্নীক দাদার গোদা ছেলেদুটি চাকরিতে বেরিয়ে গেলে।আমি কি আর এই এলিগেসান শুনে থাকতে পারি?অকুস্থলে হাজির হলাম।দেখলাম,কলহের বিষয়,মুরগির দেশী ডিম বনাম পোলট্রির ডিম।দাদা পোলট্রির ডিম চালু করতে চান।তাই বাজার থেকে এনেছেন।বোন তাকে অস্বাস্থ্যকর ভাবেন।ফলে ঐ বাছা বাছা বিশেষণপ্রয়োগ।সেই খাঁটি ঘটিবাড়ীতে কোনো অপশব্দের প্রয়োগ কোনো তুঙ্গ কলহের মুহূর্তেও শুনিনি।তাঁরা নিজেদের বঙ্গীয় পুনর্জাগরণের হিন্দুভার্সান হিসেবেই গড়ে তুলেছেন।কিন্তু লক্ষণীয়,জামাইষষ্ঠী,ভাইফোঁটা ছাড়া,আর আবশ্যক বিয়ে,মুখেভাত ও শ্রাদ্ধ ছাড়া,সেবাড়ীতে কোনো ধর্মাচার ছিল না।তাঁরা কোনো অতিপ্রাকৃতে বিশ্বাস করতেন না।দাদাটি,মহালয়ায়,বাড়ীতে টাঙানো পূর্বপুরুষদের ছবিতে মালা দিতেন।ব্যস।আর দীপাণ্বিতায় প্রদীপ।গপ্প শেষ।

একদিন দেখলাম,গিন্নির ঘরের রবীন্দ্রনাথের ছবিটি তুলে দেওয়া হয়েছে।আমি জিগোলাম।বোন স্থির।চোখে ঠিক দুফোঁটা জল।শোনা গেল,দাদা রবীন্দ্রনাথকে গাল দিয়েছেন। কী কারণ?কারণ,এক ভৃত্যের জ্বর।সে ব্যাটা বৃদ্ধের দেওয়া ওষুধ না খেয়ে হোমিওপ্যাথি খেয়েছে।বৃদ্ধারও তাতে তেমন বিশ্বাস নেই।তবু,মানবাধিকার রক্ষায়,তিনি সে ভৃত্যের হয়ে সওয়াল করতে যান।সেখান থেকে হোমিওপ্যাথির বিজ্ঞান,অসারতা,বায়োকেমিকের অসারতা,রবীন্দ্রনাথের অবিজ্ঞানচর্চা,কবির চিকিৎসার চোটেই নাকি বলুঠাকুর,স্ত্রীর মৃত্যু এতদূর ব্যাপারটা গড়িয়ে গেল।বৃদ্ধ প্রসঙ্গগুলি,খুবই তির্যক কণ্ঠে উপস্থিত করতেন।নাটকীয় প্রত্যুত্তর দেওয়ার জন্য,ভৃত্য এসে,বিশাল দেওয়াল থেকে,একটি বিশাল কবির তৈলচিত্র খুলে বোনের নির্দেশে চিলেকোঠায় পাঠিয়ে দিলেন।এই ঘরে "তাঁর অসম্মান হয়েছে,রে,সে ছবি তোলাই থাক'

আমি এখন বলে থাকি এমন নেকুপনা এক বাঁড়ুজ্জেতেই সম্ভব।
একথা না বলে,উপায় নেই,ভাই বোন উভয়েই সুশিক্ষিত ছিলেন।ভাই কেমিস্ট্রিতে এম,এসসি ছিলেন।কিন্তু তাঁর সর্বগ্রাসী আগ্রহ ছিল।তিনি সাইকোএনালিটিক সভার সদস্য ছিলেন।বোন বলতেন প্রায় প্ল্যানচেট।সে নিয়েও তর্ক চলত।সেই ঝগড়াও আবশ্যক উপসংহারে নামত,রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেটে।বৃদ্ধ ইংরেজি লিখতেন ফাটাফাটি।তাঁর বাবা ফরাসি ও জার্মান জানতেন

নেপোলিয়েনের আত্মজীবনী মূলেই সে বাড়ীতে দেখেছি,পাশে ফরাসীতে সাইডনোট সহ।সমস্ত বই প্রোমোটার একদিন গুঁড়ো করে বস্তা করে নিয়ে গেল।আমি জানি,তাতে তাবৎ রবীন্দ্রনাথ,শরৎচন্দ্র প্রথম সংস্করণ ছিল।



