ছোটবেলা
থেকেই সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায় এবং চপলা দেবীর প্রথম
সন্তান অরুণ ছিলেন খুব শান্ত স্বভাবের। মায়ের বাধ্য সন্তান। মায়ের মন খারাপ
হয়েছে জানলে চলে আসতেন তাঁর ঘরে। 'মা-গো' বলে ডেকেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন মায়ের বুকে। এই স্বভাবটা বড়ো হয়েও
তাঁর যায়নি। প্রথম চাকরি পেয়ে মাইনের টাকায় একটা শাড়ি কিনে আনেন। মা অবাক হয়ে
বলেছিলেন "আমার জন্য শাড়ি কেন?” অরুণ তখন মাকে জড়িয়ে ধরে
বলেন "প্রথম রোজগারের টাকায়
আমার ভগবানকে দিলাম। তুমিই তো আমার ভগবান।"
অরুণএর জন্ম ১৯২৬ এ ৩রা সেপ্টেম্বর উত্তর
কলকাতার আহিরিতলাতে। ১৯৪২ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাস করলেন। ১৯৪৫ সালে
বিকম স্ট্যান্ডার্ড পাস করে ভর্তি হলেন কলেজে। কিন্তু কলেজে পড়া আর বেশি দূর এগোল
না। টানাপোড়েনের সংসার। চলল চাকরির সন্ধান। যে করেই হোক, একটা চাকরি
চাই তাঁর। অবশেষে মিলল চাকরি। পোর্ট কমিশনার্স অফিসের খিদিরপুর ডকে। সাধারণ
কেরানির পদে। বেতন মাসে মাত্র ২৭৫ টাকা। দুই হাজার টাকা জামানাত দিয়ে চাকরিতে যোগ
দিলেন। এরই মধ্যে চলছিল তাঁর অভিনেতা হওয়ার নিরলস চেষ্টা। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড
থিয়েটার অনুরাগী। সেই ছোটবেলা থেকেই। ছিলেন যাত্রার ভক্ত। পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়ে
চুরি করে দেখতেন থিয়েটারের মহড়া। যাত্রার মহড়াও দেখতেন। স্কুলের বার্ষিক উৎসবে
‘গয়াসুর’ নাটকে ছোট গয়াসুরের ভূমিকায় অভিনয় করে হইচই ফেলে দিলেন।
অভিনয়ের প্রতি ঝোঁকটা
বেড়েই চলল ক্রমে। মনের গহিনে চলল রুপালি পর্দায় অভিনয় করার সোনালি স্বপ্ন বোনা।
লালিত স্বপ্ন দেখা দিল বাস্তব হয়ে। সুযোগ মিলল ১৯৪৭ সালে। বাড়ির ভাড়াটে গণেশ
বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাধ্যমে ভোলানাথ আঢ্যের ‘মায়াডোর’ নামের একটি হিন্দি ছবিতে ছোট্ট
একটা চরিত্র পেলেন অরুণ। দৈনিক পাঁচ সিকি পারিশ্রমিকে পাঁচ দিন অভিনয় করলেন।
কিন্তু ‘মায়াডোর’ মুক্তি পায়নি। দ্বিতীয় সুযোগটি এল ঠিক পরের বছরই। ‘দৃষ্টিদান’
ছবিতে অভিনয় করলেন নায়কের ছোটবেলার ভূমিকায়। কমিশন বাদ দিয়ে এ ছবিতে তাঁর
পারিশ্রমিক দাঁড়াল সাড়ে ১৩ টাকা। ওই বছরের মাঝামাঝি সময়ে তিনি কাজ শুরু করলেন
নবেন্দুসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত ‘কামনা’ ছবিতে। নায়কের ভূমিকায়। পারিশ্রমিক
এক হাজার ৫০০ টাকা।
১৯৪৯ সালে মুক্তি পেল ‘কামনা’। কিন্তু সুপার ফ্লপ। ভীষণ মুষড়ে পড়লেন তিনি। এরপর সরোজ মুখার্জির ‘মর্যাদা’ ছবিতে অভিনয় করলেন নায়ক হিসেবে। তবে পরিচালকের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নাম পাল্টে অরুণ কুমার হয়ে গেলেন অরূপ কুমার। কাজ হলো না। দর্শকপ্রিয়তা পেল না ছবিটি। আবার নাম পরিবর্তন করা হলো। উত্তম কুমার। ‘সহযাত্রী’ ছবিতে উত্তম কুমার নামে অভিনয় করলেন। অসফল হলো ছবিটি। অসফলতার ধারাবাহিকতায় যোগ হলো আরও একটি ছবি ‘নষ্টনীড়’। এরপর ‘সঞ্জীবনী’, ‘কার পাপে’, ‘বসু পরিবার’। সেটা ১৯৫২ সাল। আশাতীত সাফল্য পেল ‘বসু পরিবার’। ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। এল ১৯৫৩। মুক্তি পেল তাঁর অভিনীত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। ছবির নায়িকা সুচিত্রা সেন। সুপারহিট। এরপর শুধুই সাফল্য। ইতিহাস। অরুণ হয়ে উঠল মহানায়ক উত্তম কুমার।।
