ব্লগ-টগ

প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশের ঘরোয়া সূত্র

Post Page Advertisement [Top]

To Place your advertisement here call - +917980316633/+918145704098


দূরের উপত্যকায় সবুজ ঘাসের উপর তখনও বিকেলের সূর্য। আরও দূরের পর্বতমালার গায়ে তখন মেঘেদের ভিড় | প্রত্যেকটা মেঘ যেন রূপকথার পশরা নিয়ে অপেক্ষমান | ওরই মধ্যে একটাকে ছোট্টবেলার সেই মেঘবালিকা মনে হলো | 'এক পৃথিবী' লিখতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে সেদিন মুখোমুখি তার সঙ্গে |

- আচ্ছা, আমি কেন সেই আগের মতো আর তোমাকে খুঁজি না ? এখন আর দৌড়ে গিয়ে মাঠের মাঝে দু হাত প্রসারিত করে বৃষ্টিকে আলিঙ্গন করি না | তবে কি রূপকথা হারিয়ে যাচ্ছে ?

- মানুষ পরিণত হলে বাস্তব আর রূপকথার দূরত্ব বাড়ে, রূপকথার আর কি দোষ ? | তুমি লিখতে পেরেছিলে, এক পৃথিবীর একশো রকম স্বপ্ন দেখবার সেই রূপকথা ?

- সেই পাণ্ডুলিপি আর নেই আমার কাছে | অনেকদিন আগে কাগজের নৌকাতে নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম | খরস্রোতে ভেসে গেছে দূরে বহু দূরে | এখন আর মনে নেই |

-পাণ্ডুলিপি না ছাই | তুমি রূপকথা কে অনুভব করেছিলে মাত্র | সেই অনুভূতি লিপিবদ্ধ করার ক্ষমতা তোমার ছিল না | জীবন নদীতে যত সময় গড়িয়েছে তুমি রূপকথাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছো | ভেবেছিলে, কিছুদিন মনের মনিকোঠায় চাবি দিয়ে তাকে আটকে রেখে, জীবনে বড় হবার স্বপ্ন দেখবে | আসলে তুমি খেয়াল করোনি, বড় হবার স্বপ্ন পূরণ করতে গিয়ে অনেক যান্ত্রিক হয়ে গেছো | আর যান্ত্রিকতায়, রূপকথার কোনো অস্তিত্ব নেই | তাই এখন সেই চাবিও হারিয়ে গেছে |

অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম | মেঘবালিকা বলেই চলেছে | তার চোখে মুখে একটা চাপা ক্ষোভ | পড়ন্ত বিকেলের আকাশ তখন গুরুগম্ভীর | বিষন্ন মনে তখন কাগজের নৌকার হাতছানি | খোঁজার চেষ্টা করলাম ছোট্টবেলার সেই রূপকথার |

- রূপকথার সেই টান এখন আর অনুভব করো ? সেই সময় আছে তোমার ?

- প্রথম প্রেম কেউ কখনো ভোলে না | শুধু সময়ের সঙ্গে অনুভূতি কমে যায় মাত্র | আমাকে তোমার ঝুলি থেকে একটা রূপকথা ধার দেবে ? একবার ছুঁয়ে দেখবো, ছোট্ট বেলার সেই হরিণীর সঙ্গে দৌড়াবো |
- এখন সেই পক্ষিরাজের ঘোড়া কিংবা হরিণীর গল্প কি ভালো লাগবে ? বরং, একটা প্রেমের রূপকথা শোনাতে পারি | মন দিয়ে শুনতে হবে কিন্তু | শর্ত একটাই, চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে হবে | চোখ খুললে, আমি কিন্তু হারিয়ে যেতে পারি |

