ব্লগ-টগ

প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশের ঘরোয়া সূত্র

Post Page Advertisement [Top]

To Place your advertisement here call - +917980316633/+918145704098
পর্ব - ৮


আগে যা ঘটেছে (ক্লিক করুন)


আমি রোজ দিনে রাতে দেখতে পাই,প্রতিমুহূর্তে অনুভব করি,এক অবিনাশী আত্মবিনাশ মুখব্যাদান করে আছে।একসময়ে গীতায়,তা পড়েছি,মহাভারতে পড়েছি,কিন্তু রক্তের মধ্যে তার শীতল হিমেল প্রবাহ অনুভব করলেও এই রকম দিবারাত্রের মধ্যে সঞ্চারীভাবের মত ঢুকে, ক্রমশ স্থায়িভাবের মত নিরবকাশ নিয়ে সে উদ্ভাসিত হয়নি।

এর কাছে,অসহায়ের মত,আমাকে,আপনাকে সবাইকে আত্মসমর্পণ করতে হবে।কী করলাম,কী করলাম না,কী লিখলাম,কী লিখলাম না,কী জানলাম,কী জানলাম না,কী আয়ত্তাধীন হল,কী আয়ত্তাধীন হল না,সমস্ত হিসেব যে আমার মৃত্যুর সঙ্গেই আমার কাছে শেষ।এই ভয়াবহ অনস্বীকার্য অনুপস্থিতির সামনে তাবৎ জীবনকে আমার পূর্ণ স্বপ্ন বলে মনে হয়।এই জীবনটাকেই স্বপ্ন বলে বোধ হওয়ার মধ্যেই কাল রাতে,রবীন্দ্রনাথের বলাকা ভাবলাম,আবার পড়ি।

সব এতদিনের পড়া আর জানাকে ফেলে,একটি এলিয়েন হিসেবে,একটি এলিয়েন টেক্সটের কাছে,দাঁড়াতে চাই।হঠাৎ দেখলাম,আমার এই দৈনিক বিষাদের নেশা না থাকলে কবি তো কখনো উনিশ নম্বর কবিতাটি লিখে ফেলতে পারেন না।কী করুণ তাঁর অবস্থা,কী ভঙ্গুর চূর্ণ্যমান অন্তরের কষ্ট,এ তো আমি চিনি।এই চেনার সঙ্গে যে চেনার যোগ হল,এইবার আমি হুঁশ পেলাম।এই কষ্টের প্রকৃতি বুঝি।কিন্তু হেতুটি কী?মনে রাখি হেতু,বিভাবের শব্দান্তর।

বিভাব আমার ও কবির আলাদা।কিন্তু তার আগে,ওই ওই যে,চেনায় চেনায় মিল হল,সেটিই গুরুগম্য ভাবাস্বাদ।গুরুতর রাস্তা।এই ভাবাস্বাদের পশ্চিমী বিপ্লবের নাম,ফেনোমেনলজি,বলে আমার সহৃদয় মন উপদিষ্ট হয়েছে ও বুঝেছে।আর নতুন করে বুঝতে ও জানতে এই মৃত্যুঘন প্রায়ান্ধকার প্রভাতে(যাকে বলে দিতে হবে,শিলচরে,এখন বৃষ্টি পড়ছে,তিনি ক্ষমা করবেন।)আমার আগ্রহ নেই,উদ্যমও নেই।
সমস্ত অপেক্ষা,সকালের চায়ের অপেক্ষা,আমার দৈনিক পরিচারিকার অপেক্ষা,কাগজের অপেক্ষা,গাড়ীর অপেক্ষা,ফিরে আসার অপেক্ষা,রাতের অপেক্ষা,ঘুমের অপেক্ষা,সমস্ত অপেক্ষা এক নিশ্চিত অবসানের দিকে ছুটে চলেছে।সেখানে সব বিবর্ণ,সব স্থির।

এই কালকে,সময়প্রবাহকে স্থির করে দিতে পারলেই তাহলে,অনিবার্য আত্মবিনাশের হাত থেকে একটা নিষ্কৃতি মেলে?কিন্তু তা কি সম্ভব?

পেরেছিলেন,কি আদিচর্যাপদরচয়িতা?চঞ্চল চিত্তমূষিকের কী হয়েছিল?আমি তো জানি না।আমি অনুভব করিনি।

