- দেবরাজ ঘোষাল
"We Want to be the East Bengal of north india. That's what we are aiming for".
অবাক হবেন কাদের মুখ থেকে এই কথা বেরিয়েছে
জানলে।বিচ্ছিনতাবাদী আন্দোলনে প্রতিদিন যেখানকার মাটি অশান্ত,বেকারত্বের জ্বালায়
যেখানকার ছেলেমেয়েদের জেহাদের নামে টাকার বিনিময়ে পাথর ছোঁড়ানো হয়, যেখানে
জঙ্গিনেতাদের আনাগোনা অহরহ লেগেই থাকে শান্ত উপত্যকাকে মারনভূমি বানানোর খেলায়,
সেই জন্মু ও কাশ্মীর এখন নতুন স্বপ্ন দেখছে ফুটবলকে ঘিরে নতুন পরিচয়ে বাঁচার।
স্বপ্নটা দেখা শুরু অবশ্য করেছিলেন জন্মু কাশ্মীর
ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন সভাপতি জামির এ ঠাকুর।কোনো দল না থাকা সত্বেও স্থানীয় ছোট
মাঠগুলিতে সববয়সী ছেলেদের ফুটবল নিয়ে দাপাদাপি দেখে নজর এড়ায়নি তার।স্থানীয়
কাশ্মীর এফসিই তখন একমাত্র ক্লাব ছিলো জন্মু কাশ্মীরে।অশান্ত পরিস্থিতি ও
জনপ্রিয়তার অভাবে সেই ক্লাব ধুঁকতে বসেছিলো।ফুটবলপ্রেমী ঠাকুর লোনস্টার গ্রুপের
চেয়ারম্যান ইফতিকার এ লোনকে অনুরোধ করেন ফুটবলের একমাত্র আশাটিকে বাঁচিয়ে রাখার।তিনি
বুঝতে পেরেছিলেন বিচ্ছিনতাবাদীদের কুমন্ত্রণায় বিপথগামী কাশ্মীরি নবপ্রজন্মকে অন্য
রাস্তা না দেখাতে পারলে ফুটবল যেমন বাঁচবেনা তেমনি নিজের রাজ্যটাও দিনদিন আরও
ভয়ানক হবে।ঠাকুর সাহেবের এই প্রচেষ্টাকে সম্মান জানিয়ে লোনস্টার গ্রুপ কাশ্মীর
এফসির দায়িত্ব নিয়ে ২০১৩সালের ৩১শে ডিসেম্বর আত্মপ্রকাশ করে নতুন করে লোনস্টার
কাশ্মীর নামে।গত পাঁচ বছরে ফুটবলকে ছড়িয়ে দিতে শ্রীনগরে তিনটি ও জন্মুতে একটি
ফুটবল ক্যাম্প তৈরি করেছে লোনস্টার কাশ্মীর।কোচের দায়িত্বে প্রথম থেকেই রয়েছেন
এএফসি "এ' লাইসেন্স কোচ হিলাল রসুল।পরে ফুটবল ক্যাম্পগুলি পরিচালনার জন্য
টিএফএ থেকে তারা তুলে নিয়ে আসে সাজিদ ইউসুফ দারকে যিনি নিজেও একজন এএফসি "এ' লাইসেন্সের অধিকারী ও জাতীয় মহিলা দলের কোচ
নির্বাচিত হয়েছেন সম্প্রতি।প্রধানত অনুর্ধ্ব ১০ ও ১২ দলগুলিকে নিয়েই এই ক্যাম্প
চলতো প্রথমে, পরে অনুর্ধ্ব ১৭দলও গড়া হয়।টিমের বাজেট ১ কোটির সামান্য বেশি।কয়েক
বছর বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্ট খেলে বেড়ানোর পর জাতীয় স্তরে
আত্মপ্রকাশের নেশায় ২০১৪ এর ডিসেম্বরে জন্মু কাশ্মীর ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে
ফেডারেশনের নিজেদের নাম নথিভুক্ত করে তারা।আর্বিভাবের বছরেই সাফল্যের জয়গানটা সেবারই
লেখা হয়ে যেতো যদিনা ফুটবল ঈশ্বর আইজলের ভাগ্যে আইলিগটা না লিখতেন।২০১৫তে আইলিগ
দ্বিতীয় ডিভিশনে কোনো বিদেশী ছাড়াই লোনস্টার কাশ্মীর নিজেদের ১০টা ম্যাচের ৫টি
জেতে,৪টি ড্র করে ও একটিতে পরাজিত হয়।দলে সিনিয়র বলতে ছিলেন চার্চিল,মোহনবাগানে
খেলা আদিল খান ও প্রাক্তন সালগাওকর গোলকিপার করনজিত সিং।আনকোরা কাশ্মীরিরা সেবারই
অঘটন ঘটিয়ে ফেলতো যদি শেষ মূর্হুতে আইজল বড় ব্যবধানে নেরোকাকে হারিয়ে না
চ্যাম্পিয়ন হয়ে যেতো।
ইস্টবেঙ্গল হওয়ার বাসনাটা