পর্ব - ৭


আমার গূঢ় নর্মসহচরী বললেন,বাঁড়ুজ্জেপিসিমার গল্প তিনি আর শুনতে পারছেন না,তাঁর ঈর্ষা হচ্ছে।কিন্তু তাঁর এই কামগন্ধহীন রতি-ঈর্ষা কাটানো বড় দুঃসাধ্য।সেই বিধবা আমার জীবন গড়ে দিয়েছেন।প্রিয়ে,এই বর্ষায়,যতই তুমি আমায় ফুটবলের পাড়ায়,কতগুলো আধদামড়া,রতিকুশলতাহীন,অবিদগ্ধ অশীলিত যুবকের গল্প বলতে বল না কেন,আমি বলব না।বাঁড়ুজ্জের হাত ধরেই আমার যৌনচেতনা ও যৌনসঙস্কার থেকে চিত্তমুক্তি।সেই গল্প থেকে,উত্তর কলকাতা কতটা গ্রাম্য তা বুঝে নিন।বুঝে নেবেন,সর্বদাই ভিক্টোরীয় শুচিবোধ অসম্ভব বস্তু নয়।এবং এই গল্প ডিটেল এ,শুনুন,আপনারা কোনদিকে যাবেন,নিজেরাই ঠিক করুন।

https://ssl.gstatic.com/ui/v1/icons/mail/images/cleardot.gif
বিপত্নীক ভাই ও বিধবা বোনের সংসার।কয়েকটি অবিবাহিত ভাইপো,ভাইঝি।হাতে টাকা।উচ্চমধ্যবিত্ত জীবনযাপন।দক্ষিণের বাতাসে পাশাপাশি দুটি শোবার ঘর উড়ে যেত।বিশাল লাল মেঝের ঘরে,চারটে করে দরোজা খোলা।দুঘরে ফুটবলের মাঠের সাইজের দুটি প্রাচীন পালঙ্ক।সে রুচিসম্মত পালঙ্ক কিন্তু ওই ছাগলদাড়ি বা গেকুইন কারুর ঘরেই দেখিনি।একটির উপরে মাঝখান দিয়ে মশারি টাঙাতে হত।আরেকটিতে সিঁড়ি বেয়ে উঠতাম।সেই দুগ্ধফেননিভ বিসনায় একটিতে দাদা,বোন দুকোণায় ঘুমোতেন।মাঝে থাকত কোমল বহু পাশবালিশের দূরত্ব।শুতেন তাঁরা ছোট্ট মিষ্টি তুলোর বালিশে।তাঁদের রাতপোষাক বলতে,বাঙালি মহিলা যা পরে শুয়ে থাকেন,তাই,শাটিকা,বেলাউস,সায়া,সেমিজসহ।দাদাটি সুসভ্য পাজামা ও হাতাওলা গেঞ্জি।আমি বৃদ্ধের হাঁটুও কোনোদিন দেখি নি।পাশের ঘরে অনুরূপ বেশবাসে দুটি অবিবাহিত ভাইপো,একটি ভাইঝি।তাঁরা নানা গল্প করতে করতে ঘুমোতেন,বারোটা নাগাদ।উঠতেন ডট ছটায়।হাওয়া মেখে,ফুলের গন্ধ মেখে পরিবারটি তরতাজা হয়ে সকাল শুরু করত।
এই মরূদ্যানে একদিন কীট প্রবেশ করলে।তাদের বহুদিনের রাঁধুনি অসুস্থ হয়ে বছরটাক দেশে বিশ্রাম নিতে গেল।বিশ্রামটা অবিশ্যি এখানেই ভালো হত,কিন্তু আসলে সে নাতি মানুষ করতে গিয়েছিল। ততদিন ওবাড়ীর পক্ষে স্থূলরুচির এক মহিলা নিযুক্ত হয়েছিল।সে ভেবেছিল,যেতে হবে না।

কিন্তু একদিন,সেই পুরোনো ঝি হাজির হলে।নতুনটি যাবে না।ঝগড়া শুরু হল।বৃদ্ধ রেগে গেলে,অশ্লীল নয়,কিন্তু তুইতোকারি করে ফেলতেন।নতুন মাগীও খুব ঝাঁক দিয়ে লাগল।পাড়ার ভাড়াটেকুল তো এসবে থাকবেনই।কমেণ্ট নয়।অনুধাবন।