১৯৪৯ সালে মুক্তি পেল ‘কামনা’। কিন্তু সুপার ফ্লপ। ভীষণ মুষড়ে পড়লেন তিনি। এরপর সরোজ মুখার্জির ‘মর্যাদা’ ছবিতে অভিনয় করলেন নায়ক হিসেবে। তবে পরিচালকের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নাম পাল্টে অরুণ কুমার হয়ে গেলেন অরূপ কুমার। কাজ হলো না। দর্শকপ্রিয়তা পেল না ছবিটি। আবার নাম পরিবর্তন করা হলো। উত্তম কুমার। ‘সহযাত্রী’ ছবিতে উত্তম কুমার নামে অভিনয় করলেন। অসফল হলো ছবিটি। অসফলতার ধারাবাহিকতায় যোগ হলো আরও একটি ছবি ‘নষ্টনীড়’। এরপর ‘সঞ্জীবনী’, ‘কার পাপে’, ‘বসু পরিবার’। সেটা ১৯৫২ সাল। আশাতীত সাফল্য পেল ‘বসু পরিবার’। ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। এল ১৯৫৩। মুক্তি পেল তাঁর অভিনীত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। ছবির নায়িকা সুচিত্রা সেন। সুপারহিট। এরপর শুধুই সাফল্য। ইতিহাস। অরুণ হয়ে উঠল মহানায়ক উত্তম কুমার।।
মহানায়কের দশটা অজানা তথ্যঃ
১) উত্তর কলকাতার আহিরিটোলার এক বনেদি পরিবারের গৃহকর্তা
কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের কাছে এসেছেন কুলগুরুদেব শ্রীপূর্ণ সন্ন্যাসী।
সিদ্ধপুরুষ। দৈব ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর ভবিষ্যৎ বানী বিফলে যায়না। কালীপ্রসন্নের নাতির বয়স তখন তিনমাস। ফুটফুটে
চেহারার নাদুসনুদুস ছেলের সারা গায়ে তেল মাখিয়ে নরম রোদে শুইয়ে রেখেছেন মা চপলা।
ছেলে ঘুমচ্ছে দোলনায়।
গুরুদেব উঠে এলেন ছাদে নাতিকে দেখবার জন্য। তাঁকে প্রণাম করলেন চপলা।
গুরুদেব জিজ্ঞেস করলেন কোথায় তোর ছেলে? কি আশ্চর্য! দোলনার কাছে
দাঁড়াতেই ঘুমন্ত শিশু হঠাৎ এক গাল হেঁসে উঠল। অবাক হয়ে নবজাতকের মাথায় হাত রেখে
আশীর্বাদ করে বললেন , মা- তোর এই ছেলে একদিন
হাঁসি দিয়ে ভুবন ভোলাবে। মাতাবে।তোর বাবার দেওয়া নামেই নাম করবে।
১৯২৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ৫১, আহেরিতলার
স্ট্রিটের বাড়িতে টকটকে ফর্সা গায়ের রং, টানাটানা
লক্ষ্মীট্যারা চোখ নিয়ে যে শিশুটি জন্মাল, কালীপ্রসন্ন
তার নাম দিলেন 'উত্তম'।
লেখার শুরুতেই উত্তম কুমারের মাতৃভক্তের পরিচয় দিয়েছি। একদিন মায়ের
সঙ্গে দেখা করতে এসে দেখেন মায়ের জ্বর হয়েছে খুব। তিনতলায় কোন বাথরুম ছিল না। মাকে
কস্ত করে যাতে নিচে নামতে না হয় সেজন্য ভাঁড়ার ঘরটা খালি করে উত্তমকুমার সেইখানেই
বাথরুম তৈরি করিয়ে দেন।
২) পিকনিক বা অন্য কোথাও বেড়াতে গেলে উত্তমকুমার গান গাইতেন। বেশির
ভাগ সময়ই 'কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না' গানটা করতেন।
তবে, গানের শুরুটা করতেন 'পার হয়ে এসেছি মরু' থেকে।
৩) ভালো মূর্তি তৈরি করতে পারতেন উত্তমকুমার। ম্যাটরিকুলেশন
পরীক্ষার পর পোট-পাড়ায় গিয়ে কিনে আনতেন প্রতিমার মুখের ছাঁচ।
একবার সেই ছাঁচ পছন্দ না হওয়ায় মামাবাড়ির ঠাকুরের মুখ চেয়ে এনে ঠাকুর গড়েছিলেন।
