- অয়ন বোস
এই মাত্র শ্মশানের রাস্তায় একটা কাপালিকের সঙ্গে
সোমকে যেতে দেখলাম।
কাপালিক ? সোম
তার সাথে কি করছে ? আচ্ছা তুই রাখ আমি পরে কল করছি..
জয়ের ফোনটা কেটে
দিয়ে রিক একটা সিগারেট ধরিয়ে দোতলার জানলার ধারে এসে দাঁড়ালো। ডিসেম্বর মাস।
ঠান্ডা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই , মোড়ের দোকান দুটোও বন্ধ হয়ে
গেছে অনেকক্ষন । ওদের এদিকটা মফস্বল এলাকা। ফ্ল্যাট কনসেপ্ট এখনো ছেয়ে ফেলেনি
জায়গাটাকে, প্রচুর গাছপালা, পুকুর, মাঠ এখনো বর্তমান। রাস্তার ধারের ঝুপসি
গাছগুলোর মাথা থেকে নীলচে ধূসর কুয়াশা আস্তে আস্তে নেমে এসে একটা গা ছমছমে পরিবেশ
তৈরি করেছে । রাস্তার মিটমিটে আলোটাকে ঘোলাটে চোখের
মতো দেখাচ্ছে । ঘড়ি দেখলো রিক রাত নটা চৌত্রিশ। সোমের ব্যাপারটা ওকে বেশ চিন্তায়
ফেলে দিচ্ছে । ছেলেটা সেদিনের পর থেকে কেমন হয়ে যাচ্ছে। যেন পুরো অন্য একটা মানুষ
। নিপাট বাধ্য ভালো ছেলে বলতে যা বোঝায় সোম ঠিক তাই। জীবনে মদ তো দূর ,সিগারেট
পর্যন্ত ছোঁয়নি কোনোদিন। মেয়েদের থেকেও শতহস্ত দুরে থাকত। জয়, রিক আর সোমের বেড়ে
ওঠা থেকে স্কুল এখন কলেজ সবই একসাথে। এহেন সোম রিককে পরশু সকালে বাজারে চিনতে
পারেনি । আড্ডা দিতে আসছে না ,ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। জয় বলছিল ও নাকি সন্ধেবেলা
শ্মশানের রাস্তার ধারে বেঞ্চিতে ওকে দুদিন বসে থাকতে দেখেছে। জয় কথা বলতে গেলে
চিনতে না পারার মতো করে উঠে চলে গেছে। আজ বিকেলে ক্লাবে ওকে নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল । বাবুদা বলছিল সোমের সাথে সেদিন রাতে
এমন কিছু একটা হয়েছে, যাতে ও মেন্টালি খুব চাপে আছে এবং তাই এরকম অদ্ভুত আচরণ
করছে। টাইম দে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সেদিন রাতে ঠিক কি হয়েছিল সেটা সোম নিজেও বলতে
পারেনি ।
ঘটনাটা দিনদশেক
আগের। রোজকার মতো ব্যাটমিন্টন খেলে রাত আন্দাজ এগারোটা নাগাদ ওরা সবাই যে যার বাড়ি
চলে গিয়েছিল। সাড়ে বারোটা নাগাদ বাবুদার ফোন । সোম এখনো
বাড়ি ফেরেনি ...তোরা এক্ষুনি আয় । ওর বাড়ি পৌঁছে রিক দেখে ক্লাবের সবাই ইতিমধ্যে
হাজির। তারপর সবাই মিলে সারারাত তন্নতন্ন করে খোঁজার পর ভোরবেলা যখন থানায় জানানোর
কথা ভাবা হচ্ছে ঠিক তখনই খবর পাওয়া গেলো সোমকে পাওয়া গেছে। শ্মশানের ঠিক পিছনদিকে
মজা ডোবার ধারে একটা বহু পুরোনো ঝুপসি বটগাছ আছে। তার নিচের বাঁধানো কালীবেদিতে অজ্ঞান অবস্থায় ও পড়ে ছিল। এদিকটায় লোকচলাচল কম।
দৈবাৎ কোনো শ্মশান যাত্রী ওকে ওই অবস্থায় দেখে খবর দেয়। ঘটনাস্থলে পৌঁছেই রিকের ভুরু কুঁচকে যায়। একটা জায়গাতে আগুন জ্বালানো হয়েছিল
