লেখক – শুভাঞ্জন বসু
প্রচ্ছদ – সন্দীপন বেরা
দেখা আর না দেখার মাঝের অদ্ভুত ভানের মুঘ্ধতায় ডুবে গেল ভারতী। থাকুক আরো খানিক্ষণ ঠিক এভাবেই।
এদিকটায় খুব একটা আসা হতনা কয়েকদিন আগে অবধিও। পার্টির কাজে যাদবপুর এলাকাতেই বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দেয়। কয়েকদিন আগে এসেছিল পার্টির একটা বই অপূর্ববাবু কে দিতে। ভদ্রলোক অদরকারে অনেক কথা বলেন। মাথা ধরে গেছিল শিতাংশুর। তাই খানিকটা জিরোনোর জন্যেই একটু এসে বসেছিল পার্কের এখানে।
মেয়েটা প্রতিদিন চারটে নাগাদ আসে পার্কে। শিতাংশু আজ তাই চলে এসেছিল একটু তাড়াতাড়ি। আসার পর থেকে পাঁচ কাপ চা আর তিনটে সিগারেট শেষ হয়ে গেছে এর মধ্যেই। ভেবেছিল আজ বোধ হয় আর আসবে না মেয়েটা। কিন্তু এসেছে। আধ ঘন্টা আগেই এসেছে ও। এখন বসে আছে সামনের বেঞ্চটায়। ওই স্বপ্ন ভরা পৃথিবীটায়। মেয়েটা কি একবারও ঘুরে তাকিয়েছে ওর দিকে? ও কি আদেও জানে শিতাংশু অপেক্ষা করে ওর জন্যে প্রতিদিন এখানে। জানে না হয়তো। কিন্তু আজ জানা অজানার গোলক ধাঁধায় আর ঘুরতে চায়না শিতাংশু। আজ তো ওর জন্মদিন। জন্মদিনে অনেক দোষ মাফ করা যায়, তাই না?
ছেলেটা কোথায়? ল্যাম্প পোস্টের পাশটা ফাঁকা। চলে গেল নাকি? যাহ, শেষ একবার দেখবে ভেবেছিল, এই সব ছাইপাশ ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন চলে গেল হঠাৎ।
৪
ভারতী আর হাসি চাপতে পারলো না এবার। চিত্কার করে হেসে উঠলো শিতাংশুর সামনেই। শিতাংশু বুঝে উঠতে পারছিলো না কী হয়েছে ওর।
কেউ আসেনি। ভারতী বুঝে গেছিল এটাই তার কাজ। এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার আর কোনো মানে নেই কারোর কাছে। গ্রামের বাড়ি, বাবা-মা, বোন, এসব আটকে দিয়েছিল এখানে। আটকে দিয়েছিল রাজপুত্র আসার রাস্তাটাও। ভাবনাগুলো পাল্টাতে পাল্টাতে এমন করেই হঠাৎ আমরা বড় হয়ে যাই, তাই না?
ভাবতে ভাবতে গলার কাছটা ভারী হয়ে এলো ভারতীর। শিতাংশু তখনও একভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। হেসে ফেললো ভারতী। কী’সব ভেবে ফেললো এতক্ষণে। ইস, ছেলেটা নিশ্চই ওকে পাগল ভাবছে এখন। ও রেশ কাটানোর জন্যে আবার জিজ্ঞাসা করলো- ‘বললে না তো, কে তুমি? এখানে কেন এসেছো?’
ভারতী জিজ্ঞাসা করলো- ‘কী যেন বলছিলে?’
ভারতী চায়ে চুমুক দিয়ে বলল- ‘তুমি জানো আমি কে। আমি কী করি?’
শিতাংশু চা’টা একঢোকে শেষ করে হাটু গেড়ে বসলো ভারতীর সামনে। তাকালো ওর দিকে। তারপর বললো- ‘কেন বারবার তুমি এমন ভাবে ভাবছ। আমি দেখেছি তোমাকে এভাবেই মন খারাপ করে বসে থাকতে? কিসের জন্যে এত যন্ত্রণা ভোগ করছ তুমি? কেন এত অভিনয় করে চলেছো দিনের পর দিন? আমি আছি, আমরা আছি। ঠিক কোনো পথ বেরিয়ে যাবে। নতুন কোনো পথ। ভারতী আমার লোকের ভয় নেই। কে কী ভাবলো তাই নিয়ে আমি কোনদিন ভাবিনি আর ভাবতে হবেও না কোনদিন। তুমি একবার বিশ্বাস করো আমায় ঠিক তোমাকে সুন্দর করে দেবো আবার। কেউ কিচ্ছু বলবে না বিশ্বাস করো। একদিন সবাই আবার ঠিক তোমাকে আগের মতই ভালবাসবে।’
শিতাংশু পাশে বসেই দেখলো ভারতীর গাল দিয়ে একটা নদীর মতন জল গড়িয়ে পড়ছে নিচের দিকে। শিতাংশু ধীরে ধীরে হাত রাখল ভারতীর হাতে। ভারতী সামলে নিল নিজেকে। চোখ মুছেই বললো- ‘চলো, ওই দিকটা থেকে একবার হেঁটে আসি।’
দোকানদার টাকাটা একবার ভালো করে দেখে সামনে টিনের বাক্সটায় ফেলে ফোনটা তুলে নিলো হাতে। তারপর কল লাগিয়ে বলল- ‘ভারতী মেয়েটাকে চিনিস?’
-‘বাড়ি কখন ফিরবে?’ – রাস্তায় হাটতে হাটতে শিতাংশুকে জিজ্ঞাসা করলো ভারতী।
শিতাংশু কী উত্তর দেবে বুঝে উঠতে পারলনা। উত্তর না দেওয়ার আনন্দটা আজ প্রথম অনুভব করলো ও। ভারতীও মনে করে উঠতে পারলো না শেষ কবে এই ভাবে বকা-বকি করেছে কাউকে। মনে পড়ছে না। শেষ যতদুর মনে পড়ে ততদূরে ও শুধু দেখতে পায় শরীরের অঙ্গভঙ্গিতে আগুন এগিয়ে দিচ্ছে কোনো এক মাঝ বয়েসী ভদ্রলোক কে। লাল চোখ, ঘামের গন্ধ আর ক্ষিদে। ভীষণ ক্ষিদে নিয়ে তাকিয়ে আছে ভারতীর দিকে।
না, এখন আর এসব ভাবতে ভালো লাগছে না ভারতীর। শিতাংশু হাটছে এক মনে। ছেলেটার সাথে আরো অনেকক্ষণ গল্প করতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু কী প্রশ্ন করবে? কী জানতে চাইবে? কতটাই বা সময় বাকি ভারতীর কাছে? পালিয়ে যাবে এখান থেকে? অন্য কোথাও। যদি শিতাংশুর কথা ঠিক হয়। যদি আবার নতুন করে শুরু করা যায় সব।
সময়গুলো কি দ্রুত কেটে যাচ্ছে আশপাশে। কি তাড়াতাড়ি রাত বাড়ছে কলকাতায়। শিতাংশুর দিকে তাকালো একবার। গুনগুন করে কি একটা গান গাইছে যেন। ভারতী জিজ্ঞাসা করলো-‘তুমি কি নিজে থেকেই এসেছো আমার কাছে নাকি তোমাকে পার্টি থেকে পাঠিয়েছে?’
