"রুদালী" শব্দের অর্থ হচ্ছে যাঁরা রোদন
করেন বা এককথায় কাঁদেন।এনাদের আবির্ভাব হয়েছিল মোটামুটি এক শতক আগে অবিভক্ত ভারতের
উত্তর-পশ্চিমাংশে বিশেষ করে রাজস্থানে।শুরু থেকেই শুরু করা যাক তবে।
সেকালের জমিদারদের আত্মীয় স্বজন বা ধরে নেওয়া যাক একজন ঠাকুর মারা গেলেন।তিনি যে মারা গেছেন সেটা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে গ্রামের সমস্ত অধিবাসীদের জানাতে আর সেই ঠাকুর কত মহান সেটা দেখাতেই ডেকে আনা হয় এই রুদালীদের।না না সত্যি ঢাক-ঢোল পেটানোর কাজ এঁরা করেন না তবে কী করতেন?কাঁদতেন!হ্যাঁ বুক চাপড়ে,চিল-চিৎকার করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করবেন যে গ্রামের লোকেরা তো ছুটে আসবেনই বরং তাঁদের বুক চাপড়ানো দেখে তাঁরা নিজেরাও একটু অশ্রুজল নিক্ষেপ করবেন আর কী।
প্রশ্ন আসতেই পারে এরা কাঁদেন কেন?আসলে জমিদার বংশের স্ত্রী পরপুরুষের সামনে একজন ঠাকুর মারা যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করবেন এতে জমিদার বংশের অমর্যাদা হতো।যদিও বা চোখ থেকে জল বেরিয়েও যায় তাও তাঁদের ঘোমটার আড়ালে ঘরের মধ্যে বসেই ওই লাশ দেখে কাঁদতে হতো।কিন্তু এদিকে বুড়ো ঠাকুরের আত্মা তখনও অপেক্ষা করছেন,"ওরে তোরা কাঁদবি না হতচ্ছাড়া!তোরা না কাঁদলে তো স্বর্গে জায়গা হবে না।এই ব্যাটা কাঁদার ব্যবস্থা কর"।পাশ থেকে একজন বলে উঠলেন,"আরে চিন্তা কেন করছেন?এই তো হাজির রুদালীর দল"।বুড়ো ঠাকুর এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হলেন।
তবে এঁরা যে নিজের ইচ্ছায় কাঁদতেন তা একেবারেই নয়,পেটের দায় সমাজের এক নীচু অবহেলিত জাতের মানুষরাই পরবর্তীকালে "রুদালী"-নামক সম্প্রদায় তৈরি হয়।এদের পোশাক বলতে গেলে সবটাই কালো কাপড়ে ঢাকা,কারণ কালো নাকি যমের প্রিয় রং।এরা যে ঘন্টার পর ঘন্টা বুক চাপড়ে,মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে,শ্মশানে আছড়ে পরে,কান্নাকাটি করে খুব রোজকার করতেন তা না।এই বছর তিরিশ আগেও তাঁদের যা রোজকার ছিল তা নগণ্য মাত্র।যে যত ভালো কাঁদার পারফরম্যান্স দেখাবেন তাঁদের তত পুরস্কার দেওয়া হবে।আর কী ছিল সেই পুরস্কার না পাঁচ-ছয় রুপি!একটু সদয় জমিদার হলে বড়জোর কাপড়,দুটো বাঁশি রুটি আর পচা পেঁয়াজ জুটতো।শোনা যায় তাঁদের কাঁদার মাঝে বিরতি দেওয়া হতো।সেই সময় এরা কিছু পেলে খেতেন নাহলে.....।কিছু কিছু জমিদার বাড়িতে মৃত্যুর কাজ বারো দিন ধরে চলত।তখন এঁদের টানা বারো দিন কেঁদে যেতে হতো,নদীর ধারার মতো জল বয়ে যাচ্ছে তবুও এঁদের চোখের জল মোছার অনুমতি নেই,কেন?কারণ এঁদের এই কান্নাই প্রমাণ করবে যে সেই ব্যক্তিটি কতই না মহান ছিলেন।