পারে কি মানুষ তা?যদি বা পারে,সে কি বলা যায়?যে পারেনি,সে কি বুঝবে আদৌ?তাই খুব স্বাভাবিক যে এইকারণেই মৃত্যূত্তর নিয়ে বুদ্ধ স্বভাবমৌন।আদৌ ভাষায় মৃত্যুকেই ধরানো যাবে না।অন্যে সবে কথা কবে,তুমি রবে নিরুত্তর।মৃতর কোনো কথা নেই।মৃত্যুকালের কোনো কবিতা নেই।
সুতরাং ভাষার দৌড় আর কতদূর।এই প্রকাশিত পৃথিবীর উদ্দেশ্য - বিধেয়য় বাঁধা থাকতে সে বাধ্য।ফলত এই জগত ও জাগতিক মানুষের স্বপ্ন দুঃস্বপ্নের হাতের বাইরে সে যেতেই পারেনা।ফলে সে যাই প্রকাশ করুক,তার উদ্দেশ্য হয়ে যায়,তার বিধেয়র রূপক।এই রূপকের মায়ায় কি প্রতীক আসা সম্ভব?সম্ভব কি প্রণবের কালোত্তর আকাশ?না।

মালার্মে সে চেষ্টা করেছিলেন,কিন্তু পেরেছেন কিনা,আমি আর বলব না।কেন?আমার সে অধিকার নেই?কেন?তন্নতন্ন মালার্মে পড়ে,তন্নতন্ন নৈষ্ঠিকতায় বেদান্ত পড়ে,তন্নবিচারে অভিনবগুপ্ত পড়েও আমি বলতে পারতাম না,অন্তত এখনো,যে তাঁরা কালচক্রের উপরে উঠতে পেরেছিলেন,তাঁরা ক্ষণবিধ্বংসী মুহূর্তকে অনন্তের মধ্যে চিরজীবিত করতে পেরেছিলেন কিনা।

সাহিত্যও তা পারবে না।তাকে ভাষায়,এই 'স্থায়ীজড়জগতে পতিত হয়ে থাকতে হয়।নৈঃশব্দ্যের এই দরোজাকে সে পার হতে পারেনা।আমি পারব না।আপনারা পারুন।শুভেচ্ছা রইল।

কিন্তু মনে কি হয় না,এই ছড়িয়ে থাকা,নশ্বর বিশ্বকে আমাদের চির-নির্বেদগ্রস্ত আচার্যেরাও বিশ্বাস করতেই চাইতেন?কবির মতই একে ভালোবাসতে চাইতেন,এই আবশ্যিক বিনাশের মধ্যেও এক মায়া,তাঁদের চোখকেও ভোলাতো?যদি না ভোলাতো,তবে কি কাব্যতত্ত্বকে তাঁরা মোক্ষদর্শনের সমস্ত মনস্তত্ত্ববোধকে প্রয়োগ করে তৈরি করতেন?(অবশ্য করবারই কথা।কারণ,প্রকাশ মানেই তো মৃত্যুর encounter)

ব্রহ্মাস্বাদ নয়,কিন্তু মুহূর্তের সব ভুলে যাওয়া মনে,যে মৃত্যুঞ্জয়ী কালোত্তর আনন্দের বোধ হয়,তাকে নাবোঝা ব্রহ্মাস্বাদ না বলা যাক,কিন্তু তারই সহোদর বলতে তো বাধা নেই।তাকে তো আমি চিনি।তাহলে মরজগতের বোধ্যমানতায় ধরা পড়ে,এমন এক বোধকে মেটাফিসিকাল বোধের সহোদর বলে দেওয়া,মরজগতের মহত্ত্বকে মান্য করার প্রয়াসও বটে।এবং এও প্রমাণ,যে তাঁরা আমার মত করেই ভাবতেন,আমার মত করেই আতুর হতেন,এবং আমার মতই নিয়ত খোঁজে এক 

"আনন্দৈকমাত্রসুন্দর" ছাড়া আর কিছুকেই,হয়তো তাঁদের অনুভূত আমার অনুভূত নয়,এমন সেই পরম দুর্লভ ব্রহ্মাস্বাদ মৃত্যুঞ্জয়ের পাশে বসাতে পারেন নি।

সেইজন্যই কাব্যপ্রস্থান মরজীবনের শেষ সীমা।সেইজন্যই হকিঙকে ব্রিফ হিস্টরি লিখতেই হয়।
আমাকেও তাই সেই কবেকার ফেলে আসা অর্থহীন শূন্যধ্বনি একটা স্থানকে মাঝে মাঝে নাড়া দিতে হয়।কিন্তু আমি তো মহাকবিও নই,আদিকবিও নই,যে ত্রিকাল ও ত্রিলোকের মধ্যে পরিব্যাপ্ত হওয়ার নিয়ত অভ্যাসে,নিয়ত সেই কাল,ক্ষণবিধ্বংসী কালকে মনের মধ্যে পরাজিত করার আনন্দে,যাবতীয় অনুভূতিকে অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যতে পরিণত হতে দিতে দিতে,হয়তো-সাধকসহোদর হতে পারব!

