ব্লগ-টগ

প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশের ঘরোয়া সূত্র

Post Page Advertisement [Top]

To Place your advertisement here call - +917980316633/+918145704098



কবিতা – ১

আমাকেতো চেনে নাই কেউ, এতটুকু দাম দিয়ে কেনে নাই কেউ,
তবুও বিকাবো বলে, সবটা হৃদয় খুলে, ঠকে গেছি আমি,
বিকালো মুখোশ শত, রঙচঙা মুখ কত,
বিকালো না শুধু এই একটা হৃদয়, বুকঢাকা জামাটা যে খুব কমদামী।



কবিতা - ২

কতটা বেঁচে থাকা, মরে যাওয়া নয়,
কতটা দূরে যাওয়া, সরে যাওয়া নয়।
কতটা রোদ এলে নিকানো উঠোন,
ভিজে যাওয়া কান্নার স্মৃতি ভুলে রয়।

কতটা নিরবতা, আর ভাষা নয়,
কতটা ডুবে যাওয়া, পার ভাসা নয়।
কতটা প্রেমিক হলে বুকের ভেতর
জেগে ওঠে ডুবোচর, অমোঘ প্রণয়।

কতটা ছুঁয়ে যাওয়া, ভালোবাসা নয়,
কতটা ভীষণ রাত, আলো-আশা নয়।
কতটা আধার ঝড়ে বিবাগী নাবিক
জাহাজের মাস্তুলে গুনেছে প্রলয়।

কতটা কাছে থাকা, কাছে থাকা নয়,
কতটা উধাও হলে, পাছে থাকা নয়।
কতটা ঘৃণা পুষে একাকী দুপুর
হুহু করা কান্নায় ভালোবাসা হয়।

কতটা বুকের জলে শ্রাবণের মেঘ
চুপিচুপি চোখেদের জলে কথা কয়।

কতটা বেঁচে থাকা, মরে যাওয়া নয়,
কতটা দূরে যাওয়া, সরে যাওয়া নয়।
কতটা ছুঁয়ে দিলে বুকের ভেতর
মাঝরাতে কেঁপে ওঠে তৃষিত হৃদয়।




কবিতা – ৩

আজ আমি তোমার জন্য লিখছি।
মাঝরাস্তায় ল্যাম্পোস্টের অদ্ভুত হলুদ আলোর নিচে দাঁড়িয়ে আমি লিখলাম, 'চলে যাওয়া যেখানে অনিবার্য,  সেখানে মানুষ কী রেখে যায়?'
তুমি বললে, 'ছায়া ও মায়া'।
দূরে ট্রেনের হুইসাল। ট্রেন চলে আসছে। আমাকে তার আগেই পৌঁছে যেতে হবে প্ল্যাটফর্মে। দ্রুত। তারপর টুপ করে উঠে যেতে হবে, চলে যেতে হবে স্টেশন ছাড়িয়ে অন্য কোথাও।

আমি তাই মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়েই লিখছি, 'তোমার জন্য মায়া রেখে, ছায়া নিয়ে চলে যাচ্ছি দূরে'।

ল্যাম্পপোস্ট এর হলুদ আলোর নিচে আমার ছায়া তখন কাঁপছে।

আর তুমি বলছো, ও কম্পন নয়, কান্না'।

~ কান্না কেন?
~ কারণ মায়াবিহীন ছায়া জানে কতটা মৃত আর মিথ্যে সে!
~ কিন্তু তুমি?

আমি চমকে তাকালাম, কোথাও তুমি নেই। অথচ তোমার ছায়া রয়ে গেছে মায়া হয়ে। সেই প্রথম আমার মনে হলো, এই শহরে কত কত ছায়া, অথচ তার সকলি  অদৃশ্য আমার কাছে। কিন্তু এই তুমি কী স্পষ্ট!'

আমি চলে যেতে গিয়ে তাই ছায়া বুকে পুষে রাখি মায়ার কাছে।

কারণ আমি জানি, এই ট্রেন ফিরে আসবার নয়।



কবিতা - ৪

আমাকে ভুলে যেও রোজ,
ভুলে যেও কতটা নিখোঁজ।
জেনে রেখ-
কেউ কেউ থেকেও থাকে না,
পদভারে এতটুকু চিহ্ন আঁকে না।
কেউ কেউ না থেকেও থাকে,
চুপিচুপি রোজ ছুঁয়ে যায়,
স্মৃতির গভীর জল নদীটির বাঁকে।



অনুগল্প – ১

আমি বললাম, আম্মা যাই?
আম্মা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর বললেন, যাও।

আম্মা সাধারণত তুই তুই করে বলেন। আগে রেগে গেলে আপনি করে বলতেন। মারার সময় বলতেন, বেশি বাড় বাড়ছেন না? বড় হইছেন? বড় হওন ছুটাইতেছি!

