ব্লগ-টগ

প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশের ঘরোয়া সূত্র

Post Page Advertisement [Top]

To Place your advertisement here call - +917980316633/+918145704098


চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন মূল ব্যক্তিত্ব।সি.আর দাশ নামে তিনি সমধিক পরিচিত এবং সাধারণের কাছে "দেশবন্ধু" বলে আখ্যায়িত।তিনি বিশ শতকের বাংলার সবচেয়ে প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অন্যতম।বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরের এক উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারে চিত্তরঞ্জন দাশ ১৮৭০ সালের ৫ নভেম্বর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতা ভূবনমোহন দাশ কলকাতা হাইকোর্টে ‘সলিসিটা’র ছিলেন।প্রথম জীবনে তিনি ভবানীপুরের(কলকাতা) লন্ডন মিশনারি সোসাইটির ইনস্টিটিউশনে শিক্ষা লাভ করেন।১৮৮৫ সালে তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করেন এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৮৯০ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।এরপর ইংল্যান্ডে গিয়ে ইনার টেম্পলে যোগদান করেন এবং ১৮৯৪ সালে ব্যারিস্টার হন।ঐ একই বছর তিনি ভারতে ফিরে আসেন এবং কলকাতা হাইকোর্টে ব্যারিস্টার হিসেবে নিজের নাম তালিকাভুক্ত করেন।১৯০৮ সালে অরবিন্দ ঘোষের বিচারে চিত্তরঞ্জন দাশকে পেশাগত মঞ্চের সম্মুখ সারিতে নিয়ে আসে।তিনি এমন চমৎকারভাবে কেসটির পক্ষসমর্থন করেন যে অরবিন্দকে শেষ পর্যন্ত বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। তিনি ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলার(১৯১০-১১) বিবাদি পক্ষের কৌশলী ছিলেন।তিনি দীউয়ানি ও ফৌজদারি উভয় আইনে দক্ষ ছিলেন।

