অ্যান্ড্রু রবিনসন বলেছিলেন—,“chakravarti recalls Chaplin to his
best. Instead of moustache, he has a pair of eyes as bulbous as a frog’s which
he opens wide with every emotion known to man”। সত্যজিতের মতে তিনি যদি হলিউডে
অভিনয় করতেন,নির্দ্বিধায় অস্কার পেতেন। তাইতো মানিক বাবু তাঁকে ভারতের মরিস
শিভালিয়র মানতেন। তিনি তুলসী চক্রবর্তী। অনবদ্য একজন অভিনেতা,সাংঘাতিক ভাবে বাঙলার
কীর্তণ,যাত্রা,থিয়েটার বা অর্কেস্ট্রার দেশোয়ালি গন্ধ লেগেছিল তাঁর অভিনয়ে। তিনিই বোধহয়
টলিউডের চার্লি চ্যাপলিন।
কৃষ্ণনগরে জন্ম, বাবা ছিলেন
রেলের কর্মচারী তাই ছোটবেলায় ছুটে বেড়িয়েছেন বাঙলার এ গ্রাম-সেগ্রাম। হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়ার পর চাকরীর খোঁজে চলে আসেন
কোলকাতায়, জোড়াসাঁকোয় জেঠুর বাড়িতে চলে আসেন। গান জানতেন, গিরিশ পার্কের
কাছে এক ব্যায়ামাগারে শরীরচর্চাও শুরু করেন। জেঠুর ছিল অর্কেস্ট্রার দল,সেখানে
শ্যামা সঙ্গীত গাইতেন কিন্তু জেঠু নিজের দল ছেড়ে স্টার থিয়েটারে যোগ দেওয়ার পর
তুলসী চক্রবর্তী কাজ নিলেন মদের দোকানে। সেও বেশীদিন টিকলো না। পড়াশুনা বিশেষ
জানতেন না তাই চাকরী মিলল না। ভাগ্যন্বেষণে পাড়ি দিয়েছিলেন বার্মাতেও। যে জাহাজে
করে তিনি যাচ্ছিলেন বার্মা,তাতে ছিল এক সার্কাসের দল। ভিড়ে গেলেন তাদের সাথে।
ক্লাউন সাজতেন সার্কাসে। সেইটিই বোধহয় কমেডিয়ান হয়ে ওঠার এপিলগ।
এই সার্কাসের জোকার থেকে
টলিউডের আইকনিক কমেডিয়ান হয়ে ওঠার গল্পে অনেকগুলো স্তর আছে। কখনো স্ট্র্যাগল, কখনো
কম্প্লিমেন্ট,কখনো মধ্যবিত্তভ্যালুজের দীপ্তি —সব মিলিয়ে এই কাহিনী
মেলোড্রামাটিক, ট্রাজেডিক আর কোথাও বিস্মৃতির।
সার্কাস ছেড়ে চলে আসার কারণ জিজ্ঞাস করলে বলতেন,‘শরীর থেকে
জন্তু জানোয়ারের গন্ধ বেরচ্ছে দেখে চলে এলুম।’ ফিরে এলেন। চিৎপুরের ছাপাখানায় কাজ
নিলেন। সেই ছাপাখানায় থিয়েটারের হ্যান্ডবিল ছাপার সময় আলাপ হল তৎকালিন স্টার
থিয়েটারের মালিক অপরেশ বাবুর সাথে। উনার উৎসাহেই শিখলেন তবলা,পাখোয়াজ, ঢোল এমনকি
নাচও। অপরেশ মুখার্জিই তালিম দিলেন টপ্পা গানের। চারভাগের একভাগ মাস মাইনেতেই
ছাপাখানার কাজ ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে তিনি যোগ দিলেন স্টার থিয়েটারে। প্রথম স্টেজে
অভিনয় দুর্গেশনন্দিনীতে,১৯২০তে। সেই থেকে শুরু। ১৯৬০এ শেষ
মঞ্চে অভিনয় করেন শ্রেয়শী নাটকে। প্রথমে স্টার,পরে মদনমোহন থিয়েটার, প্রায় চল্লিশ
বছরের থিয়েটার জীবনে ৪২টি নাটকে অভিনয় করেছেন তুলসী চক্রবর্তী।
অসম্ভব ভার্সাটাইল ছিলেন।
খোল বাজিয়ে কীর্তন গাইতেন,দরকারে তবলা বাজিয়েছেন নির্ধারিত তবলচির
অনুপস্থিতিতে,নিজের গলায় ছবিতে গান গেয়েছেন আবার কবিতে তাঁকে নাচেতেও সাবলীল দেখিয়েছে। ১৯৩২ প্রথম সিনেমায়
এলেন পূনর্জন্মে। পরবর্তীতে অভিনয় করেছেন দাপটের সাথে । সে উত্তম কুমারই হোক বা
