১.
কন্ডাক্টর হাঁক দিলো,- "সুতাহাটা!...
সুতাহাটা !"...
চুল ছোট করে ছাঁটা।রোদে পোড়া চামড়া,পেটানো শরীর।সীট
ছেড়ে উঠলো এক যুবক। হ্যাণ্ডেল ধরে সরে এলো দরজার কাছে।
"গাড়ি থামাও! নামবো।"- মরা মাছের মতো
ঠাণ্ডা দৃষ্টি রাখলো সে, কন্ডাক্টরের চোখের গভীরে।"কতক্ষন চিৎকার করিটি, শুনতে পা... "
বাক্য শেষ করতে পারলোনা কন্ডাক্টর! তার পুরো
অস্তিত্ব কেঁপে উঠলো! এ-লোক চোখে কথা বলে! ভয়ঙ্কর! একপাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দিলো
সে। নামলো সত্যজিৎ।নিজের জন্মস্থানে এলো সে; ছুটিতে নয়, এবার পেশাগত দায়িত্ব কাঁধে
নিয়ে।মিশন, সতী!
২.
সতী, মোনহরপুরের এক কৃষক পরিবারের শিক্ষিত
কন্যা।মোনহরপুরের আবালবৃদ্ধবণিতার সবার
দিদি।এর দুঃখে, ওর আনন্দে, তার অভিযোগে সদা হাজির সতী৷ ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো
সাধনকে।সাধন স্কুলশিক্ষক মোনহরপুরের সহজসরল পিতৃমাতৃহীন সাধন, পুরো এলাকার
মাশ্টারদা।
সেদিনের বিয়েতে, পুরো মোনহরপুর মেতে ছিলো মহা
উৎসবে।পাশের গ্রামের রাজনৈতিক নেতা মুরারী তখন ক্রোধে অন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো।সতীকে
দ্বিতীয় স্ত্রী বানানোর স্বপ্ন দেখেছিলো সে। প্রস্তাব দিতেই,সপাটে উপহার পাওয়া
থাপ্পড়টা গেঁথে গিয়েছিলো কেবল বামগালে নয়,কলিজায়ও! বামগালে হাত বোলালো মুরারী।
জ্বলে! শুধু গাল নয় , সারাদেহ জ্বলে উঠেছিল! অপমানে, ক্রোধে,ব্যর্থতায়!তক্কেতক্কে
রইলো সে। সে জানে, সে আদায় করে নেবেই,সতীর দেহ। নিজেকে ঈশ্বরের কাছাকাছি ক্ষমতাবান
ভাবে মুরারী!স্কুল প্রাঙ্গনে রাজনৈতিক সভা করা না-করা নিয়ে তর্কাতর্কিকে, প্রথমে
হাতাহাতি অত:পর লাঠালাঠিতে গড়িয়ে নিয়ে, মেরে ফেলা হলো সাধনকে, মাস্টারদা কে পুরো
মোহরপুর কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে ছিলো টানা তিন সপ্তাহ!উরুসন্ধি চুলকাতে চুলকাতে
অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিলো মুরারী৷নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলো সে,তার ক্ষমতা
ঈশ্বরসম!মুরারীর তর সইলোনা আর!স্বামীর ভিটা আঁকড়ে পড়ে থাকা সতীর ঘরে ঢুকে গেলো, এক
মধ্যরাতে! বাইরে সাঙ্গপাঙ্গ দের পাহারা দরজা বন্ধ করে দিলো মুরারী। শিশুর ক্রন্দন,
ধস্তাধস্তি, উচ্চ-অনুচ্চ খিকখিক-তামাশা ঝঞ্ঝা, বিদ্রোহের পর,গগনবিদারী চিৎকার!
নাহ্! নারীর নয়! পুরুষের, মুরারীর!টলতে টলতে কোনো মতে দরজা খুলল মুরারী। ধপ্! পড়ে
গেলো দরজার মুখে, অন্ধকার উঠোনে।রক্ত বন্যায় ভেসে যাচ্ছে উলঙ্গ মুরারীর কোমরের
নিচ!তারপর বেরিয়ে এলো এক রূপ, নারী নয়, ঝড়! বিদ্রোহ! বিপ্লব!সতী... বিস্ফারিত চোখে
সর্পিণীর হিসহিস শব্দে,এসে দাঁড়ালো, চিৎ হয়ে পড়ে হাঁপরের মতো শ্বাস নিতে থাকা
মুরারীর বুকের উপর পা রেখে!স্ব দলবলে পালানোর আগে, পাহারায় থাকা সাঙ্গ পাঙ্গরা
কাঁপতে-কাঁপতে দেখল এলোচুল,লুটানো আঁচল, ডানহাতে বাঁকানো বটি! আর, বামহাতে বড়ো
মুরারীর অণ্ডকোষসমেত জননাঙ্গ৷নিজেকে ঈশ্বর ভাবার স্বপ্ন একেবারে শেষ হয়ে গেল৷
৩.
