বাঙালিদের ঘরে ঘরে অনেক মেয়েদের নাম
মহাভারত, রামায়ণ, পুরাণের অনেক নারী চরিত্রের নামে হয়ে থাকে, কিন্তু কোনোকালেই
কোনো মেয়ের নাম তার বাবা-মায়েরা রাখেন না সীতা ও দ্রৌপদী। আমি কাল বলতে সেই
প্রাচীন থেকে আজকের কথায় বলতে চাইছি। এমনকি লক্ষ করে দেখব যে, অনেক বাঙালি ঔপন্যাসিকেরাও
তাঁদের উপন্যাস, গল্পের নারী চরিত্রের নামও ‘সীতা’ বা ‘দ্রৌপদী’ রাখেন না।
বাংলা
সাহিত্যে হাতে গোনা কয়েকটি উপন্যাস আছে যেখানে ‘সীতা’ বা ‘দ্রৌপদী’ নামের চরিত্র
দেখতে পাওয়া গেছে। যেমন, বিভূতিভুষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দৃষ্টিপ্রদীপ’ উপন্যাসে
‘সীতা’ নামের নারী চরিত্র আছে। এখন পাঠকরা (প্রশ্ন করতেই পারেন যে, কেন হে বাপু,
এই সীতা, দ্রৌপদীর নামে কত কত গোটা বই বেরোচ্ছে তার বেলায় তো চোখে পড়ছেনা! আমি
সেখানে বলবো যে, সে তো ঝুড়ি ঝুড়ি বেরোছে, কিন্তু লক্ষ্য করে দেখুন সেগুলি হয় সীতা,
দ্রৌপদীর চরিত্র বিশ্লেষণের বই আর নয়তো তাঁদেরকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া রামায়ণ,
মহাভারতের কাহিনির আধুনিক পুনর্নির্মাণ। আমি বলতে চাইছি বাস্তবকে কেন্দ্র করে লেখা
সামাজিক উপন্যাস বা ঘরে ঘরে বাস্তব নারীদের নাম সেভাবে ‘সীতা’ বা ‘দ্রৌপদী’ হয়না।
এর পেছনে সেই পুরাকালীন যুক্তিই শুনতে পাই; সীতা নাম রাখলে সেই মেয়ের কপালে নাকি
রামায়ণের সীতার মতোই দুঃখ জুটবে, আর দ্রৌপদী নাম রাখলে সেই নারী হয়ে যাবে
বহুভোগ্যা।
তবে এটা স্বীকার করবো যে বিংশ শতক অবধি এমন ভাবনার মানসিকতা অনেকটা কমে
এসেছে একবিংশ শতকের নবপন্থা মানুষদের মধ্যে, তবু ঘুণপোকার মত এখনো সেই চিন্তা মগজে
কুরে কুরে খাচ্ছে। এইখানে আমার মাথায় একটা প্রশ্ন জাগে, যদি এমনটায় হবে, তাহলে সেই
চিন্তা পুরুষদের নামকরনের ক্ষেত্রে হয়না কেন? দিব্যি তো পুরুষদের নাম রাখা হয় রাম,
লক্ষ্মণ, ভরত, ভীম, অর্জুন। অথচ এইসব নামধারী মহাজনেরা তো কেউ রামের মতো হয়না,
হয়না অর্জুনের মতো বীর সব্যসাচী, না হয় লক্ষ্মণের মতো ভ্রাতৃপ্রতিম। উলটে রামের পরে
রহিম যোগ করে নিয়ে নিদ্বিধায় ধর্ষণ করে
চলেছে মেয়েদের, মানুষ খুন করে সমাজে হয়ে উঠছে বিশিষ্ট নামধারী নেতা। ভাগ্যিস
সেভাবে ছেলেদের নাম যুধিষ্ঠির রাখা হয়না, নয়তো আধুনিক যুধিষ্ঠিরদের মুখের ঝুড়ি
ঝুড়ি মিথ্যে বচনে হয়তো মহাভারতের সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরও হয়ে যেতেন কলুষিত।
পাঠকেরা
এবার হয়তো ধৈর্য হারিয়ে রেগেমেগে বলতে শুরু করবেন যে, এ কেমন লেখা হে আপনার?
