"কাঁচের চুড়ি
ভাঙার মতন মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে দুটো চারটে নিয়ম কানুন ভেঙে ফেলি পায়ের তলায়
আছড়ে। "
এমন ইচ্ছে যার তাঁরই জন্মদিন আজ। তিনি নীললোহিত।
"শুধু কবিতার জন্য
এই জন্ম, শুধু কবিতার
জন্য কিছু খেলা, শুধু
কবিতার জন্য একা হিম সন্ধেবেলা
ভূবন পেরিয়ে আসা, শুধু
কবিতার জন্য
অপলক মুখশ্রীর শান্তি
একঝলক;
শুধু কবিতার জন্য তুমি
নারী, শুধু
কবিতার জন্য এত
রক্তপাত, মেঘে গাঙ্গেয় প্রপাত
শুধু কবিতার জন্য, আরো
দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে লোভ হয়।
মানুষের মতো ক্ষোভময়
বেঁচে থাকা, মুধু কবিতার
জন্য আমি অমরত্ব
তাচ্ছিল্য করেছি।"
তিনি এমনটাই,অনেককিছুর
জন্য যেমন অনেককিছু তাচ্ছিল্য ভরে উপেক্ষা করেছেন, তেমন অনেক কিছুকে আঁকড়েও ধরেছেন
কবিতার মতন,প্রেমিকার মতন আবার নিয়তির মতন। তিনি কখনো সনাতন পাঠক,কখনও নীল
উপাধ্যার আবার কখনো বা নীললোহিত। সব মিলিয়ে সুনীল আকাশে, তিনি পুরোধা। সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরের মাইজপারা গ্রামে ১৯৩৪ সালের ৭ই
সেপ্টেম্বর, কিন্তু চার বছর বয়সেই চলে আসেন কোলকাতাতে। পড়াশুনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাবা ছিলেন স্কুল
শিক্ষক।পড়াশুনা শেষ করে কিছু দিন তিনি আপিসে চাকরি করেছেন। তারপর থেকে সাংবাদিকতায়।
আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান মি. পলেন কলকাতায় এলে সুনীলের
সঙ্গে ঘনিষ্ট পরিচয় হয়। সেই সূত্রে আমেরিকায় যান ছাত্র হিসাবে। ডিগ্রি অর্জনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপগ্রন্থাগারিক
হিসাবে কিছুদিন কাজ করেন সুনীল। ১৯৫৩ সাল থেকে তিনি কৃত্তিবাস নামে একটি কবিতা
পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ একা এবং
কয়েকজন এবং ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম উপন্যাস আত্মপ্রকাশ প্রকাশিত হয়।
কবিতার জন্য ভালোবাসাটা
সুনীলের সেই কিশোরবেলা থেকেই। বাবার ইচ্ছেই রোজ দুপুরে টেনিনসনের কবিতা পড়তেন আর চেষ্টা করতেন অনুবাদের,সেই থেকেই
আগাপাশতলা জড়িয়ে গেছিলেন কবিতার সঙ্গে। তবে মূলত কবি হিসাবে লেখা শুরু হলেও
উপন্যাস,গল্প সবেতেই সমান সফল ও জনপ্রিয় তিনি। ভীষন রোমান্টিক এক প্রেমিকের মতন
তৈরী করেছেন নীরাকে,আবার প্রতিবাদের যন্ত্রনায় লিখেছেন এদেশে শিশুরা স্তন পান করে
না,নিস্তনীদের বুক কামড়ে খায়। আবার তারই কলমে প্রথম আলো বা পূর্ব পশ্চিমে ফুটে
উঠেছে এই বাঙলার রেট্রোস্পেক্ট ইতিকথা। ছোটদের জন্যও লিখেছেন কাকাবাবু আর সন্তু।
এছাড়াও আমি কী রকম ভাবে বেঁচে
আছি, যুগলবন্দী , হঠাৎ নীরার জন্য, রাত্রির রঁদেভূ, শ্যামবাজারের
মোড়ের আড্ডা, অর্ধেক জীবন, অরণ্যের দিনরাত্রি, অর্জুন, সেই সময়, ভানু ও রাণু,