শিতাংশু খানিকক্ষণের জন্যে বুঝে উঠতে পারছিলনা কথাটার মানে। তারপর যখন বুঝতে পারলো তখন একসাথে হো হো করে হেসে উঠলো দুজনেই। শিতাংশু হাসতে হাসতেই জিজ্ঞাসা করলো- ‘খুব গন্ধ ছেড়েছে না? অনেকদিন ধোয়া হয়না।’
ভারতী বুঝতে পারছিলো ব্যাপারটা অন্যদিকে গড়াচ্ছে। ও শিতাংশুকে বলল-‘তুমি প্লিজ চুপ করে এখান থেকে চলে যাও। আর এসো না এদিকটায়। আর বাড়িতে বোলো আমি ভালো আছি।’
চারজন এবার একসাথে চিত্কার করে হাসা শুরু করলো। একজন বলল- ‘পুলিশ ডাকবি? পুলিশ কেন? আর্মি ডাক। তোর বাপ মা সবাই কে ডাক। শালা ক্যালানে কার্তিক। এখানে এসে মেয়ে পালানোয় উস্কাবে? তাও একটা বেস...’
একটা গুলির আওয়াজ, হাজারটা গুলির আওয়াজ, বোমা কামান ধ্বংসের আওয়াজ অথচ কেউ ফিরেও তাকালো না একবার।
রাতের ব্যস্ত কলকাতা ছুটছে নিজের খেয়ালে। রাস্তায় বুকে হাত দিয়ে শোয়া শিতাংশু। যন্ত্রনায় চোখ থেকে জল বেরিয়ে এসেছে ওর। লোকগুলো আর দাড়ালো না। সবচেয়ে বয়েস বেশি যার সে তখনই ওখান থেকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিলো খুনিকে। কয়েকদিন আন্ডারগ্রাউন্ড তারপর আবার খুন।
রাস্তাটা ফাঁকা। ভারতী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শিতাংশুর দিকে। এই ছেলেটা একটু আগেও দেশ পাল্টানোর স্বপ্ন দেখছিল।
আর নেই।
ল্যাম্পপোস্টের আলোটা সোজা এসে পরেছে শিতাংশুর মুখে। ভারতের সব আলো যেন এসে মিশছে শিতাংশুর মুখে।
নিস্তব্ধ। ভীষণ নিস্তব্ধ হয়ে গেছে আশপাশ।
ভারতী আর ওর সামনে পরে থাকা শিতাংশুর লাশ।
ভারতী বুঝে উঠতে পারছিলো না এবার কী হবে? কী করবে এবার? খানিক্ষণ দাড়িয়ে ছুটতে শুরু করলো ও। শহর পেরিয়ে আরো একটা শহরে, সেখান থেকে অন্য কোনো একটা গ্রামে, সেই গ্রামের মধ্যে দিয়ে জঙ্গল পাহাড় সমুদ্রের মাঝে। যেখানে চিত্কার করে কাঁদলে কেউ এসে বসবে ওর পাশে। ওর কথা শুনবে। জানতে চাইবে ওর যন্ত্রণার কথা। চোখের জল মুছে দৌড়তেই থাকলো ভারতী। পৌছতেই হবে। খুজতেই হবে সেই মানুষটাকে। এই হাজার হাজার মুখোশের ভিড়ে যাকে অনেকটা শিতাংশুর মতো লাগে।
প্রচ্ছদ – সন্দীপন বেরা
১
ছেলেটা এখনো ওখানেই দাড়িয়ে আছে গত কয়েক দিনের মতন। লাল রঙের পাঞ্জাবি, এক গাল দাঁড়ি, উস্কোখুস্কো চেহারা। কেন ওখানে দাড়িয়ে থাকে প্রতিদিন, এখনো বুঝে উঠতে পারেনি ভারতী। বোঝার চেষ্টাও করেনি তেমন।
শোভাবাজারের এই দিকটায় তেমন খদ্দেরদের ভীড় থাকেনা দুপুরের দিকটায়। ভারতীও তাই এদিকে এসে পার্কে বসে খানিক্ষণ জিরিয়ে নেয়। ভালো লাগে। চুপ করে বসে থাকার স্বাধীনতাকে তিলে তিলে অনুভব করার তৃপ্তিটাই আলাদা। চিত্কার আছে কিন্তু ব্যস্ততা নেই, কোলাহল আছে কিন্তু দামদর নেই। এই জায়গাটা তাই বরাবর নিজের মনে হয়েছে ভারতীর।
কিন্তু গত প্রায় সাত কি আট দিন হবে, বা তার একটু বেশি হয়তো, ছেলেটাকে রোজ ওখানে, একই ভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখছে ও। অন্য কোনদিকে তাকিয়ে থাকে কি। না তা নয়। গত পরশু বেঞ্চ থেকে উঠে গিয়ে দেখেছে ও। ছেলেটাও ঠিক বেরিয়ে গেছে তখন। তারপর দিনও ঠিক এক।
আজ তাই আসার আগে বারবার ভাবছিল ভারতী। কে ও! কেন এসে দাড়ায় ওখানে! কী দরকার ভারতীর সাথে!