আলোচনার শুরুতে ছিল নারী, আর এখন পুরুষদের নাম নিয়ে কচলাচ্ছেন। আসলে আমি এটা
আলোচনার মধ্যে আনলাম এই কারনে যে, আমি দেখাতে চাইছি সেই সত্যযুগ থেকে আজ অবধি
পুরুষেরাই সব ঠিক করে আসছেন। নারীদের কী নাম হবে, তাদের স্থান-কাল ভেদে কী কর্ম
হবে সবকিছু। আর যদি প্রশ্ন ওঠে নারীদের বিচার বুদ্ধি নিয়ে তবে যে রামমোহন রায়ের
কথাটা স্মরণ করতেই হবে-“স্ত্রীলোকের বুদ্ধির পরীক্ষা কোন কালে লইয়াছেন যে,
অনায়াসেই তাহাদিগকে অল্পবুদ্ধি কহেন? কারণ বিদ্যাশিক্ষা এবং জ্ঞান শিক্ষা দিলে পরে
ব্যক্তি যদি অনুভব ও গ্রহণ করিতে না পারে, তখন তাহাকে অল্পবুদ্ধি ক’থা সম্ভব হয়।
আপনারা বিদ্যাশিক্ষা জ্ঞানোপদেশ স্ত্রীলোককে প্রায় দেন নাই, তবে তাহারা বুদ্ধিহীন
হয় ইহা কিরূপে নিশ্চয় করেন?”(প্রবর্তক ও নিবর্তকের দ্বিতীয় সংবাদ)।
পাঠক লক্ষ্য করুন পুরাণ, রামায়ণ,
মহাভারত সব কিন্তু রচনা করেছেন পুরুষ কবি। তাই তাঁর ইচ্ছে মতো সীতাকে পাতালে
পাঠিয়েছেন, কুন্তীর মুখ দিয়ে দ্রৌপদীকে পঞ্চপাণ্ডবের উপভোগ্যা করে তুলেছেন। আবার
এই নারীদেরকে সামনে রেখেই রাবণ বধ থেকে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সূচনা করেছেন। তাই আজও
ঘরে ঘরে ঝগড়া লাগলে প্রথমেই আঙুল তোলা হয় মেয়েদের দিকে। আবার এই মেয়েদের জন্যই
নাকি ধ্বংস হয়েছে (এখনো হছে) বংশ। মনে পড়ে সত্যযুগের পরশুরাম, রেণুকা’র নাম? সেই
পরশুরাম যিনি কিনা শোকগ্রস্থ মা রেণুকার একুশবার বুক চাপড়াতে দেখে পরশুরাম
ক্ষত্রিয়দের বংশ ধ্বংস করেছিলেন একুশবার। গল্পটা বলি শুনুনঃ একসময় ক্ষত্রিয়কুলের
বিশাল পুরুষ কার্তবীর্য-অর্জুন পাত্রমিত্র নিয়ে জমদগ্নির আশ্রমে আসেন। জমদগ্নির
একটা কামধেনু গরু ছিল তার ওপর কার্তবীর্যের লোভ হয়। এদিকে মুনিও কামধেনু দেবেন না,
ওদিকে রাজাও না নিয়ে ছাড়বেন না। ফলে বেধে যায় যুদ্ধ। জমদগ্নির দিক দিয়ে তাঁর বীর
পুত্র পরশুরাম যুদ্ধ করে মেরে ফেলেন কার্তবীর্যকে। তারপর একদিন পরশুরামের
অবর্তমানে কার্তবীর্যের ছেলে এসে “খুন” করে দিয়ে চলে যায় জমদগ্নিকে। পরশুরাম আশ্রমে এসে
দেখলেন বাবার মৃত্যুর জন্য মা রেণুকা বুক চাপড়ে কাঁদছেন। শুরু হল সিনেমার ক্লাইম্যাক্স।
মায়ের চোখে জল দেখে হিরো পোসেনজিতের মতো আঙুল তুলে প্রতিজ্ঞা করলেন পরশুরাম যে,
মায়ের একুশবার বুক চাপড়ানো দেখে তিনিও একুশবার ক্ষত্রিয়দের ধ্বংস করে দেবেন। আবারো
এখানে আমি প্রশ্ন তুলবো , রেণুকা স্বামীর শোকে যখন কান্না শুরু করেন তখন তো
পরশুরাম আশ্রমে ছিলেন না। তাহলে উনি কিভাবে গুনলেন যে মাতা রেণুকা একুশবার বুক