পুলিশ এলো।সতী নেই।
সতী-সাধনের ভিটায়, ঢল নেমেছে গ্রামের,দ্বিতীয়বার
আর কিংকর্তব্য বিমূঢ় হল না মোনহরপুর।প্রতিজ্ঞায় মুষ্টি বাঁধলো এবার পুলিশের
ভয়-ভীতি, আদর-আহ্লাদ, কিছুতেই কিছুই হল না৷ জন্মমূক মোহরপুর!সতীর খোঁজ কেউ দিতে
পারলো না, কিংবা দিলোনা, মোনহরপুর প্রমাণ দিলো, এ-গ্রাম বিশ্বাসঘাতক নয়! দিন
দুপুরে অদৃশ্য করে দিলো ওরা জলজ্যান্ত সতীকে!নিশীথের কোলে তখন আটমাসের শিশু,
নিলাব্জ।
৪.
তদন্তের দায়িত্ব বর্তালো দুর্ধর্ষ সাব-ইন্সপেক্টর
(তদন্ত) সত্যজিৎ এর কাঁধে।যুবক অফিসার। 'আবেগ' শব্দটি তার অচেনা!প্রশাসনের বড়ো
কর্তারা ইতিমধ্যেই নিশ্চিত,- এই ছেলে বহুদূর যাবে!রাষ্ট্রের অন্ধকার জগৎ কাঁপিয়ে
দেবে এই তীক্ষ্মধী যুবক৷ রাষ্ট্রের সম্পদ এই অফিসার৷ সত্যজিৎ এর কাছে, আইনের
ধারাগুলো মহাগ্রন্থের বাণীসম! ভুল করে একটি পাথরের বুকে আত্মা দিয়ে দেওয়া হলে যা
হয়,সে তা-ই!তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার সাথে- সাথেই, বেরিয়ে পড়লো৷ কোন্ পদ্ধতিতে
সমুদ্র তটের অসীম বালুকা রাশির মাঝখান থেকে ছোট্ট নোলকটি খুঁজে পেতে হয়, তা তার
নখদর্পণে!
৫.
"কেমন আছেন সতী?",- মরামাছের শীতল চোখে
তাকিয়ে রইলো সত্যজিৎ।
কেঁপে উঠলো সতী! অকারণে কেঁদে উঠলো মায়ের বুকে
চাপা শিশুপুত্র, নীল(নীলাব্জ)৷
৬.
এটি গল্প হলে, সতী পালাতে পারতো সত্যজিৎ এর
সহযোগিতায়; কিংবা, উভয়েই প্রেমে পড়ে যেতে পারতো উভয়ের; অথবা, তৎক্ষণাৎ আত্মহত্যা
করতে পারতো সতী;আর, কারাগারে তো যেতে পারতোই।
৭.
বছর আঠারো পরে, এক কিশোর একটি অণুগল্প লিখলো,
রামপুর কলেজের বার্ষিক গল্প প্রতিযোগিতায়। সেবছরের কলেজ ম্যাগাজিনে ছাপানোও হলো
গল্পটি,-
"এক চৌকষ পুলিশ অফিসার, একজন খুনী নারীকে
গ্রেফতার করতে গিয়ে, নারীটির চোখের গভীরে তাকিয়ে বলেছিলেন- 'কিছু অপরাধের বিচার
করার জন্য পৃথিবীতে এখনো আদালত তৈরি হয়নি৷কিছু মানুষকে বিচার করার ক্ষমতা মানুষ
কোনোদিনই অর্জন করতে পারবেনা। কেবল এ-বাক্য দু'টো বলার জন্যই তন্নতন্ন করে খুঁজেছি
আপনাকে,বোন।"
সেদিনই, রাষ্ট্রের অপার সম্ভাবনাময় দুর্ধর্ষ পুলিশ
অফিসারটি, নিজের ব্যর্থতার দায় কাঁধে নিয়ে, তদুপরি নিজের পেশা ও রাষ্ট্রপ্রদত্ত
দায়িত্বের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নিয়ে, ক্যারিয়ারের প্রায় প্রারম্ভেই,স্বেচ্ছা
অবসরে চলে গিয়েছিলেন৷ অফিসারটির স্বল্প মেয়াদের ঈর্ষনীয় ক্যারিয়ারের ওটাই ছিলো
একমাত্র ব্যর্থতা!
খুনি নারীটি প্রকৃতই খুনি ছিলেন। তবে তিনি খুন
করেছিলেনআগাছা,
সামাজিক আগাছা! তদন্ত করতে গিয়ে, সবই জেনে
ফেলেছিলেন যুবক অফিসার। তদন্তে তিনি অপার বিস্ময়ে আরো দেখেছিলেন- সামান্য একজন
কৃষককন্যার খুনের অপরাধটি কী নির্দ্বিধায় নিজেদের কাঁধে নিতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো
পুরো একটি গ্রাম!
অণুগল্পটির শিরোনাম ছিলো অদ্ভুত!- 'ভুলিনি'!
অণুগল্পটির লেখকের নাম ছিলো- 'নীলাব্জ!'
৮.
নিজের ছোট্ট প্রেসের ভাঙ্গা চেয়ারটিতে বসে, নিজের
হাতে ছাপানো রামপুর কলেজের ম্যাগাজিনের একটি অণুগল্পের উপর ঝুঁকে রইলো, কাঁচাপাকা
খোঁচা দাড়ি,চোখে পুরু লেন্সের চশমা পরিহিত, ক্যারিয়ারের শুরুতেই স্বেচ্ছা অবসরে
চলে যাওয়া সাবেক পুলিশ অফিসার।
টপ!... টপ!...
টপ!... টপ!...
ভিজছে বইয়ের পৃষ্ঠা
(কাঁদছে পাথর)!...
No comments:
Post a Comment