ব্লগ-টগ

প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশের ঘরোয়া সূত্র

Post Page Advertisement [Top]

To Place your advertisement here call - +917980316633/+918145704098
গত মাসের বিষয় ছিল ‘প্রেমের গল্প’ এবং সেরা তিনটে প্রেমের গল্পের মধ্যে একটি নির্বাচিত হয়েছে শুভঙ্কর দে- এর ‘টিকটিকি’

পরের মাসের বিষয় জানতে চোখ রাখুন ব্লগটগের ফেসবুক পেজে।

বর্ধমানে এম.এ. পড়বার জন্য আমি যখন একটা মেসে থাকা শুরু করি তখন আমার কাছে বর্ধমানের সব কিছু অচেনা। আমি কাউকে তেমন একটা চিনি না, আমাকেও কেউ চেনে না। সারাদিনের পর সন্ধ্যা নামলে ফিরতাম মেসে। চেনা মুখ বলতে আমার রূমমেট মৃন্ময়। এভাবেই কাটছিল দিনগুলি। কিছুদিন পর আমাদের থাকার ছোট্ট আস্তানায় এসে জুটলো অনাহূতের মতো দুটো টিকটিকি। তারপর থেকে সারাদিন তাদের হুটোপুটি লেগে থাকতো। প্রথম প্রথম ঠিক চলছিল, কিন্তু একদিন ঘর ঝাঁট দিতে গিয়ে দেখি ঘরের মধ্যে ধুলোর সঙ্গে পড়ে আছে কালো কালো টিকটিকির গু। 

মাথাটা গেল গরম হয়ে, মৃন্ময়কে বললাম, " দ্যাখ শালা উদ্বাস্তু দুটোর কাজ, খাচ্ছে দাচ্ছে আর ঘরের মধ্যে সব সারছে।" তারপর শুরু হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। যেমন করেই হোক ব্যাটাদের ঘর থেকে তাড়াতেই হবে। একটাকে বের করে দিই তো অপরটি যায় না, একজনের টানে বেরিয়ে যাওয়া টিকটিকিটি এসে আবার হাজির হয়। মনে বুঝলাম এ দুটো নিশ্চয় প্রেমিক প্রেমিকা। নয়তো এদের মধ্যে সেভাবে মারামারি করতে দেখিনি, অবশ্য মাঝে মাঝে রাগ অভিমানেরবোঝাপড়া চলে--তখন একজন উত্তরকোণে অন্যজন পূর্বকোণে। তবে তাদের দৌলতে ঘরের মধ্যে পোকার উপদ্রব থেকে রেহাই পাওয়া গেছে। 

দিন যায় রাত যায়, মানুষে মানুষে সম্পর্ক ভাঙে, যেমন করে ভেঙে পড়ে নদীর পার। এবারের শীতটা দুদিন পড়লো বেশ জাকিয়ে। লক্ষ্য করতাম টিকটিকি দুটোর প্রাণচঞ্চলতার নিস্তব্ধতা। চুপটি করে দেয়ালে লেপটে থাকতো। খিদে পেলে দু'একটা পোকা মাকড় খেত, বাকি সময়টা দুজনে পাশাপাশি নিশ্চুপ। শীত গেল, এল বসন্ত। প্রকৃতির বুকে সকলের মধ্যে একটা রোমান্টিক ভাব। প্রকৃতির কি লীলা! শুধু মানুষে না, গাছ গাছরা, পাখ পাখালি সবাই মেতে ওঠে বসন্তে। আমাদের রূমের টিকটিকি দুটোও ব্যতিক্রম নয়। বেশ চলছিল তাদের জীবন। এমন সময় ঘটলো একটা ঘটনা।

