- ঋদ্ধিমান
চিল্কা,১১০০ বর্গ কিলোমিটার
বিস্তৃত এই উপহ্রদটি ভারতের বৃহত্তম
এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কোস্টাল লেগুন। ভূগোলের ভাষায় চিল্কার জল “ব্রাকিস”
,যেটা নাকি নোনতা হলেও সমুদ্রের জলের মতন ততটা নোনতা নয়। তবে রূপে আর বিস্তৃতিতে
চিল্কার জুরি নেই। পান্না সবুজ ঢেউ তোলা জলে
ইতিউতি ঘুরে বেড়াতে আর দলছুট ডলফিনের লাফানো-ঝাপানো দেখতে অনেকেই চিল্কায় ঢু
মারেন। তবে বেশীরভাগ পর্যটকই চিল্কায় যান,পুরীর কাছে সতপড়ায়। মানচিত্রে যদি একবার
চোখ রাখা হয়,তবে বোঝা যাবে চিল্কার আসল সৌন্দর্য আর বিস্তারের
সাক্ষী হতে আসতে হবে সতপড়ায় নয়, রম্ভা বা বরকুলে।
সেই মজা নিতেই চলে আসা
রম্ভায়। গঞ্জাম জেলায় অবস্থিত এই রম্ভায় আসতে রাতের হাওড়া-চেন্নাই মেলে চেপে
পড়লাম। পরেরদিন সক্কাল সক্কাল নেমে পড়া গেল, বালুগাঁও। সেখান থেকে রম্ভার ওটিডিসি
পান্থনিবাস মিনিট চল্লিশের পথ। আগে থেকে বলে রাখায় কামেশ্বর বাবু গাড়ী নিয়ে
স্টেশনে হাজির ছিলেন। স্টেশন লাগোয়া ঘিঞ্জি পাড়া পেরিয়ে এলেই হাইওয়ে। একপাশে
ছোটছোট পাহাড় নিয়ে পথ চলেছে রম্ভার দিকে। টিয়া পাখির মতন সবুজ সেই পাহাড়েই যেন
মিশে আছে গল্পের মলাট খোলার আমন্ত্রণ।
রম্ভার পান্থনিবাসে পৌঁছানোমাত্র পেলাম গোবর্ধনের
আপ্যায়ন । দোতলার ঘরে লাগেজ রেখে,ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই দেখলাম চোখ জুড়ানো
জলরাশি,দিগন্তবিস্তৃত । সেই জলরাশির উপর খাঁড়া দাঁড়িয়ে ঘন্টাশিলা পাহাড়।
পান্থনিবাসের বাগানে কশমশ আর গোলাপের ঝোপে তখন রোদের লুটোপুটি খেলা। হাঁটি হাঁটি
পা চুম্বকের মতন টেনে নিযে যায় চিল্কার পাড়ে। সোহাগী নীল জলের হাওয়া অনায়াসে পৌঁছে
যায় শরীরের গহনে।
শীতের বিকেল। নরম রোদ্দুর আর ঠান্ডা বাতাস মেখে
পান্থনিবাস লাগোয়া জেটি বরাবর হাঁটতে থাকলাম। সার বেঁধে
নৌকা বাঁধা পাড়ে। মৃদু ঢেউয়ে দুলছে,ঠিক যেন রবি ঠাকুরের কবিতা—“নদীর ঘাটের কাছে
নৌকা বাঁধা আছে”।
আমরা যাব নৌবিহারে। বাসুদেব আমাদের সাথেই আছে।
মোটরটানা নৌকায় আমাদের নিয়ে বাসুদেব চলল ব্রেকফাস্ট আইল্যান্ড। চিকন বাতাস আর রোদে
চিকচিকে ঢেউ ভেঙে বাসুদেবের মোটর বোট এগিয়ে চলল। পাড়ের কাছে পানকৌড়ি তো ছিলই,যতই
লেগুনের গভীরে পৌঁছেছি ততই ভীড় বেড়েছে কতনা পরিযায়ী পাখীর। গ্রেল্যাগ গিজ,
পার্পল্ মুরহেন, হেরন এমনকি সিগ্যালও ঝাঁক বেঁধে চরে বেড়ায় চিল্কার বুকে। ওই সব
পাখিদের ওড়াওড়ি দেখতে দেখতে সময় বয়ে গেল।
ব্রেকফাস্ট
আইল্যান্ড, ঘন্টাশিলা আইল্যান্ড, হানিমুন আইল্যান্ড এরকম লেগুনের
বুকে ছড়িয়ে থাকা দ্বীপগুলিতে ঢু মারতে মারতে খেয়াল করলাম,সূর্য পাটে বসেছে। বৈরাগী