কিচ্ছু বুঝে পায়নি। কিংবা বলা ভালো বুঝতে চায়নি ভারতী। কতদিন পর! সে প্রায় ছ-সাত বছর তো হবেই। ঠিক এ ভাবে ওর জন্যে গ্রামের পুকুরপাড়ে অপেক্ষা করতো সূর্য।
ভারতীও বুঝতে পেরেছিল এই ছেলেটাও, ওর জন্যেই দাড়িয়ে থাকে পার্কের শেষ দিকটায়। আজ এখানে আসার আগে তাই বারবার ভাবছিল ভারতী। যাওয়াটা কি ঠিক হবে? ছেলেটাকে কি আদতেও সে চেনে? কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। কিন্তু বারবার শুধু মনে হয়েছিল যাওয়া দরকার। প্রচন্ড ভাবে যাওয়া দরকার পার্কে।
দূর থেকে শুধু দেখে নয়, দেখানোর আনন্দটা আজ ভীষণ ভাবে পেতে চাইছিল ভারতী।
এখনও দাড়িয়ে আছে ওদিকটায়। লাল পাঞ্জাবি, এক গাল দাঁড়ি। একটা সিগারেট খাচ্ছে ছেলেটা। এদিক ওদিক দেখছে। মন্দ নয়। এমন ভাবে কেউ দেখুক অনেক দিন ধরে চেয়েছিল। দেখুক না। প্রাণ ভরে দেখুক। কাছ থেকে দেখানোয় আজকাল তেমন আর ভালো লাগে না ভারতীর। মানুষগুলো হিংস্র পশুর মত ব্যবহার করে সামনা সামনি এলে। দুরেই ভালো। যতদুরে রাখা সম্ভব। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ছেলেটা ঘুরে তাকালো ভারতীর দিকে।ভারতী মুখ ফিরিয়ে নিল।
দেখা আর না দেখার মাঝের অদ্ভুত ভানের মুঘ্ধতায় ডুবে গেল ভারতী। থাকুক আরো খানিক্ষণ ঠিক এভাবেই।
ভারতী, কলকাতার এক বারবনিতার নাম।
২
সিগারেটটা পায়ে ঘষে আগুনটা নেভালো শিতাংশু। ঘড়ি পড়ে আসেনি আজ ইচ্ছে করেই। আজকের দিনটা খুব ইচ্ছে ছিল রূপকথার মতন কাটানোর। অনেকদিন বাদে জন্মদিনটা এমন রঙিন লাগছে শিতাংশুর। মেয়েটার নাম জানে না। কিন্তু জানে মেয়েটা প্রতিদিন আসে এখানে। প্রতিদিন অপেক্ষা করে। ওর জন্যে কিনা জানে না। জানতে চায়ও না।
এদিকটায় খুব একটা আসা হতনা কয়েকদিন আগে অবধিও। পার্টির কাজে যাদবপুর এলাকাতেই বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দেয়। কয়েকদিন আগে এসেছিল পার্টির একটা বই অপূর্ববাবু কে দিতে। ভদ্রলোক অদরকারে অনেক কথা বলেন। মাথা ধরে গেছিল শিতাংশুর। তাই খানিকটা জিরোনোর জন্যেই একটু এসে বসেছিল পার্কের এখানে।
তারপর হঠাৎ করেই। হঠাৎ করেই মেয়েটাকে দেখেছিল শিতাংশু। মেয়েটা বসেছিল চুপ করে। কোনদিকে না তাকিয়ে। এমন ভাবে না তাকিয়েও যে বসে থাকা যায় সেটাই প্রথম বার অনুভব করে ছিল শিতাংশু। কি অসম্ভব সুন্দর দেখতে মেয়েটা। কি অসাধারণ চোখ! ওকে ছেড়ে শিতাংশু যেতে পারেনি পার্ক থেকে। আর পাঁচ টা ছেলের মতই। বসে ছিল। অনেকক্ষণ। যতক্ষণ মেয়েটাকে দেখা যায়।
নিশ্চুপ মেয়েটার মুখ। কত কথা যেন বলার বাকি। ফেলে আসা অনেক অনেক স্মৃতি জমে আছে মেয়েটার ভেতর, কিন্তু শোনার মত কেউ নেই। শিতাংশু শুনতে চেয়েছিল সব। প্রাণ ভরে। তাই একটা মুহুর্ত, শুধু একটা মুহুর্তের অপেক্ষা করে গেছিল অনেকক্ষণ ধরে। সেদিন হয়নি। তারপর আরো বহুদিন হয়নি। কিন্তু আজ হবেই জেনে এসেছে। এই জন্মদিনটা এই ভাবেই কাটাতে চেয়েছে ও। নতুন ভাবে, একদম নতুন একটা মানুষের সাথে। যার সাথে কোনদিন কথা হয়নি, আর কোনদিন কথা হবে কিনা তাও জানে না।
মেয়েটা প্রতিদিন চারটে নাগাদ আসে পার্কে। শিতাংশু আজ তাই চলে এসেছিল একটু তাড়াতাড়ি। আসার পর থেকে পাঁচ কাপ চা আর তিনটে সিগারেট শেষ হয়ে গেছে এর মধ্যেই। ভেবেছিল আজ বোধ হয় আর আসবে না মেয়েটা। কিন্তু এসেছে। আধ ঘন্টা আগেই এসেছে ও। এখন বসে আছে সামনের বেঞ্চটায়। ওই স্বপ্ন ভরা পৃথিবীটায়। মেয়েটা কি একবারও ঘুরে তাকিয়েছে ওর দিকে? ও কি আদেও জানে শিতাংশু অপেক্ষা করে ওর জন্যে প্রতিদিন এখানে। জানে না হয়তো। কিন্তু আজ জানা অজানার গোলক ধাঁধায় আর ঘুরতে চায়না শিতাংশু। আজ তো ওর জন্মদিন। জন্মদিনে অনেক দোষ মাফ করা যায়, তাই না?