জমিদারদের বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে কিছু জমিদারের জবরদস্তিতে কখনও জন্ম দিতে হয় অবৈধ সন্তানের।আর সেই সন্তান যদি মেয়ে হয় তাহলে তাঁদের বেঁচে থাকার ক্ষীণ আশা পর্যন্ত শেষ হয়ে যায়।কারণ ওই এলাকায় মানুষদের মধ্যে একটা অন্ধবিশ্বাস সৃষ্টি হয়ে গেছিল যে কন্যা সন্তান পরিবারের জন্য অভিশাপ ডেকে আনে।তাই রুদালীদের মধ্যেই একটি বিখ্যাত কথা আছে,
"পান্দো ভালো না কসকো, বেটি ভালি নায়েক"।কথাটির বাংলা করলে দাঁড়াবে-খালি পায়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে বললেও কষ্ট পাব না, কিন্তু একটি মেয়েসন্তানও যেন ঘরে না আসে।
যদিও বা পুত্রসন্তান জন্ম দিয়ে থাকেন তবুও প্রথমত তাঁরা পিতার সম্পত্তির সমস্ত অংশ থেকে বঞ্চিত হবেন আর দ্বিতীয়ত তাঁরা সমাজে "অছুত" বা "অস্পৃশ্য" হিসেবে গণ্য হবেন।জোরপূর্বক প্রান্তিক করে রাখা এই সম্প্রদায় তাদের যাবতীয় ফরিয়াদ জানায় "ভেরুজি" ভগবানের কাছে।তবে কামপ্রবণ হয়ে অসংখ্য নারীর ক্ষতি করেছেন এই ভগবান,এই কাহিনী রাজস্থানের প্রায় সবার মুখে মুখেই প্রচলিত আছে।তার শিকারও ছিল সমাজের নিচু জাতের নারীরা।উঁচু জাতের প্রতিনিধিত্বকারী এই দেবতাকে তাই রুদালিরা নিজেদের ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছে।
রুদালিদের বেশ কিছু সমাজে বিয়ে করারও নিয়ম নেই।নিজের পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে লোকের মৃত্যুতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাঁদবে কে?চেনা নেই, জানা নেই, রক্তের সম্পর্ক নেই; কেবল অর্থের বিনিময়ে মানুষের বাড়িতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থে লোক দেখিয়ে কাঁদার জন্যই যেন জন্ম হয়েছে তাদের।তবে তাঁদের চোখে যে সবসময় জল আসত এমনও না,তখন মুখের ভঙ্গি আর অভিনয়ই উপায়।তবে যাঁরা পেশাদার তাঁদের কাঁদার ছিল কিছু কৌশল।কেউ থুতু দিয়ে চোখে জলের রেখা বানাতেন,কেউ একপ্রকার গাছের শিকড় ব্যবহার করতেন যা গ্লিসারিনের কাজ করত আবার কেউ কাজলের মতো একধরনের কালি ব্যবহার করতেন যা চোখে দিলে তীব্র জ্বালা সৃষ্টি হয় এবং চোখ থেকে জল পড়ে।কখনও কখনও যেন এঁদের জীবন অতিবাহিত হতো এই ভেবেই যে কখন কোনো মৃত্যুর খবর আসবে আর ডাক পড়বে।অনিচ্ছা সত্ত্বেও এঁরা জমিদারদের মৃত্যু কামনা করতেন।
এভাবেও কী বেঁচে থাকা যায়?সম্ভব ছিল?একবার ভাবুন তো ভেবে দেখুন।একজন অচেনা অজানা মানুষ যাঁকে সারাজীবন সে দেখেওনি কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই,সেই মানুষের জন্য নিজের আবেগ জলাঞ্জলি দিয়ে কাঁদতেন এই "রুদালী"।পরবর্তীকালে এঁদের নিয়ে প্রচুর লেখা হয়েছে এমনকি মহাস্বেতা দেবীর গল্প অবলম্বনে ডিম্পল কাপাডিয়া অভিনীত "রুদালী" সিনেমাটি খুবই জনপ্রিয়।রাজস্থানের জমিদাররা এখন হয়তো নির্বাক নিশ্চুপ ভাবেই শেষকৃত্য পছন্দ করেন।আধুনিকতার গ্রাসে ফুরিয়েছে রুদালীদের প্রয়োজন।এখন আর তাঁদের কেউ ডাকে না,দেখাও যায় না।হয়তো কোনো এক নতুন পেশায় নিযুক্ত হয়েছেন কিংবা সভ্যতার মাঝে হারিয়ে গেছেন।বা হয়তো এখনও অস্তিত্ব আছে কোনো এক গন্ডগ্রামে যেখানে আধুনিকতার আলো পৌছায়নি।