দাদা বোন দুজনেই লড়ে যাচ্ছিলেন।একে দিয়ে চলছিলও না তাঁদের।
সেই নতুন-মাগী যখন বুঝলে,এবার তো যেতেই হবে,তখন সে একটি ফাইনাল ছোবল দিল।হঠাৎ সে বলল,"হুঁঃ ভাই বোন একবিচানায় শোয়,খুব সব ভদ্দরনোক।"বৃদ্ধ গর্জন করতেও পারলেন না,স্রেফ লাথি,সেই কাজের লোকের সুটকেসে।আর বৃদ্ধা,অকস্মাৎ স্তব্ধ হয়ে,তাঁর দাদাকে বললেন,দাদা,"শুচি হতে হবে,ঘরে চল।"

পাড়া কীরকম মৌনতা নিল,বলবার নয়।মাগীও যেন বুঝলে,ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত দাঁড়ালো।

১৯৮২ ডিসেম্বার।আমি ফোরে পড়ি।আমি এই ঘটনাটিতেই প্রথম বুঝি,শোওয়া একটা ব্যাপার।কিন্তু কী ব্যাপার,কেন ব্যাপার ঠিক বুঝিনি।শোওয়াকে এই প্রথম স্মৃতিধার্য একটি স্পর্শকাতর ব্যাপার জানলুম।শুচি শব্দটিও ভাবালো।বৃদ্ধার করুণ,স্তম্ভিত অথচ পাড়ার লোকের সামনে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ে দৃপ্ত দরোজা বন্ধ করতে দেখলুম।

কিন্তু এরপর আমারো কয়েকটি সংযোজন আছে।শরীর বাদ দিন।বৃদ্ধার শুচিতা প্রশ্নাতীত।সে বাড়ীতে আমার নিত্য গতায়াত।সে বাড়ীই আমার বাড়ী।তাঁদের প্রেমে ও প্রত্যাখ্যানে আমার বড় হয়ে ওঠা।
দাদার কিন্তু বোনের প্রতি স্নেহে একটু রকমফের ছিল।তিনি কিন্তু বোনকে তুই বলে আমার সামনে কোনোদিন তুই বলে ডাকতে শুনি নি।সর্বদা তুমি সম্বোধন শুনেছি।কোনোদিন নাম ধরে ডাকতে শুনি নি।বোন বলতেন,জানিস দাদা আমায় বললেন,(নাম),তুই,,,,,ইত্যাদি।কিন্তু আমি শুনিনি।সম্বোধনহীন,তুমি।রেফার করলে,তোদের পিসি ইত্যাদি।এইটুকু মাত্র।

এছাড়া,বৃদ্ধা প্রয়াত হওয়ার পর বৃদ্ধ আরো দশ বছর বেঁচে ছিলেন।আপনারা বিশ্বাস করুন,বৃদ্ধের ঘরে,বোনের চারটি ছবি ঝুলল,বৃদ্ধ,তাঁর আজীবন ব্যঙ্গের পাত্র রবীন্দ্রনাথের কবিতায় পূর্ণ মনোনিবেশ করলেন।মনে রাখবেন,বৃদ্ধ সাইকোএনালিটিক সভার সদস্য ছিলেন।গিরীন্দ্রশেখর তাঁর বন্ধু ছিলেন।আমি যে পুরাণ-প্রবেশটি ব্যবহার করি,সেটি তাঁর।

এটুকুই গল্প।কিন্তু শরীরী সংস্কার আমার সেই কেটে গিয়েছিল।এর অনেকপরে আমার যে নিকটতম আত্মীয়া সমবয়সী বোনের সঙ্গে আমি খেলেধুলে বড় হয়েছি,তারই সঙ্গে আমার শরীরী সম্পর্কের সম্ভাবনা আছে কিনা ভেবে,আমার এক ইতর আত্মীয়কুল খুব আলোচনা করতেন শুনলুম।তখন "রামনাম সচ হ্যায়"ছাড়া আর কিছু ভাবি নি।