আজ শুধু কথা বলতে চায় মেয়েটার সাথে। একবার। বহুবার। সারা দিনরাত জুড়ে।
ও এগিয়ে গেল একটু। লাজুক তকমা প্রাপ্ত ছেলেটা আজ এগিয়ে গেল নতুন পরিচয়ের দিকে। যা হবে দেখা যাবে পরে। এখন শুধু পাশে থাকতে ইচ্ছে করছে মেয়েটার।
শিতাংশু এগিয়ে গেল একটু নিজের জায়গা ছেড়ে। এগিয়ে গেল নতুন অজানা অচেনা একটা দেশের পথে।
৩
ভারতী অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল ছেলেটার দিকে। আপন মনে কি যেন বেশ ভাবছিল। মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিল ওর দিকে। ভারতী মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল ততক্ষনাৎ। না ঘোরালেই বা কি ক্ষতি হত জানা নেই, কিন্তু করে ফেলছিল ও। সহজাত প্রবৃত্তি বোধহয় একেই বলে। নতুন প্রেমের মজাটা কুঁড়েকুঁড়ে নিচ্ছিল ভারতী ওর নিজের মধ্যে। আবার তো ফিরে সেই এক ঘর। সেই এক লাল আলো আর নীল আলোর মিলন, সেই এক শরীরের সাথে মিলমেশ। অভ্যেস। এখন এসব অভ্যেসে দাড়িয়ে গেছে ভারতীর। তেমন কষ্ট হয়না আর। ও জানে এরা নেশার ঘোরেই তাকে চায়। নেশার ঘোরেই সবাই তাকে নিংড়ে খায়। তারপর নেশা কেটে গেলেই আবার সকালের বাজার করে বাড়ি ফিরে বলে- 'অনেক কমে ইলিশ পেয়ে গেলাম আজ বাজারে'। চেনা হয়ে গেছে এদের বহুদিন আগেই।ভারতী তাই নতুন কিছু খুজতে যায়না আর ওদের মধ্যে।
ছেলেটা কোথায়? ল্যাম্প পোস্টের পাশটা ফাঁকা। চলে গেল নাকি? যাহ, শেষ একবার দেখবে ভেবেছিল, এই সব ছাইপাশ ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন চলে গেল হঠাৎ।
ভারতী উঠে সিট্ ছাড়বে ভাবছে এমন সময় দেখতে পেল সামনের একটা দোকান থেকে সিগারেট কিনে ছেলেটা এগিয়ে আসছে ওর দিকেই।
অনেকদিন বাদে বুকটা ধুঁক করে উঠলো ভারতীর। কি অদ্ভুত আনন্দ নাহ এটার! কি নতুন সব! প্রতিদিন ভালো লাগে যা। ভারতী একবার ভাবলো উঠে বেরিয়ে যায়। কোন মুখে সামনা করবে ওর? ছেলেটার যদি কোনোভাবে ভালো লেগে থাকে ভারতী কে? কি বলবে? সে আসলে দেহ নিয়ে ব্যাবসা করে এখানে? আর কিছু মাথায় আসছে না ভারতীর। অনেকটাই সামনে এসে পরেছে ছেলেটা।
কী বলবে কী না বলবে ভাবতে ভাবতেই আস্তেআস্তে সামনে এসে দাড়ালো লাল পাঞ্জাবি পরা ছেলেটা। হাতে তখনও অর্ধেক খাওয়া সিগারেট।
কত কী ঠিক করে রেখছিল বলবে। ভাবছিল বলবে ছেলেটাকে চলে যেতে এখান থেকে বহুদূরে। কারণ সে জানেও না ভারতী কে? ভারতী কী? জানলে অন্তত ওর সামনে এসে দাড়াতো না কোনদিন। জানে না বলেই এই সহজ সরল দেখতে ছেলেটা হাসতে হাসতে এসে দাড়িয়েছে ওর চোখের সামনে।
-‘এত সিগারেট খাও কেন তুমি?’ এত কিছু ভেবে শুনে শেষ পর্যন্ত বোকার মতন এই প্রশ্নটা করে বসলো ভারতী।
শিতাংশু এক মুহুর্তের জন্যে অবাক হয়ে গেল। গত সাত দিনে নিজের মনেই ও ঠিক করে রেখেছিল কী বলবে কী না বলবে, কোন প্রশ্নের কী উত্তর দেবে। কিন্তু একবারের জন্যেও এই রকম প্রশ্নের কথা ভেবেও দেখেনি ও।
অবাক হয়ে খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর শিতাংশু বলল- ‘এত? না... মানে আসলে... ওই চাপের মুখে’
কথা গুলো গুছিয়ে উঠতে পারছিলো না কোনো ভাবেই।ভারতী এবার হেসে ফেলল হঠাৎ। এরকমও ছেলে আজকাল আছে নাকি! হাসতে হাসতেই জিজ্ঞাসা করলো- ‘তোমার নাম কী’
-‘শিতাংশু। শিতাংশু রায়’
-‘এইখানে প্রতিদিন এসে দাড়িয়ে থাকো কেন। তোমাকে দেখে তো ভালো ছেলে বলেই মনেই হয়’
-‘আচ্ছা, আমি তাহলে চলেই যাই এখন।’
ভারতী আর হাসি চাপতে পারলো না এবার। চিত্কার করে হেসে উঠলো শিতাংশুর সামনেই। শিতাংশু বুঝে উঠতে পারছিলো না কী হয়েছে ওর।
নিজেকে এত ভয় পেতে ও কোনদিন দেখেনি। পার্টির স্লোগানে সব সময় নিজের তাগিদেই গিয়ে দাড়িয়েছে সামনের সারিতে। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে উদ্দাত্ব কন্ঠে ঘোষণা করেছে লড়াই এর কথা। থানা পুলিশ গুন্ডা কিছুরই পরোয়া করেনি কোনদিন।
কিন্তু আজ কী হলো ওর? কেন এমন বারবার আটকে যাচ্ছে কথা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল ভারতীর দিকে। ভারতী তখনও হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। ভারতী জিজ্ঞাসা করলো- ‘ধুর, পাগল এত ভয় পাওয়ার কী আছে আমায়।’
-‘ভয়তো আমি পাইনি। আমি আসলে এদিকটায় এসেছিলাম।।।’ কথা শেষ করতে পারলো না শিতাংশু। তার আগেই ভারতী আবার জিজ্ঞাসা করে বসলো- ‘তোমাকে আমি বহুদিন ধরেই দেখছি। কী করতে আসো এখানে।’
ভারতী তারমানে দেখছে ওকে প্রতিদিন। ঠিক ওর মতই। আর শিতাংশুতো দেখাতেই চেয়েছিল প্রতিদিন। আর চুপ করে থাকা নয়। আজ বলে দিলেই হয়। বলে দেওয়াটাই দরকার। ভীষণ ভাবে। শিতাংশু আস্তে আস্তে মাথা তুলে তাকালো ভারতীর দিকে। ওই চোখ দুটো। ওই চোখ দুটোর জন্যই সব জেনেও মেতে উঠেছে খেলা ভাঙার খেলায়। চুপ করে থাকলো খানিক্ষণ শিতাংশু। তারপর কেটে কেটে খুব ধীরে ধীরে বলল- ‘আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি এখান থেকে।’
এই একটা কথার জন্যে গত হাজার বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে ভারতীরা। প্রতিদিন, প্রতিমুহুর্তে।
৫
‘তুমি কে বলোতো ’-জিজ্ঞাসা করলো ভারতী।
বহুদিন চেয়েছে এইভাবে কেউ এসে নিয়ে যাক ওকে। চেয়েছে বলা হয়তো ভুল হবে। চাইতো। বহুদিন আগে। এখন আর চায় না। এখন আর অপেক্ষায়ও থাকে না কারোর। প্রথম দিকে খুব মনে হতো- পালিয়ে যাবে এখান থেকে। তারপর আস্তে আস্তে পাল্টে যাচ্ছিল মনে হওয়া। তখন মনে হতো কেউ হয়তো রাজকুমারের মত এসে নিয়ে যাবে ওকে। এই স্বপ্ন দেখেই নির্দ্বিধায় ঢুকে পরতো লাল-নীল রঙের যন্ত্রণাময় ঘরটায়।
বহুদিন চেয়েছে এইভাবে কেউ এসে নিয়ে যাক ওকে। চেয়েছে বলা হয়তো ভুল হবে। চাইতো। বহুদিন আগে। এখন আর চায় না। এখন আর অপেক্ষায়ও থাকে না কারোর। প্রথম দিকে খুব মনে হতো- পালিয়ে যাবে এখান থেকে। তারপর আস্তে আস্তে পাল্টে যাচ্ছিল মনে হওয়া। তখন মনে হতো কেউ হয়তো রাজকুমারের মত এসে নিয়ে যাবে ওকে। এই স্বপ্ন দেখেই নির্দ্বিধায় ঢুকে পরতো লাল-নীল রঙের যন্ত্রণাময় ঘরটায়।
কেউ আসেনি। ভারতী বুঝে গেছিল এটাই তার কাজ। এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার আর কোনো মানে নেই কারোর কাছে। গ্রামের বাড়ি, বাবা-মা, বোন, এসব আটকে দিয়েছিল এখানে। আটকে দিয়েছিল রাজপুত্র আসার রাস্তাটাও। ভাবনাগুলো পাল্টাতে পাল্টাতে এমন করেই হঠাৎ আমরা বড় হয়ে যাই, তাই না?