মনের মানুষ এমন অজস্র সাহসী কলমের উপহার রেখেছেন পাঠকের জন্য।
নীললোহিত ছদ্মনামে
সুনীল একটি পৃথক সত্ত্বা তৈরি করেছেন যেখানে নীললোহিতই কেন্দ্রীয় চরিত্র
। আত্মকথনের ঢঙে লেখা সেই সব কাহিনীতেই নীললোহিতের বয়স সাতাশ, চিরবেকার ।
চাকরিতে ঢুকলেও তা বেশিদিন টেঁকে না । বাড়িতে মা, দাদা, বৌদি রয়েছেন ।
দিকশূন্যপুর বলে একটি জায়গার কথা বহু লেখায় তিনি উল্লেখ করেছেন যেখানে বহু
শিক্ষিত সফল কিন্তু জীবন সম্পর্কে নিস্পৃহ মানুষ একাকী জীবন যাপন করেন । কোথায় যেন
ব্যক্তি সুনীলের বোহেমিয়ান জীবন দর্শন প্রতিফলিত হয় এই সব লেখায়।
তাঁর অনেক লেখাই
চিত্রায়িত হয়েছে। এর মধ্যে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত অরণ্যের দিনরাত্রি এবং
প্রতিদ্বন্দ্বী উল্লেখযোগ্য। এছাড়া কাকাবাবু চরিত্রের চারটি কাহিনী সবুজ দ্বীপের রাজা,
কাকাবাবু হেরে গেলেন?, মিশর রহস্য এবং ইয়েতি অভিযান চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। হঠাৎ
নীরার জন্য উনার লিখিত আরেকটি ছবি। গৌতম ঘোষ বানিয়েছেন মনের মানুষ। তিন নারী হাতে
তরোয়ারী নিয়েও হয়েছে সিনেমা।
২০০২ সালে সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতা শহরের শেরিফ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭২ ও ১৯৮৯
খ্রিষ্টাব্দে আনন্দ পুরস্কার এবং ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে
ভূষিত হন তিনি।
ব্যতিক্রমী ছিলেন
বরাবর,মৃত্যুর পরেও তা প্রমান দিয়ে গিয়েছিলেন। ২০১২র ২৩ শে অক্টোবর
হৃদযন্ত্রের অসুস্থতার কারণে মৃত্যুবরণ করেন। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে ৪ এপ্রিল সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায় কলকাতার ‘গণদর্পণ’কে সস্ত্রীক মরণোত্তর দেহ দান করে যান। কিন্তু
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একমাত্র পুত্রসন্তান সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ইচ্ছেতে তাঁর
দেহ দাহ করা হয়।
তাঁর সৃষ্টির ঝুলি
খুলতেই বেরিয়ে আসে অগনিত সব নাম আর মনি মুক্তো।
সৃষ্টির ফসলে সোনারতরী
ভরিয়ে তিনি চলে গেছেন। রয়ে গেছে নীরা, রনজয়, সন্তু, অসীম, হরি বা দুলির মতন
চরিত্রগুলো।
“পাহাড়-চুড়ায় দাঁড়িয়ে
মনে হয়েছিল
আমি এই পৃথিবীকে পদতলে
রেখেছি
এই আক্ষরিক সত্যের কছে
যুক্তি মূর্ছা যায়।
শিহরিত নির্জনতার মধ্যে
বুক টন্টন করে ওঠে
হাল্কা মেঘের
উপচ্ছায়ায় একটি ম্লান দিন
সবুজকে ধূসর হতে ডাকে
আ-দিগন্ত প্রান্তের ও
টুকরো ছড়ানো টিলার উপর দিয়ে
ভেসে যায় অনৈতিহাসিক
হাওয়া
অরণ্য আনে না কোনো
কস্তুরীর ঘ্রাণ
কিছু নিচে ছুটন্ত
মহিলার গোলাপি রুমাল উড়ে গিয়ে পড়ে
ফণমনসার ঝোপে
নিঃশব্দ পায়ে চলে যায়
খরগোশ আর রোদ্দুর।”
No comments:
Post a Comment