একটু আগে মায়ের দিয়ে যাওয়া খাবারের থালাটা একদিকে পরে আছে।স্নেহা বালিশটাকে
বুকে জড়িয়ে পাশ ফিরে শুয়ে থাকে চুপচাপ।
খাবার দিতে এসে মা জিজ্ঞেস করেছিল বটে 'মনখারাপ?'
-'না'..স্নেহার ছোট্ট উত্তরের পর মা আর কোনো কিছু
জিজ্ঞেস করার আগ্রহ দেখায়নি।রূঢ় গলায় বলেছিল 'খাবারটা পয়সা
খরচ করে বানাতে হয়।ফেলে রেখে নষ্ট করো না।তোমার দাদা অনেক কষ্ট করে টাকা আয় করে।'
কী সুন্দর মুখটা!কী মিষ্টি হাসি।বাচ্চা মেয়েটাকে আধো আধো সুরে বারবার 'মাম্মাম বকবে মেয়ে দুত্তু করে
না!' বলতে শুনে কেমন মন কেমন করছিল স্নেহার।পায়ে পায়ে এগিয়ে
গিয়েছিল বাচ্চাটার দিকে।স্নেহাকে দেখে মায়ের কোল থেকেই ছোট্ট ছোট্ট হাত নাড়িয়ে 'আয় আয়' করে কেমন আদুরে গলায় ডাকছিল সে।স্নেহা হেসে
জিজ্ঞেস করেছিল 'কী নাম তোমার?'
'ঋদ্ধিতা।এখনো অতটা ভালো করে কথা বলতে পারে না।সবে একবছর ছ' মাস চলছে।' হেসে উত্তর দিয়েছিল ওর মা।
'ভীষণ ভীষণ মিষ্টি!কোলে নিয়ে চটকে দিতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু না থাক!কাঁদবে!'
'আরে না না!ও সহজে কাঁদে না!আপনি নিন না কোলে!'
অতএব ঋদ্ধিতাকে পরম মমতায় ওর মায়ের কোল থেকে নিজের কোলে নিয়েছিল
স্নেহা।বাচ্চাটার গায়ের স্নিগ্ধ কোমল গন্ধ, বড় বড় নিষ্পাপ চোখে স্নেহার দিকে একপলকে
চেয়ে থাকা আর দুহাত দিয়ে স্নেহার গলা জড়িয়ে ধরাটা কেমন অবশ করে দিয়েছিল
স্নেহাকে।ইচ্ছে হচ্ছিল তার হৃদয়ের সমস্ত মমতা দিয়ে ঋদ্ধিতাকে আগলে রাখার।
'ঋদ্ধিতা!এই দেখো বাবা ফোন করছে।বাবা গাড়ি নিয়ে এসে গেছে নীচে।এসো আমরা
এবার যাই!'
অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঋদ্ধিতাকে ওর মায়ের কোলে দিয়ে দিয়েছিল স্নেহা।চলে আসার আগে ওর
নরম গালে চুমু দিয়ে বলেছিল 'টাটা!'
মল থেকে বেড়োনোর সময় দূর থেকে স্নেহা দেখল গাড়ির দরজা খুলে ঋদ্ধিতাকে কোলে
নিয়ে ওর মা উঠে যাচ্ছে গাড়িতে।গাড়ির সামনে ড্রাইভারের পাশে বসে আছে ওর
বাবা।ঋদ্ধিতা ততক্ষণে ওর বাবার কোলে চলে গেছে।গাড়িটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল বড়
রাস্তার বাঁকে।
'কতবার বলেছিলাম বিয়ের আগে ডাক্তারকে দিয়ে সবকিছু ভালো করে টেস্ট করিয়ে
নিতে!তখন তো শুনলে না আমার কথা!এখন ভোগো!এই খুঁতওয়ালা মেয়েকে নিয়ে করো
সংসার!ডিফেক্টিভ পিস একটা!ছিঃ!'
স্নেহা কোনোদিন মা হতে পারবে না জেনে শাশুড়ির বলা প্রথম কথাগুলো আজো বুকে
তীরের মতো বেঁধে স্নেহার।এরপর একটার পর একটা টেস্ট, অপারেশন,কড়া কড়া ওষুধ..কিছুতেই স্নেহা না বলেনি।চুপচাপ সহ্য করে গেছে সবকিছু,
সব যন্ত্রণা, শুধু একবার মা হবার আশায়।
রূপম প্রথম প্রথম স্নেহাকে সান্ত্বনা দিলেও সব চেষ্টা,সব টেস্ট এক এক করে বিফলে
যেতে শুরু করলে ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু করল সে-ও! চোখের সামনে কাছের মানুষগুলো
রূপ বদলাতে শুরু করেছিল।স্নেহা টেস্টটিউব বেবি আর বেবি অ্যাডপ্ট করার কথা বললে
রূপম আর তার মায়ের কাছ থেকে জুটেছিল চরম অপমান, অশ্রাব্য
গালাগালি।সঙ্গে মার।এভাবে আড়াই বছর চলার পর একদিন রূপম ডিভোর্স ফাইল করে।পায়ের তলা
থেকে মাটি সরে গেছিল স্নেহার।তবে এত অপমান সহ্য করার চেয়ে ডিভোর্সটাই শ্রেয় মনে
করেছিল সে।
'আমাদের মেয়ে হলে ওর নাম রাখব রূপকথা!' বিয়ের পর পর
একদিন স্নেহার কাঁধে মাথা রেখে বলেছিল রূপম।
মনে নেই হয়তো রূপমের।তাই মেয়ের নাম রেখেছে ঋদ্ধিতা।অবশ্য যে স্বপ্ন তখনকার
রূপম সাজিয়েছিল,
সেই স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার দায় তো এখনকার রূপমের নেই।স্বপ্নগুলো তো
স্নেহাও বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি।
স্নেহা আজ ছয় বছর পর দেখল রূপমকে।গাড়ির মধ্যে মেয়েকে কোলে নিয়ে কী সুন্দর
হাসছিল সে।
আজ রাতটুকু জেগেই কাটাবে স্নেহা।এই যে মা না হয়েও মা হওয়ার অনুভূতিটা স্নেহা
একটু আগে পেয়েছে,
এই অনুভূতিকে সে ধরে রাখতে চায়।
তার কানে এখনো ভাসছে আধো আধো সুরে ঋদ্ধিতার ডাকটা 'মাম্মাম!' হয়তো সেই ডাকের অধিকার রূপমের দ্বিতীয় স্ত্রীর।কিন্তু ঋদ্ধিতাকে বুকে
জড়িয়ে অজান্তেই যে মাতৃত্ববোধ আজ অনুভব করেছে স্নেহা,তা ভীষণ
রকম সত্যি।।
No comments:
Post a Comment