উত্তরবঙ্গে যাওয়ার কথা
উঠলেই বৈজয়ন্তীর বুকের মধ্যে আজও পার
ভাঙে বানভাসি তিস্তা , দ্রিমী ....দ্রিমী..... দ্রিমী একটানা একটা সুর কোন গভীর
থেকে কে জানে ভেসে আসতে থাকে তার
কানে। হাতছানি দেয় ছনের চালে
ছাওয়া মাটির দাওয়া , কাঠের উনুনে ধোয়া মাখা ভাত ফুটে ওঠার শব্দ , হাঁড়িয়া আর
মাদলের মাতাল সন্ধ্যা । ‘বাড়ি’ ...বড় মায়াময় একটা শব্দ , দীর্ঘস্বাস ফেলে
বৈজয়ন্তী| আজ যেন একটু বেশি আনমনা হয়ে পড়ছে সে বারে বারে। আজকে তাদের গন্তব্য মালবাজারের কাছে একটা মৃত চা বাগান। দিল্লীর
এক বাংলো থেকে উদ্ধার হওয়া ছোট্ট দুলিকে আজ ফিরিয়ে দেওয়া হবে তার পরিবারের কাছে।
অনেক বছর আগে এই বাগান থেকেই
হারিয়ে গিয়েছিল স্বপ্না ওরাওঁ। সদ্য
কিশোরী স্বপ্নার তখন দুচোখ জুড়ে স্বপ্ন আর পেট জুড়ে খিদে। বাপ মরে যাওয়ার পর অন্য মরদকে বেনজা
(বিয়ে) করে মা টা তখন নতুন সংসার পেতেছে কুলি লাইনের বস্তিতে। স্বপ্না ছাড়াও কোলে আর
কাঁখে আরো দুটো কে নিয়ে কিবা আর করার ছিল মায়ের। ওই বস্তিরই এক মহিলা মাকে খুব
বোঝালো দিল্লীতে ভালো নোকরি পাওয়া যায় , মেয়েকে একবার পাঠিয়ে দিলে একদম রাজকুমারীর মতো থাকবে। বাড়িতেও টাকা পাঠাবে মাসে মাসে। সবাই সুখে থাকবে। আধপেটা খেয়ে প্রায়বন্ধ চা বাগানের ঝোপড়িতে ধুঁকতে থাকা মানুষগুলোর কাছে ‘সুখ’ শব্দটা যে বড় লোভনীয়। দুবেলা পেটভরে খেতে পাওয়ার জন্যে শুধু দিল্লী কেন ,এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যেকোনো
জায়গায় তারা যেতে রাজি। তাই সেই মৌসি র হাত ধরে বাড়ির বড়ো মেয়ে স্বপ্নার যাত্রা
শুরু হোল সুখ স্বাছ্যন্দের খোঁজে।
প্রথমে ওর মতো আরো বেশ
কয়েকটি মেয়ের সাথে শিলিগুড়ির বাস স্ট্যান্ড, তারপর অন্ধকারময় পাঁচটা বছর , জম্মু
থেকে হরিয়ানা, হরিয়ানা থেকে দিল্লী ক্রমাগত এক হাত থেকে আর এক হাতে বিক্রি হতে হতে
আর অকথ্য অত্যাচার সইতে সইতে শেষপর্যন্ত ঠাঁই হয়েছিল দিল্লীর জি বি রোড এ। পালানোর চেষ্টা করেছে স্বপ্না দুবার ,পারেনি শুধু নজরদারি আর অত্যাচার এর মাত্রা আরো বেড়ে গেছিলো।
এই জি বি রোডেই দেখা
হয়েছিল সীমা দিদির সাথে, দিল্লী পুলিশ এর সাথে রেড করতে এসেছিলো সেখানে। ওকে আর ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাচার হয়ে আসা ওর মতো আরো
অনেককে উদ্ধার করা হয়েছিল সেদিন। তারপর থানা পুলিশ , আবার শিলিগুড়ি আর তারপর সেই চা বাগানের কুলি বস্তি। স্বপ্নার মনে তখন
মুক্তির বাঁধ ভাঙা আনন্দ , ঘরে ফেরার খুশি , মা ভাই সবাইকে আবার দেখতে পাবে সে ,
আর তাকে সইতে হবে না অমানুষিক অত্যাচার। আজ থেকে আবার তার পরিচয় নির্মলা ওরাওঁ আর মনোজ
ওরাওঁ র বিটি স্বপ্না ওরাওঁ।
কিন্তু কৈশোর উত্তীর্ণ
করে সদ্য যৌবনে পা দেওয়া স্বপ্না বুঝতে পারেনি একবার চৌকাঠ পেরোলে মেয়েদের আর ঘরে
ফেরা হয় না। সাত হাত ঘুরে আসা মেয়েকে ঘরে তুললে তার পরিবারকে সবাই একঘরে করে দেবে
সেই ভয়ে বাড়িতে ঢুকতে দিলো না কেউ তাকে। অভিমানী জল ভরা চোখে সেই মুহূর্তে একটাই নাম মনে এসেছিলো তার
,সীমা ভার্গব। পুলিশ এর সাহায্য নিয়ে আবার দিল্লীর পথে তবে এবার আর অন্ধকার নয়, আলোর দিকে।
গাড়ির কাঁচ নামিয়ে
দিতেই নাকে ঝাপ্টা মারে চা
বাগানের সোঁদা মাটির গন্ধ , এলোমেলো হয়ে যায় সব চিন্তা। পরিবার তাকে ফিরিয়ে
দেওয়ার পর এই প্রথম নিজের গ্রামে যাচ্ছে বৈজয়ন্তী। হ্যাঁ, স্বপ্না ওরাওঁ নামটা শুধুই
অতীত তার কাছে। সীমা দিদির দেওয়া নাম বৈজয়ন্তী আজ তার পরিচয়।
সীমা দিদির সাহায্যে আর
উৎসাহে আবার শুরু করেছিল পড়াশোনা ,
মুক্তবিদ্যালয় , মুক্তবিশ্ববিদ্যালয় আর সব শেষে ওদের সংস্থায় যোগ দেওয়া। এখন তার কাজ পরিবার,
গাওঁবুঢ়া সবাই কে বুঝিয়ে আরো অনেক স্বপ্নাদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করা। প্রায়ই
উত্তরবঙ্গে আসতে হয় তাকে। গ্রামে, গ্রামে, চা বাগানে ঘুরে সবাইকে মানব পাচারের বিরুদ্ধে সচেতন করে
আর আরকাঠিদের চিনিয়ে দেয়। সীমা দিদি দের সংস্থার হয়ে কাজ করে সে, সাহায্য করে
পুলিশ ও প্রশাসন কে। স্বপ্না ওঁরাও কোনোদিন ফিরতে পারেনি তার নিজের বাড়িতে তাই
বৈজয়ন্তী আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পাচার রুখতে আর প্রতি বছর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে
পাচার হয়ে আসা মেয়েদের ফিরিয়ে দিতে তাদের নিজের ঠিকানায়।ঝাপসা হয়ে আসা চোখের
সামনে দিয়ে পার হয়ে যেতে থাকে তার ছোটবেলার খেলার মাঠ, বন্ধ ফ্যাক্টরি, বাবুদের
বাংলো। আজ একবার মা বুড়িটার সাথে দেখা করেই যাবে সে , কি যেন বেঁচে আছে কিনা
…….....।।
No comments:
Post a Comment