ব্লগ-টগ

প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশের ঘরোয়া সূত্র

Post Page Advertisement [Top]

To Place your advertisement here call - +917980316633/+918145704098


কাবুলিওয়ালা কোন গল্প নয়, কাবুলিওয়ালা কেবল পেস্তা, বাদাম, আখরোট বা আতর ফেরি করা আফগান নয়, চড়া সুদে টাকা ধার দেওয়া ব্যবসাদারও নয় কাবুলিওয়ালা। কাবুলিওয়ালা এক সফরের গল্প। ভালবাসার উত্তরনের গল্প, পরিযায়ী পাখীর উড়ান।ধুলো জমা পাতা উলটে পিছিয়ে গেলে,ইতিহাসের রোমাঞ্চকর এক আখ্যান যেন ভেসে ওঠে। সেই সিল্ক রুট, খাইবার পাস, মধ্য এশিয়া থেকে বানিজ্যের পসরা সাজিয়ে চলে আসা সুঠাম পাঠানেরা মনের পর্দার ফ্ল্যাশব্যাকে হাঁটাচলা করে। মোঘল আমলেও সুদূর আফগানিস্তান অবধি ছিল বানিজ্যিক আর রাজনৈতিক সম্পর্ক। টানা পড়েন থাকলেও, তালিবান উত্থান বা কান্দাহারে ভারতীয় বিমান অপহরনের মতন কিছু ঘটনা বাদ দিলে  ভারত আর আফগানিস্থানের সম্পর্ক, এককথায় সুসম্পর্কই।

সেই সম্পর্কের মোড়কে মায়াবী মলাট পড়িয়েছিলেন রবিঠাকুর। কাবুলিওয়ালা এই শব্দটির ব্যপনের উদ্দীপকও তিনি। অনেক পাতা উলটে দেখেছি, এই বাংলা ছাড়া কোথাও তো কাবুল থেকে আসা বেচু বাবুদের এমন সোহাগি নামে কেউ ডাকে নি। তাই কাবুলিওয়ালা শব্দটা শুনলেই মন চলে যায় কলকাতার গলি পথে।ফেরিওয়ালার ডাক কানে আসে।মনেহয় রহমত বসে আছে। তার পিঠের ঢাউস ঝোলায় ভরা আঙ্গুর, পেস্তা, মেওয়া।পাশে বসে আছে মিনি, যে কথা না বলে একদণ্ড থাকতে পারে না।মনে হয় মিনির মতন আমিও যদি রহমত কে জানতে চাই ওর ঝোলার ভেতর কি আছে, রহমত সেই ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাঙ্গালায় অতিরিক্ত একটা চন্দ্রবিন্দু লাগিয়ে বলবে-হাঁতি।রহমতের সাথে মিনির সখ্যতা, বিচ্ছেদ, রহমতের আবার কাবুলে ফিরে যাওয়া যেখানে অপেক্ষায় তার নিজের মেয়ে সব মিলিয়ে মিশিয়ে যে প্রেক্ষাপট তৈরি হয় তাতে কোলকাতার বিয়ে বাড়িতে বিসমিল্লার সানাইয়ের সুর আফগানের মরু পাহাড়ের ঠিকরে পরা রোদ্দুরে অনুরণিত হতে থাকে।সেই অনুরণনে সউদা নেই, রাজনৈতিক চুক্তি নেই, ইতিহাসের গ্লানি নেই। কেবল আছে স্নেহ আর সীমানা ছাড়া অনুভব।

রবি ঠাকুরের গল্প, তপন সিনহার সিনেমা তো আছেই। এমনকি কাবুলিওয়ালা গল্পের উপর ভিত্তি করেই নির্মিত হয়েছে নতুন ছবি বায়স্কোপওয়ালা।এতো গেল প্রেমের আখ্যান, যদি সত্যি গল্প খুঁজি, তাও আছে। সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা “কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ”, সেতো তালিবান শাসনে ব্যতিব্যাস্ত এক প্রেক্ষাপটের গল্প। নিষ্ঠুরতা, বহুগামী দাম্পত্য, তলিবানি ফতোয়া সব কিছু নস্যাৎ করে কেবল নিজের ভালবাসার জেহাদ টিকিয়ে রাখার গল্প “কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ”।এই শহরে ব্যবসা করতে আসা আফগান যুবকের প্রেমে পড়ে ঘর ছেড়ে চলে যাওয়া এই গল্পের সুত্র ধরেই আরেকটি সিনামা এস্কেপ ফ্রম তালিবান।

কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে না! প্রেম, স্নেহ, ব্যবসা, তালিবান কতো স্তর। তবে কি কাবুলিওয়ালা প্রেমিক, নাকি ব্যবসাদার, নাকি নেহাত সুধখোর!ওরা আসতো কাবুল থেকে। ব্যবসা করতে। কিসমিস, বাদাম বা আতর ফেরি করত কলকাতায়। কেবল কলকাতা কেন ভারতের বিভিন্ন জায়গাতেই, তবে কাবুলিওয়ালা নাম টা বাঙালিরই দেওয়া। আফগান দের সম্পর্কে বদনাম ছিল, তাদের মগজের তুলানায় তলোয়ার চলে দ্রুত। কিন্তু এই প্রেমে পড়ে যাওয়া, কেন? কেবল যুবতির ইনফাচুয়েসেন না নিষ্পাপ শিশুর ভালবাসা্র কারন কি?এমন উথলে ওঠা বাৎসল্য কি কেবলই রবি ঠাকুরের কল্পনা?টা যদি হবে তবে কোলকাতার আধুনিকা কিভাবে প্রেমে পড়ে যান আফগান যুবকের? রোমান্টিকতার চোরা স্রোত হয়ত রয়েই গেছে।


রবি ঠাকুর কে রেফারেন্স মানলে নিছক সুধখোর বলতেও দ্বিধা হয়। বিদেশ বিভূঁই থেকে প্রিয় জন ফেলে চলে আসা মানুষ গুলো থাকতে শুরু করল কোলকাতার কলোনিতে। ব্যাবসার খাতিরে তাদের উঠাবসা সমাজের মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত মানুষদের সাথে, কিন্তু রোজকার জীবনযাপন নেই হাভস নট দের সাথে।হাতে কাঁচা পয়সা। 

ব্যাঙ্কিং ব্যাবস্থা তখনও আয়ত্তের বাইরে। স্বাভাবিক ভাবেই কাবুলিওয়ালা হয়ে উঠলো মানি লেন্ডার। কেবল জুয়া-রেস খেলা মানুষ বা বেশ্যালয়ে চোলাই খাওয়া লক্ষ্মীছাড়া নয়, কোলকাতার বাবুরাও অনেক ক্ষেত্রে কাবুলিওয়ালার কাছে হাত পেতেছে ঋণের জন্য। বাবুয়ানির সাথে আয়ের ইকুইলিব্রিয়াম আনতে না পেরে ধার নিতেই হয়েছে। শোধ না করতে পেরে যখন তারা পালিয়ে বেড়িয়েছে, কাবুলিওয়ালা পিছু নিয়েছে, তাগাদা করেছে।সরল বিশ্বাসী মন ধোঁকা মানতে পারিনি। প্রতিবাদ করেছে তাই বদনাম জুটেছে “সুধখোর”।   
   
ইতিহাস যেমন একটুকুও স্থবির নয়, তেমনি বলদে যাওয়া সময়ে বদলে যায় অনেক কিছু। তাই হারিয়ে গেছে পেস্তা-বাদাম ফেরি করা কাবুলিওয়ালা। তবু রয়ে গেছে নস্টালজিয়া। এইতো সেদিন কলকাতায় খেলতে এলো রশিদ খান। গুগলির ঘায়ে কেমন টপাটপ আউট করে দিচ্ছিল তাবড় তাবড় ব্যাটসম্যানকে। ইডেন গার্ডেনে একাই বিদায় ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়েছিল কলকাতার। নাইট রাইডারস সেদিন হেরে গেলেও ওই কাবুলিওয়ালা কে কুর্নিস জানিয়েছিলাম মনে মনে। মানিক বাবু থাকলে ওনাকে বলতাম, দেখুন বেঁটে কাবুলি!সেও স্বপ্ন দেখায়।

আজও কলকাতায় থাকে তারা। মধ্য কোলকাতার খান কুঠিতে। ব্যবসাদার-মানতে কষ্ট হলেও তারা এখন সুদের কারবার করে। ডিমানিটাইজেসানের পর সত্যিই সমস্যায় ছিল তারা। সাংবাদিক মস্কা নাজিব জি আর নাজিস আফরোজের  তাদের ক্যামেরায় তুলে ধরেছেন কলকাতায় থেকে যাওয়া কাবুলিওয়ালাদের জীবন যাপন।মাক্স মুলার ভবনে এক প্রদর্শনীতে রবি ঠাকুরের কাবুলিওালাই জেন আবার ফিরে এসেছিল নাজিব আর আফরোজের ছবিতে “From Kabul to Kolkata: Of Belonging, Memories and Identity”।

ভাবতে অবাকই লাগে কোন বৈধ নাগরিকত্বের নথি ছাড়াই এই আফগানদের অনেকেই তাদের গোটা জীবন টা কাটিয়েছেন কলকাতায়। তারপর আমাদের এই City of Joy তাদের স্থান দিয়েছে এই শহরের মাটিতে চির ঘুমের জন্য।পরিযযায়ী দের জন্য সীমানা হয় না, দেশ হয় না তেমন কাবুলিওয়ালার আলাদা দেশ হয় না। মনের অভিধানে রহমতের সমার্থক হয়ে রয়ে যায় তারা।

No comments:

Post a Comment

Bottom Ad [Post Page]

To Place your advertisement here call - +917980316633/+918145704098