ছবি বিশ্বাস,সৌমিত্র বা জহর গাঙ্গুলী,সুচিত্রা বা মলিনা দেবী সবার সঙ্গেই তিনি
ছিলেন সপ্রতিভ। সাড়ে চুয়াত্তরের মেস মালিক তাকে ছাড়া ভাবাই যায় না। বরাবরই পার্শ্ব
চরিত্রে অভিনয় করলেও নিজেকে আলাদা করে চিনিয়ে দিতেন অভিনয়ের গুনে। কেউ প্রশংসা
করলে বলতেন আমি “একটু চোখ–কান খোলা রাখি, আর সব ধরনের মানুষ দেখে বেরাই। এবার চরিত্র
মত তাদের তুলে ধরি। যেখানে যে লাগে আর কি!এই চরিত্র করার জন্য ভাল অভিনয় করার
দরকার হয় না কি? তোমার চারপাশে এরা ঘুরে বেরাচ্ছে, একটাকে তুলে এনে নিজের কাঁধে
ভর করাও।’' পরিবেশ থেকে শিখে নেওয়া যে নিছক পাভলভের প্রতিবর্ত ক্রিয়া নয়,এক
নিখুঁত,মন ছুঁয়ে যাওয়া অভিব্যক্তি তা প্রমাণ করে গেছেন তাঁর অভিনিত চরিত্র
গুলোতে,মেস মালিক বা বৈষ্ণব,টোলের পন্ডিত বা মুদি,কেরাণী বা হোটেলের ম্যানেজার —যে
চরিত্রেই অভিনয় করেছেন,কেবল মুগ্ধতা দিয়েছেন। হাসতে বাধ্য করেছেন তবুও একবারের
জন্যও ভাঁড় মনে হয়নি।
পরশপাথর’-এ তিনিই
প্রোটাগনিস্ট!পরশুরামের পরেশ দত্তকে জীবন্ত করে
তুলেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। পরশপাথর ছবি রিলিজের সময় কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে
গিয়েছিলেন। বলতেন “এইবারে আমি নির্ঘাৎ পাগল হয়ে যাব। বড় বড় হোর্ডিংয়ে ইয়া
বড় বড় মুখ আমার। জীবনে তো কখনও এত বড় বড় মুখ হোর্ডিংয়ে দেখিনি। এর আগে যাও বা
দু-চারবার হয়েছে, তা সে সব মুখ তো দুরবিন দিয়ে খুঁজে বার করতে হত। এ আমি কী হনু
রে!’' সত্যিই তিনি হনু তাঁর মুখেই মানায় হলদে সবুজ ওরাং ওটাং মন্তর।
সাহিত্যিক শংকর তাঁর ‘মানব
সাগর তীরে’বইতে লিখেছেন,‘যদি তুলসী চক্রবর্তী, রবি ঘোষ, নৃপতি চ্যাটার্জির মতো
অভিনেতা বিদেশে জন্মাতেন, তা হলে তাঁদের স্মরণে এক-একটি সরণি থাকত।’ অথচ এই
বঙ্গদেশে তিনি উপেক্ষিত রয়ে গেলেন। হাওড়ার কৈলাস বসু লেনের ঘুপচি বাড়িতে দারিদ্র্যকে প্রতিবেশী করে বেঁচে
ছিলেন,পরোপকারী এই মানুষটি। ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসে চলাফেরা করতেন। নিজের বাড়িটাও
দান করে দিয়েছিলেন এলাকার পুরোহিতদের জন্য। যেদিন চলে গেলেন হৈচৈ হয়নি,ভীড় উপচানো
শোভাযাত্রাও হয়নি। কিন্তু ভালোবাসা উপচে
পড়েছে।
পরশপাথর ছিলেই নিজেই। যা
ছুঁয়েছেন সোনা হয়েছে। উনাকে ছাড়া হয়ত হতোই না পরশপাথর। যিনি ৩১৬টি বাংলা ও ২৩টি মত
হিন্দী সিনেমা করেছেন আর দর্জি তাঁর পাঞ্জাবির মাপ নিতে আসছে নায়কের ভূমিকায়
অভিনয়ের জন্য ভেবে তিনি আপ্লুত হয়ে বলছেন, ‘'উফ! এ আমি কখনও ভাবতেও পারিনি!’'
আমরাও ভাবতে
পারিনি,চ্যাপলিনের জীবনের সাথে কিভাবে গোল্লা গোল্লা চোখ,ফতুয়া পড়া মানুষটির
দর্শণ। দুঃখকে কেমন নিজস্ব মননের অনুঘটকে জারিত করে,এমন অসামন্য সব কাজ,সহজ কমেডির
ভাষায় যিনি লিখতে পারেন তিনি অবশ্যই তুলসী চক্রবর্তী, টলিউডের পরশপাথর।
No comments:
Post a Comment