বোঝা যাচ্ছে। আশেপাশে ছড়ানো ছিটানো ধুপ, ধুনুচি, আরো অনেক কিছু জিনিস যা পুজো বা যজ্ঞে ব্যবহার হয় । সবথেকে অদ্ভুত একটা সাদা কাপড় জড়ানো সিঁদুর লেপা মাটির পুতুল । সোমকে যখন
পাওয়া যায় ওর পরনেও ছিল সাদা ধুতি ,কপালে সিঁদুর আর গলায় জবার মালা । কোনো
তন্ত্রবিদ্যার উপকরণ হিসেবে সোমকে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হয়েছিল এবং কোনো কারণে
তা শেষ হয়নি সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছিল রিক । জ্ঞান ফেরার পর থেকে থেকেই সোম
বাচ্চাদের মতো হেসে উঠছিল । ওর সাথে ঠিক কি হয়েছিল তা জিজ্ঞেস করলে শূন্য
ফ্যালফ্যালে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোনো উত্তর দেয়নি। তারপর থেকেই সোমের আচরণ
ক্রমশ অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে। কিন্তু কি করা হচ্ছিল ওর সাথে ? এবং কেন ? হঠাৎ একটা
হর্নের আওয়াজে চিন্তজাল ছিঁড়লো রিকের। রাস্তা দিয়ে একটা মোটরবাইক বেরিয়ে গেল
মাঝারি স্পীডে । বাইকের আলো পড়লো রাস্তার ওপারে লালবাড়ির দেয়ালে আর ওর চোখ চলে গেল
বাড়ির দোতলায়। জানলাটা অল্প খোলা ,ভিতরে হলদেটে আলোতে একটা চেনা অবয়ব । সোম ?
হ্যাঁ তাই তো সোমই বটে। তবে ও একা নয়, পাশে কাপালিকের বেশে একজন ,দেখে মনে হচ্ছে সোমকে
কিছু বোঝানো হচ্ছে। কিন্তু সোম ও বাড়িতে কি করছে?
লালবাড়ির লোকজনদের পাড়ায় খুব একটা সুনাম নেই।
ওই বাড়ির বড়কর্তা
কিশোরীমোহন একসময় দোর্দণ্ডপ্রতাপ এবং কুখ্যাত লোক ছিলেন। বাবার মুখে সেইসব অপরাধের
বর্ণনাও কিছু কিছু শুনেছে রিক।সেসব কাজ ছাড়াও ভদ্রলোক নাকি তন্ত্রসাধনাও করতেন ।
ওনার সাথে সাথে ওই বাড়ির বেড়ালপ্রীতিও কুখ্যাত । বেড়াল পোষা এমনিতে খুব সাধারণ
ব্যাপার, কিন্তু ওই বাড়ির পোষা সব বেড়ালই মিশমিশে কালো। ছোট থেকেই পাড়ার বড়রা ওই
বাড়ি এড়িয়ে চলতে বলতেন। এখন অবশ্য তাদের সেই প্রতাপ নেই, কিশোরীমোহন বহুদিন ধরেই
কঠিন অসুখে শয্যাশায়ী। কথাও বলতে পারেন না শুনেছে রিক। লোক বলতে উনি, ওনার চাকর
হাবু আর ছোটভাই গিরিশ। আর আছে অগুনতি কালো বেড়াল। রিক শুনেছে ইদানিং সোমের বাবা
কিশোরীমোহনের চিকিৎসা করছেন। উনি এলাকার নামকরা হোমিওপ্যাথি ডাক্তার। সোম কি তবে
কোন ওষুধ পৌঁছে দিতে ওবাড়িতে গেছে ? কিন্তু তবে কাপালিক কেন? কপালে ভাঁজ নিয়ে
সিগারেটটা জানলা দিয়ে টিপ করে ফেলল রিক । তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে রাস্তায় এসে
দাঁড়ালো। চারপাশ কেমন শুনশান থমথমে হয়ে পড়েছে। শিরশিরে একটা ঠান্ডা হাওয়া ভিতর
পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিচ্ছে। দূরে কোথাও কুকুর ডাকছে, রাস্তার অল্প আলোয় চারপাশটা আরো
ভুতুড়ে লাগছে। রিক এগিয়ে যেতে লাগলো লালবাড়ির পিছনের পাঁচিলের দিকে..