এখন যখন নতুন নতুন সদ্য আসা মেয়েগুলো কে কাঁদতে দেখে তখন ভারতীর খুব মনে পরে যায় ওই দিনগুলোর কথা। ওরাও কেঁদে কেঁদে কত স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু বেশিদিন আর দেখবে না। একদিন হঠাৎ করেই বড় হয়ে যাবে সবাই।
ভাবতে ভাবতে গলার কাছটা ভারী হয়ে এলো ভারতীর। শিতাংশু তখনও একভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। হেসে ফেললো ভারতী। কী’সব ভেবে ফেললো এতক্ষণে। ইস, ছেলেটা নিশ্চই ওকে পাগল ভাবছে এখন। ও রেশ কাটানোর জন্যে আবার জিজ্ঞাসা করলো- ‘বললে না তো, কে তুমি? এখানে কেন এসেছো?’
-‘বলছি, আমার খুব ইচ্ছে তোমাকে নিয়ে এই সামনের গলিটায় হাটব। যাবে? যেতে যেতে গল্প করতাম।’
ভারতী কোনো উত্তর খুঁজে পেল না দেওয়ার মতন। শুধু ছেলেটাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে ভীষণ।
৬
‘আমি আসলে এদিকটায় এসেছিলাম পার্টির একটা বই দিতে। ওই গোলবাড়ির দিকটায়। আচ্ছা চলো, এক কাপ চা খেতে খেতে গল্প করি।গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।’- শিতাংশু নির্দ্বিধায় করে ফেললো আবদারগুলো। ভারতীকে দেখেই বুঝতে পেরেছিল ও, যে ‘না’ করবে না ঠিক। ভারতী হেসে এগিয়ে গেল চা’য়ের দোকানের দিকে। দুটো চা বলে ওরা বসলো সামনের বেঞ্চটায়।
ভারতী জিজ্ঞাসা করলো- ‘কী যেন বলছিলে?’
‘হ্যাঁ। তো সেদিন পার্কের ওদিকটায় দাড়িয়ে ছিলাম, আর তখনই দেখলাম তোমায়। খুব ইচ্ছে ছিল কথা বলি। কিন্তু সাহস হয়ে ওঠেনি।’
ভারতী বুঝতে পারছিলো শিতাংশুর কথাবার্তা কোন দিকে যাচ্ছে। মানুষ খুব ভালো চেনে ওরা। এই ছেলেটা এখনও একটা স্বপ্নের দেশেই আছে। যেখানে বাইরের ভেতরের সব কিছু ভালো লাগে। না, বেশি বলতে দেওয়া ঠিক হবে না ভারতীর। এক বয়েসী হলেও শিতাংশুর ভাবনা চিন্তা ভারতীর চেয়ে অনেক শিশুসুলভ। এই ছেলেটা না জেনেই এমন কথা বলে ফেলছে। ওর চোখ বলে দিচ্ছে ওর মনের কথা। অনেক শুনেছে এর আগে। এই ভাবেই পাষানগুলো কাছে আসতে চায়।
কিন্তু শিতাংশু!
না ওর স্বপ্নগুলো আর বাড়তে দেওয়া উচিত হবে না ভারতীর।
কিন্তু শিতাংশু!
না ওর স্বপ্নগুলো আর বাড়তে দেওয়া উচিত হবে না ভারতীর।
ভারতী চায়ে চুমুক দিয়ে বলল- ‘তুমি জানো আমি কে। আমি কী করি?’
অভিজ্ঞের মতো হেসে উঠলো শিতাংশু। বলল-‘জানি তো। সেই জন্যেই তো আমি এসেছি।’
-‘ভুল করেছ, তোমার মতন ছেলেদের এখানে আসা একদম উচিত নয়। তুমি হয়তো জানো না আমি কি ভয়ানক একটা জায়গায় কাজ করি’
-‘জানি। আর জানি বলেই ওখানে যাইনি। ইচ্ছে করলেই তোমাকে সারাদিন ধরে দেখতে পারতাম আমি। ওই তো রাস্তার ধারে বসে থাকো। আমি দেখেছি। কিন্তু কোনদিন ওই ভাবে দেখার ইচ্ছেই হয়নি আমার। তাই প্রতিদিন ওই পার্কের কাছেই অপেক্ষা করতাম তোমার জন্যে। পার্কেই তোমাকে সবচেয়ে ভালো লাগতো দেখতে।’
ভারতী অবাক হয়ে তাকালো শিতাংশুর দিকে। এই ছেলেটা ততটাও ছোট নয়, যতটা ভেবেছিল। সব জেনে শুনে এইভাবে কথা বলতে এসেছে ভারতীর সাথে। ভারতী জিজ্ঞাসা করলো- ‘কী চাও তুমি?’
-‘এই যে, তোমার সাথে দেখা করবো, গল্প করবো, একসাথে ঘুরে বেরোবো।’
-‘সে’সব এখন আর সম্ভব নয় শিতাংশু।’
-‘কেন সম্ভব নয়?’
