পড়তে
চেয়েছিল সত্যবতী। বইয়ের জগতে মুক্তি খুঁজে পেয়েছিল সে। আজও ঘরে ঘরে কিছু সত্যবতীর
দেখা মেলে বৈকি! সে ভালবেসেছিল চোখের সামনে ভাসতে থাকা কালো অক্ষরগুলোকে।
সেগুলো শুধু অক্ষর ছিলনা, সাদা মেঘের বুকে দূরদূরান্তে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া পক্ষীকূল
ছিল যেন। আমি দেখেছি এমন দুজনকে, যারা লড়াইয়ের ময়দানে নামেনি, শুধু হাতে তুলে
নিয়েছিল বই। এ লেখা কোন স্মৃতিচারণ নয়, আত্মোপলব্ধি এক।
প্রথমজন আজ আর নেই, অন্য এক দুনিয়ায় চলে
গেছেন বেশ কিছু আগেই। তাঁকে যখন আমি দেখি আশিটা বসন্ত
পেরিয়ে এসেছেন তিনি (যদিও তাঁর সাথে আমার পরিচয় শৈশবকাল থেকেই, বন্ধুতার কাল আসে তাই
কিছুকাল পরেই)। এককালের জমিদার বাড়ির গৃহিণী হয়ে
আসেন অতি অল্প বয়সে। ছোট্টো কাঁধে চাপে নিয়মমাফিক দায়িত্ব, কর্তব্য। তারপর যে কে
সেই! যেমনটা হয়ে এসেছে চিরকাল নারীর দৈনন্দিন যাপন, এখানেও তার অন্যথা হওয়ার জো
নেই। কিন্তু সেই চিরকালের নারীর ভেতরটা কেমন ছিল! জলোচ্ছাসের মত উচ্ছল, আবার স্থির
সাগরের মত অতল। বাবা, মায়ের আদরিনী কন্যা, শুনিয়েছিলেন ছোটবেলার গল্প। আর বছর আট-দশের একটি বালিকা অবাক,
মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকত তাঁর দিকে, শুনত তার কথা। করত অনেক প্রশ্ন। তার ওই ছোট্ট জীবনে
সে তো এমনটি আগে কখনও দেখেনি!
টুকরো টুকরো গল্পে কখনও আসত তাঁর ছোটবেলার
দুর্গাপুজো। বাবার সাথে নতুন জামা, জুতো কিনতে যাওয়া অন্য ভাইবোনদের সাথে। বাবা রামকালী ছিলেন
কিনা জানিনা, কিন্তু কন্যার মধ্যে ছিল লেখাপড়ার প্রতি অসীম আগ্রহ আর কৌতূহল। বাবার
তাতে প্রশ্রয় ছিল নিশ্চয়! তা নাহলে বিশাল সংসারের প্রতি কর্তব্য করে, সন্তানদের
মানুষ করেও অনর্গল বলতেন লুকোচুরি কিংবা কর্ণকুন্তীসংবাদ। সেই বালিকাটিও তখনই জেনে
গেছে কালো কালো অক্ষরগুলো কীভাবে প্রবল আকর্ষণ করে। সেও বলে যেত সমানে সমানে।
সুকুমার রায়, সুকান্ত, এমনকি শরৎচন্দ্র, বাদ থাকত না কিছুই। কিন্তু আশিটা বসন্ত, বড় দীর্ঘ সে সময়। তাই তার পরের সময়টা তাড়াতাড়ি
পেরিয়ে গেল। সে বালিকা কিশোরীবেলার শেষে পৌঁছলে, তিনি
আরও বেশি বন্ধু হয়ে উঠলেন যেন! সে তখন লুকোচুরি পেরিয়ে অভিসারের মাহাত্ম্য বোঝার সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে। তাকে নারীজীবনের
গভীরতা উপলব্ধি করাতে চেয়েছিলেন। কোন সুতো কতটা টেনে ধরলে ছিঁড়ে যায়, আর কাকে আলগা
করলে ছেড়ে বেড়িয়ে যায়! তাঁর চেতন মনন, সবই তো নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা আর বইয়ের পাতা থেকে
তুলে উপলব্ধির মণিমাণিক্য দিয়ে তৈরি হয়েছিল। যা তিনি দিতে চেয়েছিলেন অনাত্মীয় সেই কিশোরীটিকে।
কিন্তু আর কিসের সমাহার ছিল তাঁর অন্তরে, গহন মনের কোণে কি চাওয়া ছিল, কিছুই জানা হয়নি সে