রাত এগারোটা
চল্লিশ। রিক আর জয়। সোমের সাথে কিছু একটা খারাপ হতে চলেছে বুঝেই জয়কে ফোনে ডেকে
নিয়েছে রিক। তারপর পাইপ বেয়ে ছাদে উঠে চিলেকোঠার সিঁড়ি দিয়ে
নেমে এখন ওরা লালবাড়ির ভিতরে দোতলায় নামার দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় এক ঘন্টা
হলো । দরজার ওপর দিয়ে দোতলার বিরাট দালানটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে । মাঝে যজ্ঞ
কুণ্ডে আগুন জ্বলছে। পাশে প্রচুর পুজোর উপচার। ধুপধুনোর ধোঁয়ার দালানটা একটা
রহস্যময় রূপ নিয়েছে। সামনে কাপালিক বসে সংস্কৃতে
মন্ত্রোচ্চারণ করছে। পাশে খালি গায়ে গলায় রক্তজবার মালা পরে বসে সোম। ডানদিকে বসে
ছোটকত্তা গিরিশ। সোম কেমন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। মাথা ঝাঁকাচ্ছে উন্মাদের মতো।
হঠাৎ মন্ত্রোচ্চারণ থামিয়ে কাপালিক ভীষণ ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো “সময় হয়ে গেছে। এবার নিয়ে আয়” সঙ্গে সঙ্গে গিরিশ
প্রায় ছুটে বামদিকের ঘরে ঢুকে গেল। এবং পাঁজা কোলা করে কাউকে নিয়ে এসে পাশে শুইয়ে
দিল। সঙ্গে আরেকজন মুশকো লোক। অল্প আলোতেও চিনলো রিক। হাবু, কিশোরীমোহনের চাকর।
তাহলে কি ওই শোয়ানো লোকটা কিশোরীমোহন? কাপালিকের হাতে ততক্ষনে চলে এসেছে একটা সাদা
কাপড় পরানো পুতুল এবং সেটা কিশোরীমোহনের কপাল ছুঁয়ে
যাচ্ছে সোমের কপালের দিকে। বিদ্যুৎচমকের মতো রিকের মাথায় খেলে গেল দাদুর কাছে শোনা
একটা গল্পের কথা। শরীরবদল। প্রাচীন তন্ত্রবিদ্যার একটা ভয়ঙ্কর পদ্ধতি। বৃদ্ধ,
রোগগ্রস্ত, জীর্ণ শরীর ছেড়ে সেই তান্ত্রিকরা নতুন শরীরে আসতে পারতেন। এবং
তন্ত্রবলে অন্যদেরও শরীরবদল করাতে পারতেন।
এক মুহূর্ত সময়
নষ্ট না করে দড়াম করে দরজা খুলে সোজা দালানে লাফ দিয়ে পড়ল রিক। তারপর সোজা এক ঘুষি
কাপালিকের গালে। পিছনে জয়। হাবু আর গিরিশ হকচকিয়ে
গেলেও সঙ্গে সঙ্গে রিককে ধরে মাটিতে পেড়ে ফেলে। কিন্তু জয় তাইকোন্ডার ডিস্ট্রিক্ট চ্যাম্পিয়ন। দু মিনিটের মধ্যে দুজনের ভূমি সজ্জা। ধস্তাধস্তিতে
ছিটকে যাওয়া পুতুলটা নিয়ে রিক আগুনে ফেলে দিতেই কাপালিক হাহাকার করে উঠলো। রিক
গিয়ে কষে দুটো থাপ্পড় মেরে বললো বল কি করছিলি বল? আরো দুটো ,তারপর আরো দুটো এরকম
আরো দশ বারোটা থাপ্পড়ের পর মুখ খুললো কাপালিক। তারপর বললো গিরিশ বাবু ওকে লাখ