সেকালের জমিদারদের আত্মীয় স্বজন বা ধরে নেওয়া যাক একজন ঠাকুর মারা গেলেন।তিনি যে মারা গেছেন সেটা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে গ্রামের সমস্ত অধিবাসীদের জানাতে আর সেই ঠাকুর কত মহান সেটা দেখাতেই ডেকে আনা হয় এই রুদালীদের।না না সত্যি ঢাক-ঢোল পেটানোর কাজ এঁরা করেন না তবে কী করতেন?কাঁদতেন!হ্যাঁ বুক চাপড়ে,চিল-চিৎকার করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করবেন যে গ্রামের লোকেরা তো ছুটে আসবেনই বরং তাঁদের বুক চাপড়ানো দেখে তাঁরা নিজেরাও একটু অশ্রুজল নিক্ষেপ করবেন আর কী।
প্রশ্ন আসতেই পারে এরা কাঁদেন কেন?আসলে জমিদার বংশের স্ত্রী পরপুরুষের সামনে একজন ঠাকুর মারা যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করবেন এতে জমিদার বংশের অমর্যাদা হতো।যদিও বা চোখ থেকে জল বেরিয়েও যায় তাও তাঁদের ঘোমটার আড়ালে ঘরের মধ্যে বসেই ওই লাশ দেখে কাঁদতে হতো।কিন্তু এদিকে বুড়ো ঠাকুরের আত্মা তখনও অপেক্ষা করছেন,"ওরে তোরা কাঁদবি না হতচ্ছাড়া!তোরা না কাঁদলে তো স্বর্গে জায়গা হবে না।এই ব্যাটা কাঁদার ব্যবস্থা কর"।পাশ থেকে একজন বলে উঠলেন,"আরে চিন্তা কেন করছেন?এই তো হাজির রুদালীর দল"।বুড়ো ঠাকুর এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হলেন।
তবে এঁরা যে নিজের ইচ্ছায় কাঁদতেন তা একেবারেই নয়,পেটের দায় সমাজের এক নীচু অবহেলিত জাতের মানুষরাই পরবর্তীকালে "রুদালী"-নামক সম্প্রদায় তৈরি হয়।এদের পোশাক বলতে গেলে সবটাই কালো কাপড়ে ঢাকা,কারণ কালো নাকি যমের প্রিয় রং।এরা যে ঘন্টার পর ঘন্টা বুক চাপড়ে,মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে,শ্মশানে আছড়ে পরে,কান্নাকাটি করে খুব রোজকার করতেন তা না।এই বছর তিরিশ আগেও তাঁদের যা রোজকার ছিল তা নগণ্য মাত্র।যে যত ভালো কাঁদার পারফরম্যান্স দেখাবেন তাঁদের তত পুরস্কার দেওয়া হবে।আর কী ছিল সেই পুরস্কার না পাঁচ-ছয় রুপি!একটু সদয় জমিদার হলে বড়জোর কাপড়,দুটো বাঁশি রুটি আর পচা পেঁয়াজ জুটতো।শোনা যায় তাঁদের কাঁদার মাঝে বিরতি দেওয়া হতো।সেই সময় এরা কিছু পেলে খেতেন নাহলে.....।কিছু কিছু জমিদার বাড়িতে মৃত্যুর কাজ বারো দিন ধরে চলত।তখন এঁদের টানা বারো দিন কেঁদে যেতে হতো,নদীর ধারার মতো জল বয়ে যাচ্ছে তবুও এঁদের চোখের জল মোছার অনুমতি নেই,কেন?কারণ এঁদের এই কান্নাই প্রমাণ করবে যে সেই ব্যক্তিটি কতই না মহান ছিলেন।
জমিদারদের বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে কিছু জমিদারের জবরদস্তিতে কখনও জন্ম দিতে হয় অবৈধ সন্তানের।আর সেই সন্তান যদি মেয়ে হয় তাহলে তাঁদের বেঁচে থাকার ক্ষীণ আশা পর্যন্ত শেষ হয়ে যায়।কারণ ওই এলাকায় মানুষদের মধ্যে একটা অন্ধবিশ্বাস সৃষ্টি হয়ে গেছিল যে কন্যা সন্তান পরিবারের জন্য অভিশাপ ডেকে আনে।তাই রুদালীদের মধ্যেই একটি বিখ্যাত কথা আছে,