সন্ধ্যায় পড়ছি, তখন ঘড়িতে সাতটা কি সাড়ে সাতটা। হাতে প্রবোধ কুমার সান্যালের 'মহাপ্রস্থানের পথে' ভ্রমণকাহিনী উপন্যাস। এত ভালো গদ্য আর ভ্রমণের অমন বর্ণনা, পড়তে পড়তে আমিও লেখকের সঙ্গে হেঁটে চলেছি কেদারনাথের সুমুখে বরফাবৃত উৎরাই চড়াই বন্ধুর পথে। হঠাৎ ছন্দপতন। ঝুপ করে মাটিতে পড়ার একটা আওয়াজ। তখন আমি একা। শব্দটা শুনে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। ঘোর ভাঙার পর বেড থেকে নেমে গিয়ে দেখলাম ওই টিকটিকি দুটোর একটি মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। ভাবলাম শিকারের জন্য ঝাপ । 

রাত সাড়ে দশটা। ডিনার সেরে গামছায় হাত মুছতে মুছতে বেডের ওই কোণে দেখি টিকটিকিটা তেমনভাবেই পড়ে আছে। এতক্ষণ তো এভাবে থাকার কথা নয়। পায়ে করে নাড়িয়ে দেখলাম নো শব্দ নো নড়নচড়ন। বুঝতে বাকি রইলো না যে এর ইহকাল সমাপ্ত। মনে মনে বললাম এই রাতবিরেতে তোকে মরতে হলো। এখন উপায়? কোনো রকমে পায়ে করে ঠেলে ঠেলে দরজার কাছে নিয়ে গেলাম। এবার বার করি কি করে? হাত দিয়ে তুলতেও গা করছে শিরশির। যতই হোক আমি তো মানুষ। ক্ষুদ্র জীবকে ছুঁতে গা ঘিনঘিন করবে। তবু নিরুপায়। হাত দিয়ে তুলতে যাব এমন সময় মাথাটা গেল ঘুরে। চোখের সামনে একটা নিথর দেহ; মৃত্যু কত শান্ত অথচ ভয়াবহ। স্পর্শ করার শক্তি যেন হারিয়ে ফেলছি। 

মৃত্যু বুঝি এমনই হয়? সে এ জগতের সীমা ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে কোনো এক অসীম জগতে। এ যেন নবারুণের হার্বাট। মাথার মধ্যে এরকম এবড়ো খেবড়ো নানান চিন্তা ভীড় করছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে কত কত শব্দ, যাদের ঠিক মতো ধরতে পারলেই জন্ম দেওয়া যায় সাহিত্যের। হঠাৎ বাইরে মেসমালিকর গলার আওয়াজে ঘোর ভাঙলো। উনি তখন বলছেন, " এটা তো মরে গেছে। যাও যাও এক্ষুনি ফেলে দিয়ে এসো। যত সব আবর্জনা।" সত্যিই তো, এরা আবর্জনাই। ফেলে দিয়ে এলাম পুকুরের জলে। পুকুর পাড় তখন চাঁদের আলোয় এক মায়াবী রূপ নিয়েছে, বসন্তের হাওয়া বয়ছে শিরশির করে, তিড়তিড় করে নড়ছে গাছের পাতা। ঘরে এসেই চোখ গেল দেয়ালে। যাদের তাড়াবার জন্য একদিন রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলাম তারাই একদিন আমাদের ঘরের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। 

আজ তাদের একজন নেই, অপরজন চুপটি করে দেয়ালে সেঁটে রয়েছে। ও কি জেনেছে ওর সঙ্গী হারিয়ে গেছে চিরকালের জন্য? ও কি শোকে বিহ্বল? হতেও পারে, ওরা তো মানুষ নয় যে শোকে চিৎকার করে কাঁদতে বসবে। অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় জানলা খুলে শুয়ে পড়লাম। সকালে ঠাণ্ডা হাওয়ায় ঘুম ভাঙতেই অভ্যেসমতো দেয়ালে তাকালাম, দেখলাম টিকটিকিটি আর নেই, ঘরের কোথাও নেই। এমনি করেই সবাই চলে যায় একদিন। বেড থেকে নেমে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাতেই চোখে পড়লো অদূরের কাঠখোট্টা পলাশ গাছটি ছেয়ে গেছে পলাশ ফুলে।


No comments:

Post a Comment

Bottom Ad [Post Page]

To Place your advertisement here call - +917980316633/+918145704098