সেইজন্য বিষাদ ক্রমশ এত গূঢ়তর হয়ে উঠছে,যে কিছুতেই মনকে আমি আবার সেই গলিতে নিয়ে গিয়ে ফেলতে পারছি না।তার জন্য পূর্ণ নির্লিপ্তি লাগে।তাই বুঝি,খাঁটি কবিরা কেন দলছুট।কেন তাঁরা এরাটিক,কেন তাঁরা স্বার্থপর।কেন কবিকে জগতের প্রতি পিছন করে দাঁড়িয়ে জগতের ভাষাতেই কথা বলে যেতে হয়।

কবি ও কাব্যতাত্ত্বিক যদি নিশ্চিন্ত দার্শনিক হন,তবে বড় ভয়ের কথা।লক্ষ করবেন,সুধীন দত্ত নিজের বৈদান্তিক পিতাকে নিশ্চিন্ত বৈদান্তিক বলে ঠেস মেরেছিলেন।
অনেকদিন ব্লগে আসিনি।আস্তে আস্তে আরেকটু সময় লাগবে।

আমার এক নিকট আত্মীয়কে একদা ভর্ৎসনা করে বলেছিলুম,তোমার জীবনে আর কিছু নেই বাছা?শুধু যৌনতা আর ধর্ম?মাঝামাঝি কিছু নেই?দুটিই তো স্বমেহন।

সে ছিল ফ্যাণ্টাসাইসার।আজ এই চূড়ান্ত নির্লিপ্তিকে নিজের অভ্যাসে পরিণত করবার রোজ প্রতিজ্ঞা করতে করতে বুঝি,চূড়ান্ত যৌনতায়,বা,চূড়ান্ত ধর্মে নিমজ্জিত থাকলে,বহু জ্বালা এড়ানো যায়।সে দুটিও তাই মৃত্যুর মধ্যে মৃত্যুবোধের মধ্যেও বোঝাপড়ার দুটি পথ বটে।
কিন্তু সেওতো সচেতন নির্বাচন হয় না।ভিন্নরুচিতে বিভিন্ন মানুষ।
,ভালো কথা বলে রাখি।মৃত্যুর বিরুদ্ধে একটা এনকাউণ্টার যে কাব্যজগৎ,দ্বন্দের যে একটা বিনত বোঝাপড়া কাব্যতত্ত্ব,এই প্রত্যয়ের মধ্যে মার্ক্সবাদী কাব্যতত্ত্বকেও হেসে খেলে জায়গা করে দেওয়া যাবে।কারণ তারও আদপ সঙ্গ্রাম,বাঁচার লড়াই।ধর্মবীরের বিশ্বাসলোকও যদি,এই কপালে জুটতো তবে বেঁচে যেতাম।কপালে নেইকো ঘি,ঠকঠকালে হবে কি?অথবা আরেকটা কথাও একটু বলে রাখি।মরে মরেও যে মনুষ্যের বোধের মধ্যেই আমার বোধও পড়ে,তা প্রমাণ হতে পারে,যদি আচার্যদের মধ্যে আমার এই নিয়তভঙ্গুরতার বোধ একইরকম টেন্সান তৈরি করছিল,তার প্রমাণ।প্রমাণটি অব্যর্থ।নিশ্চয়ত,তা রয়েছে,নবরসের মতান্তর সজ্জায়।ব্রহ্মাস্বাদসহোদর রসতত্ত্বের শেষ স্থায়িভাব,নির্বেদ।ব্রহ্ম পাতিলেবু না ব্রহ্ম,তা বাপ,সবছেড়ে বুঝে দেখ।"আমিও বুঝি নে"।

উদকচাঁদ জিম সাচ না মিছা।আর কি আশ্চর্য দেখুন,কামও বাঁচিয়ে রাখে।মুহূর্তের জন্য পৃথিবীতে সময় স্থির হয়ে যায়।রতিতে জীবন-কাব্যের আরম্ভ।যৌনতায় আরম্ভ বীররসের ধর্মাচার শেষ করে শমে শেষ করে দাও জীবনকে।

সমগ্র মানবজীবন তোমার হস্তামলক।তোমাকে তাকে আমলকির মতো ছুঁড়ে ফেলে,অজানা নৈঃশব্দ্যের দিকে চরন্স্বাদুমুদুম্বরম্ বলে চলে যেতে হবে।
সে বলা যত সহজ,সে করা তত সহজ নয়।নির্লিপ্তি অর্জন এত বড় ব্যাপার,যে বোঝাই যায় না,সে কার মধ্যে কতটা?আমি প্রবল লিপ্ত,তাই প্রকট বেদনায় ভারাতুর।

ভারতের বিভিন্ন জনজাতির মানুষের সঙ্গে কথা বলার একটু সৌভাগ্য আমার এই জীবদ্দশায় হয়েছে।যদি পারি এক সদ্যোলব্ধ বন্ধুর গল্প শীঘ্রই লিখব।
মনে রাখবেন,কখনো ভুলবেন না,ভারত একটি মৃত্যুসচেতন তত্ত্বভূমি।


(ক্রমশ...)  

No comments:

Post a Comment

Bottom Ad [Post Page]

To Place your advertisement here call - +917980316633/+918145704098