৪) উত্তমকুমারের ফুলসজ্জার রাতে আড়ি পেতেছেন তাঁর দুই বউদি।
জ্যৈষ্ঠমাসের প্রবল গরমের মধ্যেও তাঁরা একটা ট্রাংকের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন। সেটা
দেখতে পেয়ে ওঁদের হাত ধরে বের করে এনে উত্তম বললেন,” তোমরা পারোও
বটে! এই গরমের মধ্যে কি কষ্টই না করলে। শোনো তোমাদের আর কষ্ট করতে হবে না।
আমি জানলা - দরজা খুলেই শোবো।
৫) খ্যাতির মধ্যগগনে তখন উত্তমকুমার। সেই সময়ও মাঝে মাঝে বাড়ির উঠোনে
দাঁড়িয়ে খালি গায়ে স্নান করতেন চৌবাচ্চা
থেকে জল তুলে। পাশের বাড়ি থেকে প্রতিবেশীরা সেই
দুর্লভ দৃশ্য দেখতেন অবাক হয়ে।
৬) উত্তম কুমারের ছবির সব থেকে ভালো সমালোচক ছিলেন গৌরী দেবী।
তাঁর মতামতকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিতেন তিনি। নিশিপদ্ম দেখে অনেকে যখন বলেছিল ভালো
চলবে না, তখন গৌরী দেবী কে দেখালেন উত্তম। তিনি দেখে বলেছিলেন "সুপারহিট হবে" । হোলও তাই।
বনপলাশীর
পদাবলীর ক্ষেত্রেও এমনটা হয়েছিল। উত্তম কুমার গৌরী দেবীকে ছবিটা দেখালেন। তাঁর
কথামত কয়েকটা দৃশ্য বাদ দিতেই ছবি সুপারহিট।
৭) হাজতবাসও করেছিলেন উত্তম কুমার। নতুন গাড়ি কিনে স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে
বেরিয়েছিলেন গঙ্গার ঘাটে। উনি তখন সবে গাড়ি চালানো শিখেছেন। গৌরী দেবীকে গাড়ি
চালানো শেখাতে গিয়ে এক ফেরিওয়ালাকে ধাক্কা মারেন। পুলিশ এসে হাজির তারপরেই।
ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকায় পুলিশ ওঁদের হেস্তিংস থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে লকআপে পুরে
দেয়। সারারাত থানায় কাটাবার পর উত্তম কুমারের এক বন্ধু সকালবেলায় এসে জামিনে
ছারিয়ে নিয়ে যান। ভাগ্যিস তখন উনি স্টার হয়ে যাননি।
৮) কোজাগরি পূর্ণিমার রাতে একবার তাজমহলে গিয়ে উত্তমকুমার
মুগ্ধ হয়ে 'প্রেমের সমাধিতীরে' গানটি গেয়ে ওঠেন। গানটি শুরু করার সময়ে
সেখানে দুএকজন মাত্র লোক ছিলেন। পরে দেখা গেল, অসংখ্য মানুষ
ভিড় করে মোহিত হয়ে শুনছেন মহানায়কের গান।
৯) দোল ছাড়াও বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে বিয়ার
খেতেন। তবে, দোলের মতো অত বস্তা বস্তা বিয়ার আসত না। গৌরী দেবী দারুণ সিদ্ধি
বানাতে পারতেন মর্তমান কলা, মিল্কমেড দিয়ে।দারুণ খেতে হতো সেই
সিদ্ধি। বাড়িতে লক্ষ্মীপুজোর বিজয়ায় যারাই আসতেন তাঁদের সিদ্ধি খাওয়াতেন উত্তম
কুমার।
১০) কাজ
পাগল উত্তম চেয়েছিলেন তাঁর মৃত্যু যেন হয় কাজের মধ্যে থেকে। ১৯৮০ সালে ওগো বধু
সুন্দরী ছবির সেটে স্ট্রোক হয় উত্তম কুমারের। তাঁকে বেল ভিউ নার্সিং হোমে নিয়ে
যাওয়া হয়। সেখানে ১৬ ঘণ্টা ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে থেকে ২৪শে জুলাই রাত্রে মাত্র
৫৪ বছর বয়েসে আমাদের ছেড়ে চিরকালের জন্য বিদায় নিলেন মহানায়ক। রেখে গেলেন এক রাশ
বেদনা, দুঃখ, কষ্ট তাঁর প্রিয় দর্শক
দের মনে। কিন্তু আজও তাঁর মৃত্যুর ৩৮ বছর পরেও এই নব প্রজন্মের কাছে তাঁর প্রতি
ভালবাসা শ্রদ্ধা এক চিলতেও বিলুপ্ত হয়নি। তিনি সর্বদা বিরাজমান ছিলেন, আছেন,থাকবেন।
তথ্য সংগ্রহ - অজানা উত্তম।
তথ্য সংগ্রহ - অজানা উত্তম।
No comments:
Post a Comment