তিনেক টাকা দিয়েছেন। এবং আরো দু লাখ কাজ শেষের পর দেবেন। কাজটা হলো কিশোরীমোহনের
আত্মাকে শরীরবদল করিয়ে সোমের শরীরে প্রবেশ করানো এবং সোমের আত্মাকে কিশোরীমোহনের
শরীরে । কিশোরীমোহনের শরীর পক্ষাঘাতগ্রস্ত এবং বাকশক্তি নেই । এতএব সোম ওই শরীরে
বন্দি হয়ে মৃত্যুর দিন গুনবে শুধু। এদিকে সোমের শরীরে কিশোরী মোহন আবার নতুন করে
যৌবন উপভোগ করবেন। আবার এই শরীর নষ্ট হলে নতুন শরীর। বয়স বাড়লে শরীর একসময় আমাদের
সঙ্গ ছাড়ে ,তখনই আমরা মারা যাই। এই মৃত্যু আসলে শরীরের। আত্মা অবনিশ্বর। শরীর বদল
করার এই বিদ্যা জানা থাকলে যে কেউ অমর। সেটা কিশোরী মোহন জানতেন বহুবছর তন্ত্র
সাধনার জন্য। তিনি অসুস্থ হওয়ার সময় ভাই গিরিশকে তার এই দেহ বদলের ইচ্ছার কথা
বলেছিলেন এবং উপায়ও শিখিয়েছিলেন । এই কাপালিক শুধু গিরিশবাবুর আদেশ অনুযায়ী কাজ
করে গেছে। ইদানিং সোমের বাবা কিশোরীমোহনকে দেখছিলেন। সেই সুবাদে ওষুধ পত্র দিতে
সোমকে ও বাড়িতে আসা যাওয়া করতেই হতো। তাই টার্গেট হিসাবে তো ও সহজলভ্য ছিলই ,
গিরিশ আর কাপালিকের কাজটা আরো সহজ করে দেয় সোমের ভীতু ও রাশহালকা স্বভাব । তাই
সোমকে বশীকরণ করতেও ওদের কোনো সমস্যা হয়নি। আগের দিন শ্মশানেই কাজটা হয়ে যেত কিন্তু লোকজন এসে পড়ায় ওদের কেটে পড়তে হয়।
এই ঘটনার পর চার
মাস কেটে গেছে। কিশোরিমোহন সেই রাতেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। কিন্তু রিক
জানে এই মৃত্যুর জন্য ও দায়ী। ওই পুতুলটা আগুনে ফেলে দিতে পুরো ট্রান্সফার
প্রসেসটাই বন্ধ হয়ে যায়। ওই পুতুলে তখন কিশোরীমোহনের আত্মা
ছিল যে দেহে ফিরতে পারেনি। রিক একটুও অনুতপ্ত নয় এর জন্য। গিরিশ, কাপালিক আর হাবু
এখন জেলে। সোম আবার আগের মতো ওদের কাছে ফিরে এসেছে। তবে কয়েকটা ব্যাপারে রিকের
এখনো খটকা যায়নি। লালবাড়ির কালো বেড়ালগুলো এখন সোমের পোষ্য। কিন্তু সোম আগে বেড়াল
সহ্য করতে পারতো না। ভূতের সিনেমা দেখে রাতে ঘুমাতে না পারা ছেলে এখন রাতবিরেতে
শ্মশান, কবরস্থানে ঘুরে বেড়ায়। মেয়েদের কটুক্তি, মদ্যপান, সিগারেট এসব বদগুন ওর
মধ্যে কোনোদিন ছিল না। এই বদলে যাওয়া সোমকে রিক চেনে না।
তবে সোমের দেহে
কে আছে? কিশোরী? না সোম?
কে মারা গেল তবে?
আর ভাবতে পারে না রিক। কারণ ও জানে,এসব কিছুর ব্যাখ্যা বুদ্ধিতে মিলবে না।
No comments:
Post a Comment