- তবে তাই হোক | আমি শর্তে রাজি |

- শোনো তবে, পর্বত আর বাতাসের অভিমানী রূপকথা |

বাতাসের যত মন খারাপ, সব মেঘ হয়ে জমা হয় | অভিমানী বাতাস বেশ চঞ্চল, স্বাধীনচেতা আর একরোখা | এই চঞ্চল বাতাস ,একদিন পর্বতের বুকে ধাক্কা খায় | নিজের সব দুঃখ উজাড় করে দেয় পর্বতকে | কান পেতে শোনোনি, বাতাসের সেই তীব্র সো সো শব্দ | পর্বত কিন্তু চুপ, একেবারে অনুভূতিহীন | তার জমে থাকা সব দুঃখ বরফ হয়ে জমা থাকে মাথায় কিংবা বুকের উপরে | বাতাসের সে খেয়াল নেই | সে ভাবে দুঃখ শুধুই তার একার | পুঞ্জীভূত দুঃখের মেঘ গুলোকে পর্বতের গায়ে বিছিয়ে দিয়ে কিছুটা হালকা হয় সে | বাতাস, অনুভব করে পর্বত তার মন ভালো করার আপন জন |

গল্পটার আরও একটু গভীরে যাই | সৃষ্টির আদিকাল থেকে বাতাসের ললাটলিখন সাগর আর পর্বতের ভূমি | দুটো আলাদা দাম্পত্য জীবন | সংসারের যাঁতাকলে সবারই দুঃখ আসে | পর্বতের যেমন বরফ, বাতাসের তেমন মেঘ | পর্বতের শান্ত ধীরস্থির স্বভাব বাতাসকে আরও বেশি আকৃষ্ট করে | প্রেম বাড়তে থাকে | বাতাসের কাছে সংসারের বাঁধন তখন তুচ্ছ | পর্বত, লাবণ্যময়ী বাতাসের প্রেমে পড়লেও ধীরস্থির ও লক্ষ্যে অবিচল | ভূমির সঙ্গে বাঁধন মনে পড়ে যায় তার | তাই পর্বত একদিন বললে

- কি চাও আমার কাছে ?

- এক চিলতে ভালোবাসা আর প্রশান্তির পরশ |

- আমাকে আলিঙ্গন করে তোমার সব দুঃখ প্রকাশ করতে পারো | তোমার দুঃখ আমি মন দিয়ে শুনবো | তবে আমরা ভালো বন্ধু হতে পারি মাত্র , কিন্তু তার বেশি কিছু নয় | আমাদের জীবনের পথ যে ভিন্ন |

রাগে, অভিমানে বাতাস তখন এদিক থেকে সেদিক | তার সেই এলোমেলো গতি আর মেঘেদের ধাক্কায় আকাশে তখন বিশাল গর্জন | বাতাসের সেই হাহাকার তুমি শুনেছ নিশ্চয়, যাকে বলে বজ্রনিনাদ | বলেই মেঘবালিকা এবার একটু থেমে যায় | কিছুক্ষন বাদে আবার বলতে শুরু করে | পর্বত কিন্তু তখনও শান্ত | সে বাতাসকে বললে

- সব প্রেম কি পরিণতি পায় ? দূরে থেকেও ভালোবাসা কখনো অনুভব করতে হয় |

বাতাস বললে,
- তুমি তো প্রেম ভালোবাসা সবই পেয়েছো জীবনে | সুখী সংসার তোমার | সংসার জীবনে প্রেম হারিয়ে গেছে আমার | তুমি কি ভাবে বুঝবে হারিয়ে যাওয়া প্রেম নতুন করে খুঁজে পেয়েও আবার না পাবার দুঃখ ?

মৃদু হেসে পর্বত বললে

- আসলে সবাই তোমার মতো দুঃখ প্রকাশ করতে পারে না | আমরা সবাই বাইরে থেকে অপরকে সুখী ভাবি | আমার দুঃখকষ্টের হিমবাহ যদি কোনোদিন গলে যায়, তা হলে মাটির পৃথিবীর অস্তিত্ব আর থাকবে না | তাই আমাকে আরো সংযত ও দৃঢ় হতে হবে | আমার থেকে দূরে চলে যাও | যদি আমাকে সত্যি ভালোবাসো, তাহলে যাবার আগে মাটির পৃথিবীর কিছু উপকার করে যাও | আর হ্যাঁ, আবার কোনোদিন তোমার মনখারাপের গল্প শোনাতে এসো | বন্ধু হিসেবে সেই দুঃখের ভাগীদার হব |