-‘অনেক দেরী হয়ে গেছে।’
-‘আমি তো তোমার কাছে আর কিছু চাইনি’
-‘এসব সম্ভব নয় আমার পক্ষে।’
-‘কেন? কেন? সেটাই তো জানতে চাইছি বারবার’।
-‘চেওনা জানতে। তুমি তো সব জেনেই এসেছো। এটা জানতে না যে আমার আর ফেরার উপায় নেই।’
শিতাংশু চা’টা একঢোকে শেষ করে হাটু গেড়ে বসলো ভারতীর সামনে। তাকালো ওর দিকে। তারপর বললো- ‘কেন বারবার তুমি এমন ভাবে ভাবছ। আমি দেখেছি তোমাকে এভাবেই মন খারাপ করে বসে থাকতে? কিসের জন্যে এত যন্ত্রণা ভোগ করছ তুমি? কেন এত অভিনয় করে চলেছো দিনের পর দিন? আমি আছি, আমরা আছি। ঠিক কোনো পথ বেরিয়ে যাবে। নতুন কোনো পথ। ভারতী আমার লোকের ভয় নেই। কে কী ভাবলো তাই নিয়ে আমি কোনদিন ভাবিনি আর ভাবতে হবেও না কোনদিন। তুমি একবার বিশ্বাস করো আমায় ঠিক তোমাকে সুন্দর করে দেবো আবার। কেউ কিচ্ছু বলবে না বিশ্বাস করো। একদিন সবাই আবার ঠিক তোমাকে আগের মতই ভালবাসবে।’
-‘না না না শিতাংশু, আমার পক্ষে সম্ভব নয় এসব। মিথ্যে স্বপ্ন দেখিও না আমাকে আর। আমি অনেক দেখেছি, অনেক শুনেছি কিন্তু তুমি আমায় একবারের জন্যে বিশ্বাস করো- সবাই এক। সব মানুষ এক। শুধু নিতে জানে এরা। শুধু লুটে ফেলতে চায় আমায়। আমার অভ্যাস হয়ে গেছে এসব। প্লিজ তুমি আবার নতুন কোনো স্বপ্ন দেখিও না আমায়। অনেক কষ্ট করে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত নিজেকে বুঝিয়ে আমি এ জায়গায় এসেছি। আমার আর কিচ্ছু যায় আসেনা এখন। আমি কারোর মুখও দেখিনা ভালো করে বিছানায়। আমাকে আর নতুন কিছু দিতে চেও না। নিতে চাইলে ব’লো আমি দিয়ে দেবো। একরাত-দুরাত-তিন রাত। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। শুধু ওই মন ভোলানো কথা গুলো বলোনা আমায়।’
শিতাংশু চুপ করে বসে থাকলো অনেকক্ষণ। আস্তে আস্তে উঠে দাড়ালো ভারতীর সামনে। একটা সিগারেট ধরিয়ে তাকিয়ে থাকলো ভারতীর দিকে। মেয়েটা এখনও স্বপ্ন দেখে তারমানে। নইলে কী’ভাবে বলে দিলো স্বপ্ন ভাঙার কথা।
শিতাংশু পাশে এসে বসলো ভারতীর। ওর দিকে তাকিয়ে বললো- ‘কতদিন? কতদিন পারবে এই ভাবে? একদিন তোমার বয়েস হবে। সেদিন এরা ছুড়ে ফেলে দেবে তোমায়। সেদিন কোথায় যাবে তুমি? সেদিন কিন্তু অনেকটা দেরী হয়ে যাবে ভারতী। আমি তোমাকে ভালবাসার কথা একবারও বলিনি। আমি শুধু তোমার পাশে থাকতে চেয়েছি। তোমার জন্যে, সবার জন্যে। আমি জানি তোমাকে দরকার সবার। এই ভাবে তোমার হেরে যাওয়াকে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা। ওরা তোমাকে লুটতেই আসে। ওদের কিছু যায় আসে না তোমার খবরে। প্রতিদিন আসছে, প্রতি পাঁচ বছরে আসবে, আরো হাজার হাজার বছর ধরে নিংড়ে যাবে তোমায়। আর তুমি? এভাবেই চুপ করে বসে থাকবে ওই পার্কে? কোনদিন কিছু বলবে না?’
শিতাংশু পাশে এসে বসলো ভারতীর। ওর দিকে তাকিয়ে বললো- ‘কতদিন? কতদিন পারবে এই ভাবে? একদিন তোমার বয়েস হবে। সেদিন এরা ছুড়ে ফেলে দেবে তোমায়। সেদিন কোথায় যাবে তুমি? সেদিন কিন্তু অনেকটা দেরী হয়ে যাবে ভারতী। আমি তোমাকে ভালবাসার কথা একবারও বলিনি। আমি শুধু তোমার পাশে থাকতে চেয়েছি। তোমার জন্যে, সবার জন্যে। আমি জানি তোমাকে দরকার সবার। এই ভাবে তোমার হেরে যাওয়াকে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিনা। ওরা তোমাকে লুটতেই আসে। ওদের কিছু যায় আসে না তোমার খবরে। প্রতিদিন আসছে, প্রতি পাঁচ বছরে আসবে, আরো হাজার হাজার বছর ধরে নিংড়ে যাবে তোমায়। আর তুমি? এভাবেই চুপ করে বসে থাকবে ওই পার্কে? কোনদিন কিছু বলবে না?’
শিতাংশু পাশে বসেই দেখলো ভারতীর গাল দিয়ে একটা নদীর মতন জল গড়িয়ে পড়ছে নিচের দিকে। শিতাংশু ধীরে ধীরে হাত রাখল ভারতীর হাতে। ভারতী সামলে নিল নিজেকে। চোখ মুছেই বললো- ‘চলো, ওই দিকটা থেকে একবার হেঁটে আসি।’
শিতাংশু হেসে উঠে দাড়ালো বেঞ্চ থেকে। দোকানে টাকা মিটিয়ে হাটতে শুরু করলো সামনের দিকে। দুজনে একসাথে।
দোকানদার টাকাটা একবার ভালো করে দেখে সামনে টিনের বাক্সটায় ফেলে ফোনটা তুলে নিলো হাতে। তারপর কল লাগিয়ে বলল- ‘ভারতী মেয়েটাকে চিনিস?’
উল্টো পাশ থেকে উত্তর এলো -‘কোন ভারতী বলো তো?’
-‘আরে দেখতে শুনতে সুন্দর মেয়েটা। মুকুলদার সাথে ঘুরতো আগে।’
-‘ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। ও তো মিনতিদির বাড়ির।’
-‘হুম, মিনতি দিকে ফোন করে জানা পাখি উড়ব উড়ব করছে। সাথে একটা নতুন ছোকরাও আছে।’
-‘সর্বনাশ। কোনদিকে আছে এখন?’
-‘আমার দোকান থেকে বড় রাস্তার দিকে হাটতে গেল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌছ।’
ফোনটা কেটে দিল দোকানদার। খবর পৌছে গেল সব জায়গায়। ভোটের আগে যেমন হয় আর’কি।
৭
-‘বাড়ি কখন ফিরবে?’ – রাস্তায় হাটতে হাটতে শিতাংশুকে জিজ্ঞাসা করলো ভারতী।
‘সবে তো সাতটা বাজে। এখনও অনেক সময় আছে।’- বলে পকেট থেকে সিগারেট বের করে মুখে দিলো শিতাংশু। ভারতী এক ঝটকায় মুখ থেকে সিগারেটটা কেড়ে দুমড়ে মুচড়ে ফেলে দিলো রাস্তায়।
বলল- ‘কথায় কথায় এত সিগারেট খাওয়ার কি আছে তোমার?’