আম্মা সম্ভবত আমার বড় হওয়া চান না। এখনও না। তিনি তাই মামার বাসার অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে আমার পিছু পিছু নেমে আসেন। যদি আমি অন্ধকারে হোচট খেয়ে পড়ে যাই! যদি ভয় পাই! আমি নেমে আসি, আম্মাও আমার পিছু পিছু আসেন। আমি পেছন ফিরে বলি, আম্মা আর আসা লাগবে না। চলে যান।
আম্মা নির্বিকার ভঙ্গীতে বলেন, যাই।
কিন্তু তিনি যান না। আসতেই থাকান। তার আসার ভঙ্গীটা কী অদ্ভুত!  মনে হয় এমন অকপট, এমন সহজ, এমন নির্বিকারভাবে হেটে আসাটা তিনি ছাড়া জগতে আর কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কারো পক্ষে না। এই হেটে আসার ভঙ্গীটায় কী যেন কী আছে! এতো সহজ, সাধারণ! এতো অকপট, আটপৌরে, সহজিয়া। এ যেন মাছের জলে সাঁতার কাটার মতন। আমি গেট অবধি যাই। আম্মা গেটের কাছটায় এসে দাঁড়িয়ে থাকেন। আমি আরেকবার বলি, আম্মা, যান। এতো আসার দরকার নাই।
আম্মা অবিকল আগের মতন বলেন, যাই।

তিনিও জানেন তিনি যাবেন না, আমিও জানি। আমরা দুজন তবু  অদ্ভুত অদৃশ্য এক সুতোয় বাঁধা ঘুড়ির মতন একই সীমানায় নির্দিষ্ট দূরত্বে পাক খেতে থাকি।

আমি আর ফিরে তাকাই না। জানি, ঘাড় ঘোরালেই দেখতে পাবো আম্মা তাকিয়ে আছেন। আমার ছায়া চোখের আড়াল হওয়া অবধি তাকিয়েই থাকবেন।

আম্মা ভয় পাচ্ছেন। তার ছোট্ট একটা অপারেশন। গল ব্ল্যাডারে স্টোন। আমরাও ভয় পাচ্ছি। ডাক্তার বলছেন মামুলি ব্যাপার। আমরাও জানি। কিন্তু আমাদের মন জানেনা। আমাদের ভয় জানেনা। আমি খুব ভোরে আবার মামার বাসায় ফিরব, আমার ছোট ভাই ফিরবে। তারপর হাসপাতাল। তারপর অপারেশন।  কিন্তু তার আগে আম্মার তেষ্টা বাড়ে।

প্রবল জলতেষ্টায়  একচুমুক জলপানের মতন প্রবল সন্তানতেষ্টায় একচোখ সন্তান দেখার তেষ্টা।

আম্মার অপারেশন হলো। আমরা অপেক্ষায়। কখন আসবেন তিনি? এক ঘণ্টা, দু ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা। আম্মার আসতে দেরী হয়। আমাদের মাতৃতেষ্টায় বুক চোখ খা খা করে। হাহাকার, হাহাকার। পোস্ট অপারেটিভে ছুটে যাই। আম্মা অচেতন শুয়ে আছেন। মৃদু শ্বাস বইছে। আমার গলার কাছটা ভীষণ ব্যথা করে। বুক ভার হয়ে যায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।

আম্মা বেড এ আসেন আট ঘণ্টা পর। রাত দশটায়। আমরা দুভাই মাথার কাছে বসতেই চোখ মেলে তাকান। ঠোঁট  ফাঁক করে মৃদু হাসেন। তারপর বলেন, দুপারে ভাত খাইছো বাজান? তোমাগো মুখ শুকনা ক্যান? কি দিয়া ভাত খাইছো?

আমরা কথা বলিনা। আম্মা উদ্বিগ্ন গলায় বলেন, ভাত খাও নাই?

তিনি  এক হাত উঁচু করার চেষ্টা করেন। নার্স ছুটে এসে নিবৃত করেন। তিনি মানেন না। আবারও হাত বাড়ান। তার হাত উঠে আসে। তিনি তার শুকনো মুখের সন্তানদের দুপুরের খাবার নিয়ে চিন্তিত। তিনি হাত বাড়িয়ে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে চান। বলতে চান, আহারে বাজান, মুখখান শুকাইয়া এট্টুক হইয়া গ্যাছে।

তার হাত এগিয়ে আসে। কাঁপা, দুর্বল, ক্লান্ত হাত। কিন্তু তার সেই হাতের স্পর্শে তার শুকনো মুখের সন্তানদের শুকনো চোখ ভিজে ওঠে।

এই স্পর্শের ক্ষমতা জানে জগত, জন্ম ও জীবন।


No comments:

Post a Comment

Bottom Ad [Post Page]

To Place your advertisement here call - +917980316633/+918145704098