অভিমানী বাতাস অনেক দূরে চলে গেল ঠিকই, কিন্তু পর্বতের বুকে আরও একটা হিমবাহ যোগ করে গেল | যাবার পথে বাতাস তার সমস্ত দুঃখ ঢেলে গেলো পর্বতের পাদদেশ থেকে দূরের উপত্যকায়, অরণ্যে, এমনকি মরুভূমির ধু ধু প্রান্তরে |

মেঘবালিকা এবার চুপ | চারিদিকে তখন অদ্ভুত নীরবতা | আমি আপন মনে বলে উঠলাম |

- এমন রূপকথা তো আগে কখনো শুনিনি | কেউ বলেনি কোনোদিন |

- বিশ্বাস হচ্ছে না ? রূপকথায় অত কিছু তো ভাবতে নেই | তবু বলি, যে মৌসুমী বায়ু পশ্চিম ঘাট পর্বতের বুকে ধাক্কা খেয়ে কেরালায় বৃষ্টি ঘটায়, কিংবা যে মৌসুমী বায়ু হিমালয়ে ধাক্কা খেয়ে বঙ্গে বর্ষা আনে তাদের কে একবার জিজ্ঞেস করো, উত্তর পেয়ে যাবে তুমি |

- কোনো শিক্ষক মিষ্টি করে এমন গল্প শোনায় নি তো | ভূগোল বইয়ের পাতায় যে কারণ পড়ে পরীক্ষার খাতা ভরিয়েছিলাম তার সঙ্গে এর কোনো মিল পাচ্ছি না |

মেঘবালিকা তখন একেবারে চুপ | ঠিক ঝড়ের আগে যেমন হয় আর কি | মনে হলো সে বেজায় রেগে | তার দিকে তাকিয়ে চোখ খুলতেই দেখি সে আর নেই, হারিয়ে গেছে দূরে কোথাও | যাবার আগে সে অভিমান আর তাচ্ছিল্যভরে বলে গেল

- তুমি এখন অনেক বেশি যান্ত্রিক ! তাই রূপকথার মধ্যে বাস্তব কিংবা বিজ্ঞান খোঁজো | আর সেই আগের মতো অবাক হয়ে রূপকথা উপভোগ করোনা | তাই তোমার কাছে আমার অস্তিত্ব এখন মূল্যহীন | আসলে আমরা বাতাসের সেই সব জমে থাকা দুঃখ | বাতাস, পর্বতকে এখনও ভালোবাসে | পর্বতকে দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি মতো, আমাদের এবার ঘনীভূত হবার সময় এসেছে মাটির পৃথিবীর বুকে | আর শোনো, এখন থেকে আমাকে মেঘ না বলে ভূগোলের খাতা ভরানো সেই সব শব্দ 'স্ট্রাটাস', 'কিউমুলাস' কিংবা 'স্ট্রাটোকিউমুলাস'; এই নামেই ডেকো |

উপত্যকায় ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে | রূপকথার সেই কাগুজে নৌকা তখন ডুবুডুবু | আমার চোখের জল আর বৃষ্টি মিশে একাকার | দূরের উপত্যকায় সেই হরিণী, তখনও দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে | আমি শুধু তাকে ছুঁতে পারছি না | হিংসে হচ্ছে আমার ছোট্টবেলার সেই ছেলেটাকে দেখে, যে দু হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছে আর মনের আনন্দে আপন করে নিচ্ছে এক পৃথিবীর একশো রকম রূপকথাকে | কানে ভেসে আসছে মেঘবালিকার সেই উপহাস চিৎকার " তুমি এখন অনেক বেশি যান্ত্রিক !! "


No comments:

Post a Comment

Bottom Ad [Post Page]

To Place your advertisement here call - +917980316633/+918145704098