ঈশ্বর আমার প্রতিবেশীকে আমার পূর্বপুরুষ বানানোয়,আমি পুনশ্চ ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।ঈশশ্রুতি,অগ্নি কে আহবান করেছেন,তিনিই সেই পরমবিদ্বান,যিনি আমাদের কুটিল মনকে জানেন,এবং তিনিই আমাদের মনকে যেন সুপথে প্রণীত করেন।আমি অগ্নির কাছে,আমার সেই মৃত আত্মীয়দের জন্য এই প্রার্থনা তাদের জীবদ্দশায় করতে পারিনি।সে আমারই পরাজয়।
পাড়া কিন্তু পরদিন থেকে,এনিয়ে আর ভাবে নি।কিন্তু যৌনতার আরেকটি কেন্দ্র ছিল।পাড়াতেই।তার বিবরণ দেব।সেই মধুচক্র,একবার বিষয়টি আলগোছে তুলেছিল,কিন্তু নিজেরাই ঠিক বিশ্বাসযোগ্য না ভেবে,বেশিদূর এগোতে পারেননি।

"মেঘ ও রৌদ্র"গল্প ছোটোবেলার পর এম,এ তে পড়লুম,তখন সেদিনই বৃদ্ধার সঙ্গে আলোচনা করলুম।তাঁর স্নিগ্ধ মুখচ্ছবি মনে ভেসে আসে।বৃদ্ধ পাশে বসে গুচ্ছের বিবিসি ইত্যাদি গিলতে,গিলতে তখন বলেছিলেন,রবীন্দ্রনাথের সবেতেই ন্যাকামো।হায়।

ই অবধি লিখে পাঠিয়েছিলাম।সঙ্গে সঙ্গে আমার ললিতকলাবিধির প্রিয়শিষ্যাকে পড়তেও পাঠিয়েছিলেম।সে বললে,তার নামও আমি অক্লেশে দিতে পারি।আমাদের এই কন্যা-বন্ধুটি আমাদের অসীম স্নেহেই গত দশবছর আমাদের অঙ্গীভূত।সে আমার ছাত্রোপম।উপরন্তু,সে আমাদের বাড়ীতে এসে,আমার মেয়ের সঙ্গে চটির ভাগ নিয়ে অত্যন্ত সিরিয়াস ঝগড়া করে।তার আরো নানা দাবিদাওয়া থাকে।সেগুলি সবই উচ্চকিত,সুতীব্র,বিষামৃতময় কিন্তু না বাবা,চুলকুনির কোনো উপাদান সে রাখে না।কারণ,সে জানালো,সে সিরিয়ালে,বিধবা ননদের ভূমিকা খুঁজে নেবে ও ঝগড়ার এমন স্ক্রিপ্ট নিজেই বানাবে,তার নাকি অমেয় আকর্ষণ থাকবে।সে অবশ্য আমি নিশ্চিত জানি।

তা সে আমাকে বললে,মাঝে মাঝেই সে আর আমি যে,দুই যোগী ব্যক্তি আমাদের খাটেই ঘুমিয়ে থাকি,মাঝখানে কিছু সাপখোপ অর্থাৎ সুত,মিত,স্কলারদের নিয়ে,তা আমি লিখছি না কেন?এতেও নাকি,আমার মনের পাপ ফুটে উঠছে।এরপর অনেক কথা,সুতোর মত বলতে এসেছিল,আমিও নে বাপ,তুই,আমি শুয়ে থাকি,লিখলে যদি আশু অব্যাহতি পাওয়া যায়,তবে লিখে দিই,এই ভেবে লিখে দিলাম।সে বললে,বড় স্লো।সে আমার সময়ের প্রেসিডেন্সির কেচ্ছায় ঢুকতে চায়।কিন্তু পাড়া না বুঝলে,কলেজ বোঝা যাবে না।যেমন মফস্বল ও ম্যানগ্রোভ অরণ্যানী না বুঝলে,ইউনিভার্সিটি বোঝা যাবে না,তাই অতি ধীরে না এগোলে হবে না।হতাশ হয়ে,সে বান্ধবী পুনশ্চ নানা অভিশাপ দিয়ে ফোন রেখে গেছে।এবং সেও ইনশাল্লাহ,আপন জীবনী লিখবে এবং কোটি কোটি লাইক পাবে বলে হুমকি দিচ্ছে।তা তুই পা,না।ওরে,বমি মানুষ,নিজের কষ্টে করে,নিজের প্রফুল্লতার জন্য।পাঠক উপলক্ষ।

নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি,অবশ্য,যৌনতার অরিগ্যানো দেওয়া,বা যৌনতার জোয়ান দেওয়া,মিয়োনো পিজ্জা খায়।কিন্তু সে বেচারি,এমনই না-জোয়ান,যে তার শুধু খানিক বিদগ্ধ বাক্যি ছাড়া,খাঁটি দিশি মাল দেওয়া অসম্ভব।সুতরাং প্রতিযোগিতা বিশেষ ভয় বা বেগ কিছুই দেয়নি।
আমার পাড়ার গল্প,পড়তে না চাইলে পড়বেন না।