রঙ লেগেছে আকাশে। উড়ন্ত খেচরের ডানায় পিছলে যাচ্ছে বেলাশেষের আলো। মাঝ লেগুনে
বাসুদেব নৌকা নোঙর করল। পশ্চিমে সূয্যিমামা দিগন্তে ঢুলে পড়ছেন,লেগুনের জল থেকে
শ্যাওলা আর সি-গ্রাসের ভেজা গন্ধ উঠছে। সাঁঝবাতির রূপকথারা ছড়িয়ে পড়ছে আকাশের কোল
ঘেঁষে।
রাতে ব্যালকনিতে বসে আছি। রিসর্টের অর্ধেক আলো
নিভে গেছে। পিছনের লনে গোটাকতক রাজহাঁস
বসে আছে। গোবর্ধন এসে রাতের খাবারও দিয়ে গেছে। বাসুদেব বলে গেছে কাল ভোরে ডেকে
দেবে,ওর নৌকায় চেপে,চিল্কায় ভেসে দেখবো ভোর হওয়া। কেমন করে জলের আদুরে ছোঁয়াছ ছেড়ে
সূয্যি মামা রাঙা জামা পড়ে উদয় হবেন সেই কল্পনাতেই জেগে থাকা যায় অনেকটা রাত।
অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙল,তখন সবে পাঁচটা।
কুয়াশার চাদরে মোড়া রম্ভা তখনও ঘুমিয়েে। রিসেপশানে এসে দেখি বাসুদেবও হাজির।
সূর্যোদয় পৌনে ছটায়,তাই একটু উষ্ণতা ভরা চা এনে হাজির করেছে গোবর্ধন। গরম চায়ের
কাপে বিস্কুট ডুবিয়ে মেজাজ তৈরি করছি,দেখি হাফ ডজন
কুকুরছানা লেজ নড়ে হাজির। বিস্কুটের বিনিময়ে সবে সখ্যতা হচ্ছিল ডাকদিল বাসুদেব,
সাম্পান ভাসাতে হবে জলে।
লেগুনের শরীরে থোকা থোকা অন্ধকার। সেই অন্ধকার
ঘেটে আমাদের নৌকা চলল চিল্কার বুকে। জমাট কুয়াশার নকশীকাঁথায় ঢাকা পড়েছে পাহাড়
গুলো। নবোযার আলোও তাই আড়ালে। প্রায় ঘন্টাদুয়েক জলে চরলাম।দেখলাম ভোর হওয়া,ফড়িংয়ের
মতন নরম নীলচে এক ভোর। দেখলাম কুয়াশার পর্দা সরিয়ে
ভোরের আনন্দরক্ত মেঘে মেঘে লাল হয়ে উঠল। যেন এক মায়াবী ভোর। সেই মায়ার আলোয় গা
চুবিয়ে পানকৌড়ি,হেরন আর সিগ্যাল ওত পেতেছে মাছের
আশায়। আমরাও গোগ্রাসে চেটে পুটে নিয়েছি সেই রমনীয়তা যেটুকু উদ্বৃত্ত তা ধরা আছে ক্যামেরাতে।
দুপুরে গন্তব্য , নাম আলেশ্বর। রম্ভা থেকে গাড়ীতে একঘন্টার পথ।বট গাছের ছায়ায়
মোড়া আলেশ্বর শিব মন্দিরের পাশ দিয়ে উঁচু-নীচু বালিয়াড়ি পথ চলেগেছে সুমুদ্দুরের
পানে। দুপাশে কেয়া আর ঝাউ’এর বন। সোনালী ডানার চীল আকাশ জুড়ে উড়ে চলে। ইতস্ততঃ জমা
জলায় পানকৌড়ি আর কাদাখোঁচা চরে বেড়ায়। ঠান্ডা নোনতা গন্ধ মাখা বাতাস চোখ আর ঠোঁট
ছুঁয়ে যায় আলতো করে। কেউ কোথাও নেই। বীচ
বরাবর চোখ মেললে কেবল পৌনপুনিক ঢেউ,ফেনা হয়ে ভাঙছে পাড়ে। জেলেরা জাল বোনে বালিতে
পা ছড়িয়ে। শাঁখ আর ঝিনুকের খোলা ভেসে আসে ঢেউ বেয়ে। রোদে ভিজে বীচ রোমান্টিকতা
ছড়ায়। শীতের শেষে সারে সারে আসে অলিভ রিডেল টারটেল,ডিম পাড়তে।
অবশেষে দুদিনের রোমান্সের পর পরিযায়ী পাখীর মতন
ফিরে আসি। স্মৃতিতে রয়ে যায় রমনীয় রম্ভা।
No comments:
Post a Comment