অবশ্য এদের নয়।কাশ্মীরে ফুটবলের জনপ্রিয়তা নিয়ে আর একজনের মনেও কোনো সন্দেহ ছিলোনা।"কাশ্মীর
মনিটর " সংবাদপত্রের কর্নধার ও সাংবাদিক শামিম মীরাজও স্বপ্ন দেখতেন কোনোদিন
জন্মু কাশ্মীরের কোনো ক্লাব সর্বোচ্চ স্তরে দাপিয়ে বেড়াবে।ইস্টবেঙ্গলের মতোই
বিদেশে গিয়ে মাঠ কাঁপিয়ে ট্রফি জিতে আসবে।লোনস্টার কাশ্মীরের সাফল্যে অনুপ্রানিত
হয়ে ২০১৬তে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন রিয়েল কাশ্মীর এফসিকে।আর্বিভাবের বছর থেকেই একের
পর এক অভিনব কাজকর্মে তাক লাগাতে শুরু
করেন তিনি।জুলাই'১৬তে ১২৮ বছরের পুরনো ডুরান্ড কাপে খেলে রিয়েল কাশ্মীর এফসি বড়মঞ্চে আত্মপ্রকাশ
করে।২০১৬-১৭ আইলিগে অংশগ্রহনের জন্য পাহাড়ি উপত্যকায় প্রথম বিদেশী কোচ নিয়ে আসে
তারা।স্কটল্যান্ডের জাতীয় দলের প্রাক্তন ও বিখ্যাত ক্লাব গ্লাসগো রেঞ্জার্সের
ফুটবলার ডেভিড রর্বাটসন খেলোয়াড়জীবনে ৬টি স্কটিশ টুর্নামেন্ট জিতেছেন।কোচিং জীবনে
ইংল্যন্ডের প্রিমিয়র ডিভিশনের ক্লাব লিডস ইউনাইটেডকে সামলেছেন।কোচ ডেভিডের
মাধ্যমেই ইতিমধ্যে একটা বড় চমক দিয়ে বসে আছে তারা।গতবছর জুলাই মাসে জন্মু
কাশ্মীরের প্রথম ক্লাব হিসেবে বিদেশে স্কটল্যান্ডের ক্লাব স্টেনহাউসম্যুয়রের সাথে
চারটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলে এসেছে তারা স্কটল্যান্ডে।জন্মু-কাশ্মীরের ফুটবল
ইতিহাসে এই অভিনব সাফল্যের অংশীদার হতে রিয়েল কাশ্মীর এফসির প্রতিনিধিদলকে নেতৃত্ব
দেন রাজ্যের অর্থমন্ত্রী হাসিব দ্রাবু ও জন্মু কাশ্মীর ফুটবলের পুরোধা জামির এ
ঠাকুর।গতবছর জানুয়ারি মাসে আইলিগ
দ্বিতীয় ডিভিশনে নেমে মূলপর্বের বাধা না টপকাতে পারায় আরো প্রস্তুুতি নিয়ে ফিরে
আসার প্রচেষ্টায় ছিলো তারা।
ফুটবলের জনপ্রিয়তা সব সময়েই শ্রীনগর ও সংলগ্ন
এলাকায় থাকলেও সেটা কোনোদিনই পরবর্তী পর্যায়ে উত্তরন ঘটাতে পারেনি ফুটবলের ভিত না
থাকায়।আইডল হিসেবে মেহরাজউদ্দিন ও ইসফাক আমেদ থাকলেও ফুটবল ক্লাব না থাকার দরুন
খেলাটা সেভাবে ছড়ানো যায়নি।এর পাশাপাশি প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি অনেকাংশে
বাধা দিয়েছে ফুটবলের প্রসারে।শীতকালে বরফ পড়ায় মাঠের অবস্থা শোচনীয় হয়ে দাঁড়ায়
প্রতিবছর। প্র্যাকটিসে নামার আগে দলবেঁধে মাঠে নেমে বরফ সরানোর কাজ করতে হতো
ফুটবলারদের কিছুদিন আগে পর্যন্ত।মাঠে বরফ পড়ায় পিচ্ছিল হয়ে থাকায় চোটআঘাতের
সম্ভাবনা বাড়তো।ফ্লাডলাইটের সমস্যায় ৩০০০০ আসন বিশিষ্ট বক্সী স্টেডিয়ামে নৈশালোকে
ম্যাচ করা যেতোনা।লোনস্টার ও রিয়েল কাশ্মীরের সাফল্যে জন্মু ও কাশ্মীর সরকার মাঠে সিন্থেটিক টার্ফ বসানোর ব্যবস্থা করে।শীতের
মরসুমে বরফে যাতে মাঠ নষ্ট না হয় তাঁর জন্য স্পেশ্যাল টিমের ব্যবস্থা করা
হয়।ফ্লাডলাইট বসানোর কাজও পুরোদমে শুরু হয়।রাজ্যের বিভিন্নপ্রান্তে ফুটবল ক্যাম্প
চালু করে দেওয়া হয় পুরোদমে।
লোনস্টার কোচ হিলাল রসুলের মতে তাঁরা এখনও পিছিয়ে
