- ঋদ্ধিমান
এক মেয়ের গল্প বলি। রূপকথার মতন সেই গল্প। নাম তার
ফ্রিদা কোহলো। ১৯০৭ সালে মেক্সিকোতে জন্ম ফ্রিদার। পড়াশুনায় ভালো। কিশোরী ফ্রিদা
তখন মেডিকেলের স্টুডেন্ট, সাংঘাতিক জখম হল ফ্রিদা এক রোড অ্যাক্সিডেন্টে। দীর্ঘকাল
থাকতে হলো হসপিটালে। সারা শরীরে রয়ে গেল দুর্ঘটনা চিহ্ন,সেলাইয়ের দাগ। প্রেমিকা হিসাবে শরীরটা বোধহয় আর উপভোগ্য
মনে হয়নি,তাই অজুহাতে বিদায় জানাল প্রেমিক।
হসপিটালে শুয়ে প্ল্যাস্টারে ঢাকা
শরীরটা নিজের মতন করে ভালোবাসতে শুরু করল ফ্রিদা। প্ল্যাস্টার সেজে উঠতে লাগল
ছবিতে। বাড়ি ফিরে শুরু হল নতুন জীবন। ছবি আঁকা। ক্যাথলিক মিথ, কলোম্বিয়ান কলোনিজম
আর নিজের ফ্যান্টাসি মিশিয়ে ফ্রিদা জন্ম দিল এক নতুন শৈলীর। ইতিমধ্যে ফ্রিদা
নিজেকে জড়িয়ে ফেল বামপন্থী আন্দোলনে,আদর্শ দিয়েগো রিভেরা।
উনি তখন মেক্সিকোর
নামকরা শিল্পী। সম্পর্ক মোড় নিল প্রেমে। রিভেরা
ইউরোপের কিছু মিউজিয়ামে কাজ করছে তখন। ফ্রিদার কিছু ছবি এক্সিবিট হয়েছে তবুও
ফ্রিদা তখনো রিভেরার প্রেমিকা হিসেবেই বেশী পরিচিত। ১৯২৯ রিভেরাকে বিয়ে করল ফ্রিদা।
বিয়ের পর ফ্রিদা আর
রিভেরা দুজনেই জড়িয়ে পড়ল একাধিক পরকীয়ায়। ফ্রিদা উঠতি প্রতিভা হিসাবে নাম করছে আর
রিভেরা কেরিয়ারের মাঝপথে। স্টুডিও থেকে হোটেল সর্বত্র এক্সপেরিমেন্টাল যৌনতার
খোঁজে একাধিক সম্পর্কের বূহে আটকে পড়ল দুজনেই। দশবছরের মাথায় ডিভোর্স।
আর অদ্ভুত
ঠিক পরের বছরেই আবার বিয়ে করল একেঅপরকে। দুজনে মিলে চললো বিভিন্ন দেশে। নিজস্ব
শিল্প ভাবনার সাথে মার্কসবাদী দর্শন মিশিয়ে
একের পর এক ছবি এঁকে চলল ফ্রিদা। ১৯৪০এ আঁকা সেল্প পোট্রেট উইথ ট্রন নেকলেস এ্যন্ড
হামিং বার্ড ফ্রিদার অন্যতম সেরা কাজ। ১৯৫৪ সালে ফ্রিদা মারা যায়।
ম্যাজিকটা তার অনেক পরে। বেঁচে থাকতে যে মানুষ পরিচিত ছিল কেবল রিভেরার বৌ হিসাবে তার নিজস্ব
শিল্পী ভাবনার আলোয় এল তার মৃত্যুর প্রার কুড়ি বছর বাদে। ইউরোপের শিল্প মহল থেকে
এল প্রংশসা। সেই ঢেল এতটাই দাপুটে ছিল ১৯৮৪ তে মেক্সিকো
সরকার ফ্রিদার সব কাজ ন্যাশানাল হেরিটেজ ঘোষনা করে।
লাতিন আমেরিকায় চে গুভেরার মতন
আইকন মানা হতে থাকে ফ্রিদাকে। জন্ম হয় নতুন শব্দের ফ্রিদাম্যানিয়া। ২০০২ হলিউডে
ফ্রিদার বায়োপিক তৈরী হয়,ফ্রিদার ভূমিকায় সালমা হায়েক। আমেরিকার পোস্টাল
স্ট্যাম্পেও ছাপা হয় ফ্রিডার ছবি। মেক্সিকোর রিসার্ভ
ব্যাঙ্ক ফ্রিডার আঁকা ছবি দিয়ে ই্যসু করে কারেন্সি নোট।
মেক্সিকোতে ফ্রিদার জনপ্রিয়তা তুলনীয় কিংবদন্তি
ভ্যান গগ,পিকাসো,সালভাদর দালির সাথে। কোন সন্তের মতনই ফ্রিডাকে সবাই এখানে একনামে চেনে। মেক্সিকো সিটিতে বাস
স্ট্যান্ড থেকে শুরু করে টাকিলার বোতল, ক্রেডিট কার্ড থেকে শুরু করে আর্ট গ্যালারি
ফ্রিডার ছবিই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ব্র্যান্ড।
ফ্রিডার নামে অফিসও আছে—ফ্রিদা কর্পোরেশন। মেক্সিকো সিটি থেকে
দূরের এক গ্রামে অনেকটা সময় কাটিয়েছিলেন ফ্রিদা।
শেক্সপীয়রের জন্য যেমন অ্যাভন
তেমন ফ্রিদার জন্য লা কাসানো আজুল—মাস্ট ভিজিট
ট্রাভেল ডেস্টিনেশন। ২০০৭ সালে ফ্রিদার জন্ম বার্ষিকিতে গোটা মেক্সিকো সিটি জুড়ে ছিল উৎসবের মেজাজ। কাউবয়,ক্যাকটাস আর
মশলার দেশে ফ্রিদা সত্যিই ম্যানিয়া। ফ্রিদার খাওয়া আধপোড়া সিগারেটের টুকরো কিম্বা
রঙ লাগা অ্যাপ্রন আর সেই হুইল চেয়ার সবকিছুই মিউজিয়ামের এক্সিবিট।
আসলে মানুষ হিসাবে নিজেই কেমন মিস্টিক ছিলেন
ফ্রিদা। তাই তার ছবিও অন্যরকম। তথাকথিত ইউরোপিয়ান মর্ডানিজম ত্যাগ করে ফ্রিদা নিজের
মতন করে ভেবেছেন আর এঁকেছেন। আমেরিকার ক্যাপিটালিস্ট সমাজতন্ত্রের প্রতি তীব্র
বিদ্রুপ ফুটে ওঠে তার কাজে। আবার কখনও অতিপ্রাকৃত বিমূর্ত যন্ত্রণাও ধরা দেয় তার
ক্যানভাসে। নিজের পোষা বানর আর ছোট্ট কুকুর কাঁধে ফ্রিদা হয়ে উঠেন এক
স্টেটমেন্ট,স্টাইল আইকন। আজ ৬ই জুলাই ফ্রিদার জন্মদিন,ফ্রিদাম্যানিয়ার আরো এক
বর্ষপূর্তি।
No comments:
Post a Comment