চাপড়ে কেঁদেছেন? আসলে আমার মতে এসব পাঠকদের কাছে নাটকের মতো ক্লাইম্যাক্স তৈরি করা
ছাড়া আর কিছুই নয়। যে পরশুরাম একদিন পিতৃাদেশে নিজের মা’কে হত্যা করেছিলেন, সেই
পরশুরাম মায়ের দুঃখে এমন একটা প্রতিজ্ঞা নেবেন সেটা একেবারেই অসম্ভব। আসল কথাটা হল
তিনি বাবার হত্যাকারিদের শায়েস্তা করতেই এমন প্রতিজ্ঞা নেন এবং একুশবার
ক্ষত্রিয়দের মেরে রুধির হ্রদ বানিয়ে ফেলেন। আর মাঝখান থেকে নারী রেণুকা সমাজে
একুশবার ক্ষত্রিয়নিধনের কারণ বলে কৃত্যা হয়ে থাকলেন।
আবার ত্রেতাযুগে দেখুন সীতাকে রাবণ
কিন্তু কোনো কামোন্মত্তের লোভে হরণ করেননি, করেছিলেন বোনের নাক কাটার প্রতিশোধ
নেবার জন্য। আর আমার মনে হয়না তিনি শারীরিকভাবে সীতাকে কোনপ্রকার অত্যাচার
করেছিলেন। যদিও সেই বাদানুবাদ পণ্ডিতরা করবেন। কিন্তু দেখুন রাম যে সীতাকে উদ্ধার
করার জন্য বন, পাহাড় , সমুদ্র পেরিয়ে রাবণকে হত্যা করে এলেন; উদ্ধারের পর পরই সেই
সীতাকে প্রজাদের কথায় সন্দেহ করে বসলেন এবং বিসর্জন দিতে বাধ্য হলেন। আমি বলতে চাইছি
রামের সীতা উদ্ধারটা যতখানিনা সীতার প্রতি ভালোবাসায় তার চেয়েও বড় তিনি বংশের মান মর্যাদা রক্ষার জন্য যুদ্ধ
করেন আর শেষমেশ ‘বিসর্জন’ দেন সীতাকে। ‘বিসর্জ্ন’ শব্দটা ব্যবহার করলাম এই কারনে
যে বাঙালিরা যেমন চারদিন ব্যাপি দুর্গোৎসবে আত্মহারা হয়ে যায় এবং শেষে মাটির ঢেলার
মতো ছুড়ে ফেলে জলে, অনেকটা সেরকমই রামও সীতাকে নিয়ে কয়েকদিন আনন্দ করলেন তারপর
তাকে বিসর্জন দিয়ে দিলেন।
দ্বাপরযুগেও মহাভারতে দ্রৌপদীর
প্রতিও তেমনি একটা অবহেলা লক্ষ্য করি পাণ্ডবদের মধ্যে। পাণ্ডবরা কেউই দ্রৌপদীর মন
বোঝার চেষ্টা করেননি। একমাত্র কৃষ্ণই বুঝেছিলেন ঠিকঠাক দ্রৌপদীকে। কিন্তু কৃ্ষ্ণ
তো আর ওনার পতিদেব নন। যুধিষ্ঠির চিরটাকাল ধর্মে ডুবে থাকলেন। ভীম কিছুটা চেষ্টা করলেও তা আসলে এখনকার ছেলেরা
যেমন তাদের জিম করা ‘বডি’র শক্তি দেখাবার জন্য মেয়েদের গায়ে গায়ে লেপ্টে থাকার
চেষ্টা করে ভীম খানিকটা ওরকম। আর অর্জুন? দ্রৌপদী ছাড়াও তিনজন নারীর সঙ্গলাভ
করেছেন, তাই আর দ্রৌপদীর দিকে ততটা পতিপ্রেম দেখাননি। যদিও ওনার দিক দিয়ে দেখতে
গেলে একটা বেদনার অনুভব তো পাই। স্বয়ম্বর সভা থেকে উনি একা দ্রৌপদীকে লাভ করে
আনলেন আর তাতে ভাগ বসালেন বাকি চারভাই। অর্জুন বলেই মেনে নিয়েছেন, আমরা হলে
তক্ষুণি ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধিয়ে ফেলতাম। তবে এখানে দ্রৌপদীই একমাত্র সেই নারী যিনি