বালিকার। সত্যবতীকেও সে জানত না তখন। আজ উপলন্ধি হয় তিনি তো সত্যবতীই ছিলেন।
বলেছিলেন, কত কি করব ভেবেছিলাম, সেসব আর হলনা। কিন্তু তুই করিস। বলতেন, হার মানবিনা, মাথা নোয়াবিনা অন্যায়ের, অনৈতিকতার সামনে।
এমন করে কীভাবে শিখেছিলেন তিনি! বিশাল সংসারের নানান দায় সামলে, কর্তব্য করেও নিজের
দৃপ্ত, দীপ্ত অন্তরটিকে হারিয়ে যেতে দেননি। বালিকাটিকে তিনি ক্ষণপ্রভা নাম দিয়েছিলেন। সে নাকি বিদ্যুতের মত এসে হঠাৎ আলোর ঝলক এনে দেয় তাঁর
কাছে। আসলে তিনিই ছিলেন তার ক্ষণপ্রভা। ক্ষণিকের প্রভা দিয়ে চলে গেলেন। আজ হঠাৎ বলে ওঠা প্রিয় কবিতায়, হঠাৎ ঝড়বৃষ্টির রাতে তাঁর আবছা হয়ে যাওয়া
মুখ ভেসে আসতে চায়। চোখের কোণটা ভিজে ওঠে যেন! পরের জন্ম যদি থাকে, সে যেন আবার তাঁকে
পায়।
দ্বিতীয়জন, তাঁকে আমি দেখেছি বালিকাবেলা থেকে। স্নেহময়ী, অনাবিল হাসির এক শান্তমুর্তি।
কিন্তু তাঁকে নতুন করে চিনেছি তারুণ্যে পৌঁছে। পনেরো বছর বয়সে বড় পরিবারের বঁধু হয়ে
আসেন, প্রথাগত পড়াশোনার ইস্কুলে পড়েছিলেন বেশ কিছু সময়। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেনি তিনি। সংসার সামলে,
সন্তানদের বড় করে ভেতরে ভেতরে অতি যত্নে লালন করেছেন একটা স্পর্শকাতর, ভাবালু হৃদয়। যার সব ভালবাসা এসে জমা হত বইয়ের পাতায়। আদরের
নাতনীটি বইপাগল। নতুন বই আসা মাত্রেই পড়ুয়া নাতনীটির পরেই সেখানে তাঁর অধিকার। সে
শিশুসাথী শুকতারা হোক, কিংবা কোন নতুন লেখকের উপন্যাস।
কিন্তু কীভাবে পেলেন বইয়ের পাতায় বেঁচে
থাকার রসদ! আসলে মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলেন সেখানে। সমাজের শৃঙ্খলাবদ্ধ যে নারীজীবনে
কোন একসময় বইয়ের ওপর তাদের কোন অধিকারই দেওয়া হয়নি, তার রহস্য রোমাঞ্চটিকে ধরতে
পেরেছিলেন। তার জন্য তাঁকে পাশ করতে হয়নি স্কুল, কলেজের বাঁধাধরা পরীক্ষার জগৎ।
জানতে হয়নি গভীর কোন তত্ত্ব কিংবা তথ্য। এখানেই জয় হয়েছে তাঁর। সত্তর পার করা তিনি
বেঁচে থাকুন বইয়ের জগতে। অনাবিল হাসির সাক্ষী হই রোজ।
একবিংশ শতক নারীকে দিতে চায় সমানাধিকার।
অপমান আর অবরোধের জীবন থেকে মুক্তি চায় সে। কিন্তু এই নারীরা ঘরে বসেই বুঝতে
পেরেছিলেন, নারীর মুক্তির ক্ষেত্র, সম্মান লাভের পথ এনে দিতে পারে একমাত্র শিক্ষা।
নিজেরা প্রথাগত শিক্ষায় ডিগ্রি লাভ না করলেও স্বশিক্ষিত হতে পেরেছিলেন নিজেরা। তাই
পরের প্রজন্মকে সেই রাস্তার দিকনির্দেশ করেছেন ক্রমাগত। বইয়ের কালো অক্ষরগুলোই
তাঁদের চেতনায় বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিল। যা তাঁদের ভাবজগতে পরিবর্তন এনেছিল।
সত্যবতীরা ছিল অন্দরমহলে, তাদের উত্তরসূরিরা সেইসব সত্যবতীদের মননে অনুপ্রাণিত হয়ে
চলুক।
No comments:
Post a Comment