                   বিশ শতকের প্রথম দিকে চিত্তরঞ্জন দাশ রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।অনুশীলন সমিতির মতো বিপ্লবী সংগঠনের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন,যা ছিল তখন বাংলার মূল সমিতিগুলির মধ্যে একটি।সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী,বিপিনচন্দ্র পাল ও অরবিন্দ ঘোষের সহকর্মী হিসেবে তিনি বঙ্গভঙ্গ(১৯০৫)-কে বাংলায় বিপ্লবী কার্যকলাপ বিস্তৃত করতে সদ্ব্যবহার করেন।১৯১৭ সালে ভবানীপুরে অনুষ্ঠিত বাংলার প্রাদেশিক সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন তিনি। অসহযোগ আন্দোলন(১৯২০-২২)চলাকালে গান্ধীর আহবানে সাড়া দিয়ে আইনজীবীর পেশা পরিত্যাগ করেন এবং ১৯২১ সালে "প্রিন্স অব ওয়েলস"-এর কলকাতা সফর বর্জনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন।সরকার তাঁকে অনেকবার কারাগারে অন্তরীণ করে।গান্ধী যখন অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করেন তখন চিত্তরঞ্জন দাশ তার তীব্র সমালোচনা করেন এবং বিষয়টিকে গুরুতর ভুল বলে নিন্দা করেন।তাঁর মতে, গান্ধীর এ কাজ রাজনৈতিক কর্মীদের মনোবল বহুল পরিমাণে কমিয়ে দেয়।ঐ চরম সংকটপূর্ণ সময়ে তিনি পরিষদে প্রবেশ কর্মসূচি অর্থাৎ পরিষদের অভ্যন্তরে অবস্থান নিয়ে অসহযোগ চালিয়ে যাবার সূত্র নিয়ে এগিয়ে আসেন।কংগ্রেসের আইন পরিষদ বর্জনের নীতিকে তিনি দৃঢ়ভাবে বিরোধিতা করেন। তিনি মনে করতেন যে, সরকারকে অবিচল, অবিচ্ছিন্ন ও দৃঢ়ভাবে বাধাদানের উদ্দেশ্যে আইন পরিষদে প্রবেশাধিকার অর্জন করা অবশ্যই প্রয়োজন। ১৯২২ সালের ডিসেম্বর মাসে গয়ায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে পরিষদে প্রবেশ সংক্রান্ত তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়। অতঃপর তিনি কংগ্রেসের সভাপতির পদে ইস্তফা দেন এবং পন্ডিত মতিলাল নেহরু,হাকিম আজমল খান,আলী ভ্রাতৃদ্বয় ও অন্যান্যদের সহযোগিতায় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে স্বরাজ্য দলের ভিত্তি স্থাপন করেন।১৯২৩ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় বিধান পরিষদের নির্বাচনে "স্বরাজ দল" উল্লেখযোগ্য বিজয় অর্জন করে।
                 দেশবন্ধুর অভিমত ছিল যে,বঙ্গীয় আইন পরিষদ এ বলিষ্ঠ গ্রুপ সৃষ্টিকারী মুসলিম সদস্যদের আন্তরিক সহযোগিতা ব্যতিরেকে স্বরাজবাদীদের বাধাদানের নীতি সফল হবে না।বস্ত্তত,দৃঢ় প্রত্যয় ও বিশ্বাসসহ তিনি ছিলেন রাজনৈতিক বাস্তববাদী এবং প্রচন্ড বিরোধিতার মুখেও তিনি নিজ অবস্থান থেকে কখনও বিচ্যুত হতেন না।তিনি নিজে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের জ্বলন্ত অগ্রদূত ছিলেন বলে বাংলার সাম্প্রদায়িক সমস্যা দূরীকরণে স্মরণীয়ভাবে সাফল্যলাভ করেছেন।"বেঙ্গল প্যাক্ট" নামে সাধারণভাবে পরিচিত এক চুক্তির মাধ্যমে তিনি বাংলার মুসলমানদের আস্থাভাজন হয়ে তাদেরকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন।১৯২৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত স্বরাজ্য পরিষদ দলের এক সভায় চুক্তিটির শর্তাবলি গৃহীত হয়। দুঃখের বিষয় যে, বাংলায় কংগ্রেসের অনেক নেতা চুক্তিটির বিরোধিতা করে।
সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী,বিপিনচন্দ্র পাল ও অন্যান্যদের নেতৃত্বে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণির হিন্দুরা এটির বিপক্ষে অনমনীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলে।তাদের ভয় ছিল যে,চুক্তিটি হিন্দু সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক প্রভাব দুর্বল করে ফেলবে।তারা চিত্তরঞ্জন দাশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে যে, তিনি হিন্দুদের অধিকার বিসর্জন দিয়েছেন।এমনকি অনেক মধ্যপন্থি হিন্দু নেতা মনে করেন যে,তিনি মুসলমানদের আস্থা অর্জন করার চেষ্টায় অনেকটা ছাড় দিয়েছেন।বাংলার মুসলমানগণ সর্বান্তঃকরণে চুক্তিটিকে স্বাগত জানায়।কিন্তু ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কোকনদ সেশনে চুক্তিটি বাতিল করা হলে তাদের মোহমুক্তি ঘটে।তাদের মতে,কোকনদ কংগ্রেস যে মস্ত ভুল করে সেটি ছিল কংগ্রেস আন্দোলনের ইতিহাসে জঘন্যতম ও এ ভুল হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের ক্ষেত্রে এবং কংগ্রেসের মুখ্য উদ্দেশ্যের প্রতি চরম আঘাত হেনেছে।ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস যে অবস্থান নিয়েছিল,চিত্তরঞ্জন দাশ তার সমালোচনা করে ঘোষণা করেন,"তোমরা সভার সিদ্ধান্তসমূহ থেকে বেঙ্গল প্যাক্টকে মুছে ফেলতে পার,কিন্তু
 ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস থেকে বাংলাকে বাদ দিতে পারবে না...এ রকম শিষ্টাচারহীন রীতিতে বাংলাকে মুছে ফেলা যাবে না। যারা চিৎকার করে বলে যে ‘বেঙ্গল প্যাক্টকে মুছে ফেল’ তাদের যুক্তি আমি বুঝতে পারি না...বাংলা কি অস্পৃশ্য? এ রকম একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করার বাংলার অধিকারকে কি তোমরা অস্বীকার করবে?যদি তোমরা তাই কর, বাংলা তার নিজের ব্যবস্থা নিজেই গ্রহণ করতে পারবে। তোমরা অভিমত ব্যক্ত করার ব্যাপারে বাংলার অধিকারকে প্রত্যাখ্যান করতে পার না"।যদিও ভারতীয় কংগ্রেস কর্তৃক মেনে নিতে অস্বীকার করা হয়েছে,তবু ১৯২৪ সালের জুন মাসে সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলন কর্তৃক তিনি চুক্তিটির শর্তাবলি অনুসমর্থন করিয়ে নিতে সক্ষম হন।
                 ১৯২৪ সালে কলকাতা কর্পোরেশন-এর নির্বাচনে স্বরাজবাদী বিজয় অর্জন করে এবং তিনি প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন।পরবর্তী মেয়াদের জন্যও তিনি পুনঃনির্বাচিত হন।১৯২৩ ও ১৯২৪ সালে যথাক্রমে লাহোর ও কলকাতায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত শ্রমিক ইউনিয়নের কংগ্রেসে তিনি সভাপতিত্ব করেন।১৯২৫ সালে ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন।১৯২৩ সালে তিনি স্বরাজ্য দলের মুখপত্র হিসেবে সাপ্তাহিক দ্য ফরওয়ার্ড প্রতিষ্ঠা করেন।১৯২৪ সালে তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের মুখপত্র মিউনিসিপ্যাল গেজেটও প্রতিষ্ঠা করেন।তিনি জাত-বৈষম্য ও অস্পৃশ্যতার ঊর্ধ্বে ছিলেন।তিনি নারী মুক্তি সমর্থন করতেন এবং নারী-শিক্ষা ও বিধবাদের পুনর্বিবাহকে উৎসাহিত করতেন।তিনি যে অসবর্ণ বিবাহের পক্ষে ছিলেন তার প্রমাণ মিলে তাঁর নিজ কন্যাদের ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ পরিবারে বিবাহ দানের ঘটনায়।
                  মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে ১৯২৫ সালের জুন মাসে দেশবন্ধুর মৃত্যু হয়।তাঁর অকালমৃত্যু বাংলা ও একই সাথে ভারতের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উপর আঘাত হানে।আবুল কালাম আজাদ মন্তব্য করেছেন যে,"তিনি অকালে মারা না গেলে দেশে নতুন অবস্থা সৃষ্টি করতেন"।তিনি আরও বলেন,"পরিতাপের বিষয় এ যে,তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কিছুসংখ্যক অনুসারী তাঁর অবস্থানকে জর্জরিত করে এবং তাঁর ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে।এর ফলে বাংলার মুসলমানরা কংগ্রেস থেকে দূরে সরে যায় এবং ভারত বিভক্তির প্রথম বীজ বপন করা হয়"।


No comments:

Post a Comment

Bottom Ad [Post Page]

To Place your advertisement here call - +917980316633/+918145704098