বলল- ‘কথায় কথায় এত সিগারেট খাওয়ার কি আছে তোমার?’
শিতাংশু আমতা আমতা করে উত্তর দিলো-‘না।।।ওই চা খেলে একটা করে লাগে আর কি।’
-‘পার্ক থেকে এখানে আসতে গিয়ে তো দশ কাপ চা-সিগারেট খেয়ে ফেললে। আরো দরকার তোমার?’
শিতাংশু কী উত্তর দেবে বুঝে উঠতে পারলনা। উত্তর না দেওয়ার আনন্দটা আজ প্রথম অনুভব করলো ও। ভারতীও মনে করে উঠতে পারলো না শেষ কবে এই ভাবে বকা-বকি করেছে কাউকে। মনে পড়ছে না। শেষ যতদুর মনে পড়ে ততদূরে ও শুধু দেখতে পায় শরীরের অঙ্গভঙ্গিতে আগুন এগিয়ে দিচ্ছে কোনো এক মাঝ বয়েসী ভদ্রলোক কে। লাল চোখ, ঘামের গন্ধ আর ক্ষিদে। ভীষণ ক্ষিদে নিয়ে তাকিয়ে আছে ভারতীর দিকে।
না, এখন আর এসব ভাবতে ভালো লাগছে না ভারতীর। শিতাংশু হাটছে এক মনে। ছেলেটার সাথে আরো অনেকক্ষণ গল্প করতে ইচ্ছে করছে খুব। কিন্তু কী প্রশ্ন করবে? কী জানতে চাইবে? কতটাই বা সময় বাকি ভারতীর কাছে? পালিয়ে যাবে এখান থেকে? অন্য কোথাও। যদি শিতাংশুর কথা ঠিক হয়। যদি আবার নতুন করে শুরু করা যায় সব।
সময়গুলো কি দ্রুত কেটে যাচ্ছে আশপাশে। কি তাড়াতাড়ি রাত বাড়ছে কলকাতায়। শিতাংশুর দিকে তাকালো একবার। গুনগুন করে কি একটা গান গাইছে যেন। ভারতী জিজ্ঞাসা করলো-‘তুমি কি নিজে থেকেই এসেছো আমার কাছে নাকি তোমাকে পার্টি থেকে পাঠিয়েছে?’
শিতাংশু হেসে জবাব দিলো -‘ধরে নাও আমি নিজে থেকে এসেছি পার্টির জন্যে।’
ভারতী হেসে আবার জিজ্ঞাসা করলো- ‘আচ্ছা সব সত্যি পাল্টে যেতে পারে?’
শিতাংশু ভারতীর দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো-‘নিশ্চই। তুমি একবার শুধু বিশ্বাস করো আমাকে। দেখো সব পাল্টে যাবেই। আমরা একসাথে পাল্টে দেবো সব।’
ভারতী হেসে ফেললো নিজের মনেই। মানুষ বোধহয় স্বপ্ন দেখতে কোনদিন ভোলে না তাই না?
অনেকদিন বাদে খুব ভালো লাগছে সব। শিতাংশুকে একটু মজা করেই জিজ্ঞাসা করলো- ‘সব পাল্টে যাবে তাই না?’
অনেকদিন বাদে খুব ভালো লাগছে সব। শিতাংশুকে একটু মজা করেই জিজ্ঞাসা করলো- ‘সব পাল্টে যাবে তাই না?’
-‘সব’
-‘তোমার এই গন্ধয়ালা নোংরা পাঞ্জাবিটাও?’
শিতাংশু খানিকক্ষণের জন্যে বুঝে উঠতে পারছিলনা কথাটার মানে। তারপর যখন বুঝতে পারলো তখন একসাথে হো হো করে হেসে উঠলো দুজনেই। শিতাংশু হাসতে হাসতেই জিজ্ঞাসা করলো- ‘খুব গন্ধ ছেড়েছে না? অনেকদিন ধোয়া হয়না।’
-‘একদিন সময় করে এসে, দিয়ে যেও আমায়।’
‘কত টাকা দরকার তোর ভারতী, যে এখন পার্ট টাইম কাজ শুরু করেছিস।’
অবাক হয়ে গেল দুজন। এই নোংরা কথাটা এসেছে ওদের পেছন দিক থেকে। শিতাংশু আস্তে আস্তে ঘুরে তাকালো পেছনে। ভারতী বুঝতে পেরেছিল কার গলা। তাই আর কিছু বলার সাহস পাচ্ছিল না ও।
শিতাংশু ঘুরে তাকিয়ে দেখলো চারটে মাঝ বয়েসী লোক এসে দাড়িয়েছে ওদের পেছনে। ওদের মধ্যে একজন আবার জিজ্ঞাসা করলো-‘তুই নাকি এখান থেকে কাটার প্ল্যান কচ্ছিস? নতুন খদ্দের পেলি নাকি?’
শিতাংশু আর রাগ সামলাতে পারলো না নিজের। ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল-‘ভদ্রভাবে কথা বলুন। আপনাদের লজ্জা করেনা একটা মহিলা কে নিয়ে এমন ভাবে কথা বলতে।’
-‘এইখানে তো কেউ ভদ্দর ভাবে কথা বলে না চাঁদু। তা তুমি কোথাকার মাল? এদিকে তো দেখিনি আগে?’
ভারতী এবার এগিয়ে এলো ওদের মাঝে। লোকটাকে বলল-‘মানস দা তুমি প্লিজ ওকে কিছু বলোনা।’
-‘কেন রে? মালটা কে? তোকে নিয়ে নাকি চুক চুক করছে অনেকক্ষণ ধরে।’
-‘ও আমার চেনা। গ্রামের ভাই। দেখা করতে এসেছে। প্লিজ তোমরা চলে যাও এখান থেকে। আমি খানিক্ষণের মধ্যেই আসছি।’
শিতাংশু ভারতীর দিকে একবার তাকিয়ে লোকটাকে বলল-‘না ও কোথাও যাবে না। ওকে আমি নিয়ে যেতে এসেছি। আপনাদের কোনো অধিকার নেই ইচ্ছের বিরুদ্ধে একটা মেয়ে কে এই ভাবে আটকে রাখবার।’
শিতাংশু ভারতীর দিকে একবার তাকিয়ে লোকটাকে বলল-‘না ও কোথাও যাবে না। ওকে আমি নিয়ে যেতে এসেছি। আপনাদের কোনো অধিকার নেই ইচ্ছের বিরুদ্ধে একটা মেয়ে কে এই ভাবে আটকে রাখবার।’
ভারতী বুঝতে পারছিলো ব্যাপারটা অন্যদিকে গড়াচ্ছে। ও শিতাংশুকে বলল-‘তুমি প্লিজ চুপ করে এখান থেকে চলে যাও। আর এসো না এদিকটায়। আর বাড়িতে বোলো আমি ভালো আছি।’
শিতাংশু বললো- ‘কেন অযথা তুমি মিথ্যে কথা বলছো ভারতী? আমি দেখতে চাই এরা কী করতে পারে? দরকার পড়লে আমি পুলিশ ডেকে আনব।’
চারজন এবার একসাথে চিত্কার করে হাসা শুরু করলো। একজন বলল- ‘পুলিশ ডাকবি? পুলিশ কেন? আর্মি ডাক। তোর বাপ মা সবাই কে ডাক। শালা ক্যালানে কার্তিক। এখানে এসে মেয়ে পালানোয় উস্কাবে? তাও একটা বেস...’