"পান্দো ভালো না কসকো, বেটি ভালি নায়েক"।কথাটির বাংলা করলে দাঁড়াবে-খালি পায়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে বললেও কষ্ট পাব না, কিন্তু একটি মেয়েসন্তানও যেন ঘরে না আসে।
যদিও বা পুত্রসন্তান জন্ম দিয়ে থাকেন তবুও প্রথমত তাঁরা পিতার সম্পত্তির সমস্ত অংশ থেকে বঞ্চিত হবেন আর দ্বিতীয়ত তাঁরা সমাজে "অছুত" বা "অস্পৃশ্য" হিসেবে গণ্য হবেন।জোরপূর্বক প্রান্তিক করে রাখা এই সম্প্রদায় তাদের যাবতীয় ফরিয়াদ জানায় "ভেরুজি" ভগবানের কাছে।তবে কামপ্রবণ হয়ে অসংখ্য নারীর ক্ষতি করেছেন এই ভগবান,এই কাহিনী রাজস্থানের প্রায় সবার মুখে মুখেই প্রচলিত আছে।তার শিকারও ছিল সমাজের নিচু জাতের নারীরা।উঁচু জাতের প্রতিনিধিত্বকারী এই দেবতাকে তাই রুদালিরা নিজেদের ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছে।
রুদালিদের বেশ কিছু সমাজে বিয়ে করারও নিয়ম নেই।নিজের পরিবারের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে লোকের মৃত্যুতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাঁদবে কে?চেনা নেই, জানা নেই, রক্তের সম্পর্ক নেই; কেবল অর্থের বিনিময়ে মানুষের বাড়িতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থে লোক দেখিয়ে কাঁদার জন্যই যেন জন্ম হয়েছে তাদের।তবে তাঁদের চোখে যে সবসময় জল আসত এমনও না,তখন মুখের ভঙ্গি আর অভিনয়ই উপায়।তবে যাঁরা পেশাদার তাঁদের কাঁদার ছিল কিছু কৌশল।কেউ থুতু দিয়ে চোখে জলের রেখা বানাতেন,কেউ একপ্রকার গাছের শিকড় ব্যবহার করতেন যা গ্লিসারিনের কাজ করত আবার কেউ কাজলের মতো একধরনের কালি ব্যবহার করতেন যা চোখে দিলে তীব্র জ্বালা সৃষ্টি হয় এবং চোখ থেকে জল পড়ে।কখনও কখনও যেন এঁদের জীবন অতিবাহিত হতো এই ভেবেই যে কখন কোনো মৃত্যুর খবর আসবে আর ডাক পড়বে।অনিচ্ছা সত্ত্বেও এঁরা জমিদারদের মৃত্যু কামনা করতেন।
এভাবেও কী বেঁচে থাকা যায়?সম্ভব ছিল?একবার ভাবুন তো ভেবে দেখুন।একজন অচেনা অজানা মানুষ যাঁকে সারাজীবন সে দেখেওনি কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই,সেই মানুষের জন্য নিজের আবেগ জলাঞ্জলি দিয়ে কাঁদতেন এই "রুদালী"।পরবর্তীকালে এঁদের নিয়ে প্রচুর লেখা হয়েছে এমনকি মহাস্বেতা দেবীর গল্প অবলম্বনে ডিম্পল কাপাডিয়া অভিনীত "রুদালী" সিনেমাটি খুবই জনপ্রিয়।রাজস্থানের জমিদাররা এখন হয়তো নির্বাক নিশ্চুপ ভাবেই শেষকৃত্য পছন্দ করেন।আধুনিকতার গ্রাসে ফুরিয়েছে রুদালীদের প্রয়োজন।এখন আর তাঁদের কেউ ডাকে না,দেখাও যায় না।হয়তো কোনো এক নতুন পেশায় নিযুক্ত হয়েছেন কিংবা সভ্যতার মাঝে হারিয়ে গেছেন।বা হয়তো এখনও অস্তিত্ব আছে কোনো এক গন্ডগ্রামে যেখানে আধুনিকতার আলো পৌছায়নি।
No comments:
Post a Comment