ম্যাচ খেলার সীমাবদ্ধতায়।একটা পেশাদার টিম যেখানে বছরে ৩০-৩৫ টা ম্যাচ খেলে সেখানে
কাশ্মীরের অশান্ত পরিবেশ ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারনে সেখানে ১৫ টা খেলার সুযোগও
ভালোভাবে পাননা।ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা থাকলে পরিকাঠামোর অভাবেও সামনে এগোনো যায়
তা প্রমান করে দিয়েছে সম্প্রতি দুই কাশ্মিরী তরুন মহম্মদ আবরার রেহবার ও বাসিত
আহমেদ।স্পেনের তৃতীয় ডিভিশনের ক্লাব সোসিদাদ ডের্পোতিভো লেনেন্সে প্রোইনোস্তুরে ছয়
মাসের প্রস্তুুতি নিয়ে এসেছে।আবরার ও বাসিত দুজনেই রিয়েল কাশ্মীর এফসির
নির্ভরযোগ্য সদস্য এখন।তবুও বিচ্ছিনতাবাদীদের খপ্পরে পড়ে কিছু প্রতিভাবান নষ্ট হয়ে
যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।এরকমই একজন ২০ বছর বয়সী গোলকিপার মজিদ খান কিছুদিন আগে লস্কর ই
তইবার শিবিরে যোগ দিয়েও শেষমেস ফিরে আসে সমাজের মুলস্রোতে।বাইচুং ভুটিয়া এগিয়ে এসে
তাঁর ফুটবল প্রশিক্ষণের সমস্ত ভার তাঁর কাঁধে তুলে নিতে চাইলেও শোনা যায়
প্রাথমিকভাবে সে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়।
বর্তমানে কাশ্মীর ফুটবলকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে রিয়েল
কাশ্মীর এফসি।আইলিগের দ্বিতীয় ডিভিশনের লড়াইতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল
তাদের।যদি নিজেদের দক্ষতায় আইলিগের মূলপর্বে উঠে আসে তাহলে নর্থ-ইস্টের মতোই
ভারতীয় ফুটবলের আর এক নতুন উজ্জ্বল আলোর দিশা মিলতেই পারে।যদি তাঁরা ইতিহাস সৃষ্টি
করতে পারে তাহলে একই লিগে এবার হয়তো ইস্টবেঙ্গল ও ইস্টবেঙ্গলের অনুপ্রেরনায় তৈরি
রিয়েল কাশ্মীরের মুখোমুখি ম্যাচ দেখার স্বপ্নও সত্যি করে ফেলবেন শামিম মীরাজ
সাহেব।
ফুটবল চাইলে সব হিংসা,হানাহানি ভুলিয়ে দিতে
পারে।বিশ্বকাপে মূলপর্বে যোগ্যতাঅর্জনের ম্যাচে জয়ের পরে দিদিয়ের দ্রোগবা ও তাঁর সাথীরা ড্রেসিংরুম থেকেই দেশে
ক্রমাগত হয়ে চলা যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁদের ধিক্কার জানিয়ে পরিস্কার জানিয়ে দেন এই
রক্তস্রোত বন্ধ নাহলে তাঁরা বিশ্বকাপে মাঠে নামবেননা।দ্রোগবাদের আবেদনে বিবদমান
দুই গোষ্ঠী নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে যুদ্ধবিরতির ডাক দেন।দ্রোগবারা দেশে ফেরার পর
দুই গোষ্ঠীর মধ্যে প্রীতি ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করে হিংসা বন্ধের সমর্থনে শপথ নেওয়া
হয়।সেরকমই বিচ্ছিনতাবাদীদের প্ররোচনায় পড়ে কাশ্মীরের নবপ্রজন্ম যে হিংসার পথ বেছে
নিয়েছে তাকে একমাত্র থামাতে পারে ফুটবলে তাদের সাফল্য।কিছু মানুষের নোংরা
দেশবিরোধী প্ররোচনায় নিরপরাধ কাশ্মীরিদের বাঁচিয়ে রাখতে রিয়েল কাশ্মীর ও লোনস্টার
কাশ্মীরের সর্বভারতীয় স্তরে নিয়মিত অংশগ্রহন খুবই প্রয়োজন।ফুটবল এর আগেও হিংসাকে
জয় করে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছে।আবারও পারবে নিশ্চয়ই।।
No comments:
Post a Comment