সবসময় পুরুষের নীতি মেনে চলেননি। তিনি আপন
তেজে ও ব্যক্তিত্বে স্বমহিমায় উজ্জ্বল। আর তার প্রমাণ সমগ্র মহাভারত জুড়েই দেখতে
পাই। কুরুসভায় বস্ত্র হরণের সময় যখন পঞ্চপাণ্ডব মুখে সেণ্টারফ্রেশ চুইঙ্গাম নিয়ে
জবান বন্ধ করে রেখেছিলেন তখন দ্রৌপদী সোচ্চার কণ্ঠে বিদ্রোহ করেছেন। তবু, হ্যাঁ,
তবুও পুরুষের সমাজে অপমানে দলিত হতে হয়েছে দ্রৌপদীকে। তাই রবীন্দ্রনাথকে লিখে যেতে
হয়েছে “ নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/ কেন নাহি দিবে অধিকার/ হে বিধাতা?” আমার
ভাবনায় এই ‘বিধাতা’ কোন স্বর্গের দেবতা নন, ইনি আসলে সমাজের পুরুষদেরকেই বলেছেন।
কারন আগেই বলেছি পুরুষেরাই সমাজের হর্তাকর্তা। তাই আজকেও নারীকণ্ঠ সোচ্চার হলেই
নেচে উঠছে পুরুষের তলোয়ার। প্রতিদিন বলি হতে হচ্ছে দামিনীদের। আজও নারীর
জীবনপ্রণালী ও জীবনচক্র পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার নানাবিধ সম্পর্কের রূপ
দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে হচ্ছে। নারীবাদী আন্দোলনে মুখর হলেও তাদেরকে স্তব্ধ করে
দেওয়া হচ্ছে। আমি এর জন্য ব্যক্তিগত ভাবে পুরুষদের দোষ দেবনা, দোষটা আসলে
পুরুষনীতির। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই নারীরা তাদের নিজেদের ভাগ্য নিজেরা জয় করে
নিয়েছে। তাহলে ভারতবর্ষের মতো এমন একটা ধর্মীয় ঐতিয্যময় দেশে এভাবে নারীদের দলিত
হতে হচ্ছে কেন? এর উত্তর প্রত্যেক পুরুষেরাই দিতে পারবে। পুরুষ এবার অন্তত ভাবতে
শেখো নারী শুধু পুরুষের শিস্নের খোরাক নয়। তাদের দিয়েই সমাজ তথা দেশের প্রধান
কাজগুলো করানো যাবে। তাদের মধ্যে যে অসীম শক্তি আছে যা রামমোহন, বিবেকানন্দ, দেখতে
পেয়েছিলেন সেই শক্তিকে কাজে লাগাতে দাও। রামমোহনের সেই বক্তব্য অর্থাৎ
বিদ্যাশক্তির যে আকরের কথা তিনি বলেছিলেন তা তো আজ প্রত্যেক মেয়েদের মধ্যে
প্রতিফলিত হয়েছে। তাই শুধু বাহুশক্তি দিয়ে আটকে রাখার দিন অস্তাগত। নারী তার ‘আপন
ভাগ্য’ জয় করার পথে । একদিন তো দেখতেই পাব আর কোন কবিকে “নারীকে আপন ভাগ্য জয়
করিবার” মতো কবিতা লিখতে হচ্ছে না। ফেসবুকে, টুইটারে ইদানিং ‘ মি টু’ প্রতিবাদী
শব্দের ঝড় উঠেছে তাতে যেভাবে নারী-পুরুষ উভয়ে সম্মিলিত হয়েছে সেভাবে নারীদের
সম্মান রক্ষার জন্য, ধর্ষণকামী পুরুষদের থেকে বাঁচানোর জন্যও পুরুষদের এগিয়ে আস্তে
হবে পথে। তখন কলমের মুখ দিয়ে বের হবে
‘বীরকন্যা’ নামের কবিতা। ভারতবর্ষের সব পথ
হবে কণ্ঠকহীন নারীজনিত পথ।
No comments:
Post a Comment