বাঁড়ুজ্জের উল্টোদিকে,একটি বেমানান,বহু কামড়ার,তিনদিক বন্ধ,একটু সরু,এবং পুরো খোপে খোপে ভাড়া বাড়ী আছে একটি।সে বাড়ীর মালিককে আমরা জানি না।তিনঘর ইস্কুল দিদিমণি,তাদের একটি করে স্বামী ও সন্তানসহ ভাড়া থাকতেন।স্বামীরাও,সাধারণ চাকুরি করতেন।তিনঘর আরো ছিল।তাদের কে বাপ,কারা ভাই বোন জানতেম না।তাদের বস্তিতে যাতায়াত ছিল।বাঁড়ুজ্জের বাড়ীর অন্যদের দেওয়া ইনফর্মেসান অনুযায়ী,সে বাড়ীর সবাই নাকি,সোনাগাছি থেকে উপচে,ঘরসংসার করতে এপাড়ায় চলে আসেন।কিন্তু ওই একটি বাড়ীতেই কেন।তিনজন ইশকুল টিচার ছিলেন।তাঁরা সোনাগাছি থেকে ইশকুলে পৌঁছোলেন কী করে?

স্বামীগুলি সামান্য চাকরি করতেন।বাজার,জলতোলা,কাপড় কাচা ইত্যাদি কাজেই সময় যেত।তাদের বেশি বয়েসও ছিল না।হঠাৎ তারা সোনাগাছি কী করেই বা গেল,আর এখন কেন যায় না,সন্ধেবেলা,আলো জ্বেলে ছেলে পড়ায়,এসব প্রশ্নের উত্তর নেই।তবে বাকি তিনটি ঘর নিয়ে প্রশ্ন আছে।তারা ওদিকের লিনিয়েজ নিয়ে আসতে পারে,এবং পরে দেখা গেক,ক্রমে ওই তিনটি পরিবার উঠে গেল।ফ্ল্যাট কিনে কেউ চলে গেল।একজনের মেয়ে মরল।একজনের ছেলে বখল।আর বস্তি কানেক্টেড তিনদল রয়ে গেল।এই বাড়ীটি কিন্তু পাড়ায় মোটেই রসভঙ্গ ছিল না।তারাই পাড়ায় সোচ্চারে থাকত।বাঁড়ুজ্জেই,তার লটবহরে একটু দূরে থাকতেন।কিন্তু এঁরাই ব্যস্ত পাড়ার পথের পথিক।পঙ্কেই পদ্ম ফোটে।সে বাড়ীতে ছিল মিনুদি।তার উৎস বোধয় খুব সুবিধের নয়।পরে তার বিয়ে হয়।ওবাড়ীতেই থাকত।ছেলে হল।তাকে পড়াতো।মীনুদির হাতের কাজ খুব ভালো ছিল।তার সঙ্গেও আমার স্নেহের সম্পর্ক ছিল।ওই বাঁড়ুজ্জে একদিন দৈনন্দিন ঠেসাঠেসিতে তাদের ছোটো করে।বুড়ো তখন স্প্যান পড়ছিলেন,পষ্ট মনে আছে।তখন আমি বৃদ্ধকে একটি নাতিদীর্ঘ ভাষণ দিই।সেই ভাষণে বৃদ্ধ চুপ করে থাকলেও,বৃদ্ধা খানিক হিজিবিজি বলে,তার দাদাকে জাস্টিফাই করতে আসেন।এ অবশ্য,আমার কলেজ জীবনের ঘটনা।ততদিনে আমার শোনার অবস্থা চলে গেছে।এক,দুজন ছাড়া সবার বক্তিমে শুনবার মত,মফস্বলী রাজনৈতিক ধৈর্য আমার ততদিনে চলে গেছে।



এই বেনামী সোনাগাছিবাড়ীর ঠিক উল্টোদিকে সান্যাল না বাগচী,একঘর বারেন্দ্রর বাস ছিল।তার পিছনের বাড়ী,টি,সি,আড্ডির বাড়ী।সেখান হলে,সন্ধে ঘন হলে শুনতাম,কালা আমায় বাঁচা।তখন আরেকটু বড়।

No comments:

Post a Comment

Bottom Ad [Post Page]

To Place your advertisement here call - +917980316633/+918145704098