গালাগালিটা শেষ করবার আগেই শিতাংশু সপাটে একটা চড় বসিয়ে দিলো লোকটার গালে। সবাই অবাক। চড় এর আওয়াজে কমে এসেছে গাড়ির হর্ন।
এখন চুপ।
সবাই চুপ।
এদের দেখলে বোঝাই যাচ্ছে না খানিক্ষণ আগেও কি নোংরা কথায় ভরিয়ে দিয়েছিল আশপাশ। কিন্তু ভারতী বুঝতে পারছিলো সব বেরিয়ে গেছে হাতের বাইরে । আর সামলানো সম্ভব নয় এখন।
এখন চুপ।
সবাই চুপ।
এদের দেখলে বোঝাই যাচ্ছে না খানিক্ষণ আগেও কি নোংরা কথায় ভরিয়ে দিয়েছিল আশপাশ। কিন্তু ভারতী বুঝতে পারছিলো সব বেরিয়ে গেছে হাতের বাইরে । আর সামলানো সম্ভব নয় এখন।
লোকটা নিজেকে একটু সামলে নিয়ে মুখ চিবিয়ে একটা জঘন্য গালি দিয়ে পকেটের ভেতরে হাত ঢোকালো নিজের।
-‘শালা এত বড় সাহস তোর? তুই জানিস আমি কে? তোর থানার বড় বড় হোতারা আমার পায়ের কাছে থাকে আর তুই শালা আমাকে থাপ্পর মারলি?’ বলতে বলতে ততক্ষণে লোকটার পকেট থেকে বেরিয়ে গেছে একটা দেশী পিস্তল। ভারতী দৌড়ে এসে আটকানোর আগেই গুলিটা পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে বেরিয়ে ঢুকে গেছে শিতাংশুর বুকে।
একটা গুলির আওয়াজ, হাজারটা গুলির আওয়াজ, বোমা কামান ধ্বংসের আওয়াজ অথচ কেউ ফিরেও তাকালো না একবার।
রাতের ব্যস্ত কলকাতা ছুটছে নিজের খেয়ালে। রাস্তায় বুকে হাত দিয়ে শোয়া শিতাংশু। যন্ত্রনায় চোখ থেকে জল বেরিয়ে এসেছে ওর। লোকগুলো আর দাড়ালো না। সবচেয়ে বয়েস বেশি যার সে তখনই ওখান থেকে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিলো খুনিকে। কয়েকদিন আন্ডারগ্রাউন্ড তারপর আবার খুন।
রাস্তাটা ফাঁকা। ভারতী অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শিতাংশুর দিকে। এই ছেলেটা একটু আগেও দেশ পাল্টানোর স্বপ্ন দেখছিল।
আর নেই।
ল্যাম্পপোস্টের আলোটা সোজা এসে পরেছে শিতাংশুর মুখে। ভারতের সব আলো যেন এসে মিশছে শিতাংশুর মুখে।
নিস্তব্ধ। ভীষণ নিস্তব্ধ হয়ে গেছে আশপাশ।
ভারতী আর ওর সামনে পরে থাকা শিতাংশুর লাশ।
ভারতী বুঝে উঠতে পারছিলো না এবার কী হবে? কী করবে এবার? খানিক্ষণ দাড়িয়ে ছুটতে শুরু করলো ও। শহর পেরিয়ে আরো একটা শহরে, সেখান থেকে অন্য কোনো একটা গ্রামে, সেই গ্রামের মধ্যে দিয়ে জঙ্গল পাহাড় সমুদ্রের মাঝে। যেখানে চিত্কার করে কাঁদলে কেউ এসে বসবে ওর পাশে। ওর কথা শুনবে। জানতে চাইবে ওর যন্ত্রণার কথা। চোখের জল মুছে দৌড়তেই থাকলো ভারতী। পৌছতেই হবে। খুজতেই হবে সেই মানুষটাকে। এই হাজার হাজার মুখোশের ভিড়ে যাকে অনেকটা শিতাংশুর মতো লাগে।
৮
মাঝে প্রায় দশ-পনেরো বছর কেটে গেছে বোধহয়। শিতাংশুর শেষ অব্দি কী হয়েছিল আমরা কিছুই খবর পাইনি। আমাদের কাছে এই খবরগুলো পৌঁছয়না সময় মতন।
ওর কথা ভুলেই গেছিলাম বলতে গেলে। হঠাৎ খুব অদ্ভুত ভাবেই মনে পড়লো সেদিন।
যাচ্ছিলাম কি একটা যেন কাজে। রাস্তার পাশে দেখলাম একটা ছোটদের স্কুল। একদম ছোটদের। প্রচন্ড চিৎকার আশপাশ ভরে গেছে প্রায়। কী এত কথা থাকে বাচ্চা গুলোর কে জানে! একটু এগিয়ে যেতেই দেখলাম একটা জানলা খোলা। ক্লাস চলছে।
টিচার জিজ্ঞাসা করলেন-‘বলতো, আমাদের দেশের নাম কি?’
টিচার জিজ্ঞাসা করলেন-‘বলতো, আমাদের দেশের নাম কি?’
ছোটগুলো একসাথে চিৎকার করে উত্তর দিলো- ‘ভারতবর্ষ’।।।।।।
এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো ঠিক এমন ভাবেই বহুদিন আগে চিৎকার করে শিতাংশুও বলেছিল- ‘ভারতী...’
এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো ঠিক এমন ভাবেই বহুদিন আগে চিৎকার করে শিতাংশুও বলেছিল- ‘ভারতী...’
একদম নিজের মনে করে। দাড়িয়ে পড়লাম স্কুলের সামনে। বাইরে থেকে দেখলাম ক্লাসরুমের ভেতর ছোটছোট শিতাংশুরা পাল্টে ফেলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে আবার।
- সমাপ্ত -
No comments:
Post a Comment