শিরডির সাঁইবাবা
সম্পর্কে প্রথম শুনেছিলাম আমার বন্ধু শুভ্রর কাছে। হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোর্স করে
ইনটার্নশিপ করার সুযোগ পেয়েছিল শিরডির এক হোটেলে। শুধু নিরামিষ খাবার পাওয়া যায়
বলে সেখানে আর কাজ করেনি ও কিন্তু জায়গাটার নাম জেনেছিলাম। এরপর কয়েক বছরের মধ্যে
শিরডি পর্যন্ত ট্রেন হল হাওড়া থেকে সরাসরি ট্রেন চালু হল। মোট কথা বাংলার ঘরে ঘরে
সাঁইবাবা স্থান পেলেন।
আমার বিয়ের আগে
আমার শ্বশুর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তাঁর সুস্থতার
কামনায় আমার শাশুড়ি সাঁইবাবার কাছে মানত করেছিলেন। কিন্তু তিনবছর পরেও সে মানত
রাখতে শিরডি যাওয়া হয়ে ওঠেনি। মানতটা অনেকদিন পেন্ডিং আছে। শাশুড়ি আর বউকে নিয়ে
আমিই চললাম শিরডি।
অনেক ইন্টারনেট
গবেষণার পর দেখা গেল পঁচিশে ডিসেম্বর সোমবার পড়েছে। শনি থেকে সোম আর গোটা তিনেক
দিন ছুটি নিলে ভালভাবে শিরডি ঘুরে আসা যায়।
দেখা গেল শিরডি যাওয়ার সরাসরি ট্রেন চলে শুক্রবার। আমরা যেতে চাই শনিবার। হাওড়া থেকে মানমাড যাওয়ার বেশিরভাগ ট্রেন মাঝরাত্রে মানমাড পৌঁছায়। শেষে পাওয়া গেল পুনে দুরন্ত। সকালবেলা সুবিধাজনক সময়ে মানমাড পৌঁছায়। ভাগ্য ভাল সেই ট্রেনে এখন মানমাড পর্যন্ত বুকিং করা যায় না হলে পুনে পর্যন্ত টিকিট কেটে যেতে হত। এই ট্রেনে আবার ডায়নামিক ফেয়ার।
দেখা গেল শিরডি যাওয়ার সরাসরি ট্রেন চলে শুক্রবার। আমরা যেতে চাই শনিবার। হাওড়া থেকে মানমাড যাওয়ার বেশিরভাগ ট্রেন মাঝরাত্রে মানমাড পৌঁছায়। শেষে পাওয়া গেল পুনে দুরন্ত। সকালবেলা সুবিধাজনক সময়ে মানমাড পৌঁছায়। ভাগ্য ভাল সেই ট্রেনে এখন মানমাড পর্যন্ত বুকিং করা যায় না হলে পুনে পর্যন্ত টিকিট কেটে যেতে হত। এই ট্রেনে আবার ডায়নামিক ফেয়ার।
ট্রেনের পরে হোটেল বুকিং। জানা গেল সাঁই ভক্তদের জন্য যাত্রী নিবাস আছে। সেখানে বেশ সুলভে থাকা যায়। গুগল জানাল বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বটে। ভক্তিনিবাসে পাঁচশোর বেশি ঘর থাকলেও কোনো অজ্ঞাত কারণে সেই সময় অনলাইনে বুকিং হচ্ছিল না। বাইরের হোটেল বুকিং করতে গিয়ে এক অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যার মুখোমুখি হলাম। বেশিরভাগ হোটেলে দুপুর বারোটায় চেক ইন। এদিকে আমাদের ট্রেন মানমাড পৌঁছে যাবে সকালে। শিরডি পৌঁছে যাব বারোটার ঢের আগে।
অনেক খেটে খুটে একটা হোটেল পাওয়া গেল যাদের চেক ইন সকালে। গুগল জানাল আগের অতিথিরা ভালোই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। মন্দির আর বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু দূরে হলেও ফ্রি ট্রান্সফার আছে। সব থেকে বড় কথা এদের তিনজনের জন্য ঘর আছে। এতক্ষণে হোটেলটার নাম মনে পড়ল। হোটেল ডেল্টা এক্সিকিউটিভ। বুকিং করে ফোন করে কনফার্ম করে নিলাম যে বুকিং সার্থক হয়েছে। এবারে সাঁই সাক্ষাতকার চাই। ভারতের অন্যান্য ধর্মস্থানের মত এখানেও ফেলো কড়ি মাখো তেল। দুশো টাকা দিয়ে দর্শনের শর্টকাট আদায় করা যায়। অনলাইনের ব্যবস্থা আছে। দর্শন ছাড়া আরতি ইত্যাদি প্রভৃতি অর্থকরী অন্যান্য ব্যবস্থাও মজুত।
অনলাইনে ছবি ও আধার কার্ড দিয়ে দর্শনের শর্টকাট টিকিট করলাম। দুপুর একটায় দর্শন আর পৌনে একটায় রিপোর্টিং চার নম্বর গেটে। ছশো টাকার পর দশ টাকা কনভিনিয়েন্স চার্জ লাগল। এমনিতে কনভিনিয়েন্স চার্জ আমার ভীষণই অসুবিধা জনক লাগে কিন্তু এবেলা উপায় নেই। একদিনের মধ্যেই দর্শন সেরে ফিরতে হবে, সময় কম, ভীষণ কম।
বলে রাখা ভালো সাঁই সাইটে এইচডিএফসি ব্যাংক ছাড়া অন্য ব্যাংকের ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড নেওয়া হয় না। তবে বেশ কিছু ব্যাংকের নেটব্যাংকিং চলে। আমাকেও স্টেট ব্যাংকের নেটব্যাংকিং সুবিধা চালু করাতে হয়েছিল এইজন্য।
যথাসময়ে ট্যাক্সিতে চেপে শ্বশুরবাড়ি থেকে শাশুড়িকে তুলে হাওড়া রওনা দিলাম। তেইশে ডিসেম্বরের সূর্য সবে দিনের আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের বুকিং ছিল বি টু তে। কিন্তু ট্রেন ছাড়ার দেড়ঘন্টা আগে স্টেশনে পৌঁছে গেলে ট্রেন তো আগে আসবে না। তারপর ফাঁকা ট্রেন আসে সাঁতরাগাছি থেকে। ট্রেনে ওঠার সময় যথারীতি একচোট ধাক্কাধাক্কি হল। আমাদের পরের কিউবিকলের লোকজন আমাদের কিউবে বসে গেছিল। এসব না হলে আর ট্রেন জার্নি করার মজা কোথায়।
টাটানগর রাউরকেলা বিলাসপুর হয়ে ট্রেন চলতে লাগলো| একসময় রাতের খাবার খাওয়া শেষ হল, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডাও বাড়ছে যেটা এসির বাইরে এলে বোঝা যাচ্ছে। এর মধ্যে শিরডির হোটেল থেকে ফোন করে আমাদের আসা কনফার্ম করেছে। কাল সকাল সকাল মানমাড পৌঁছে গেলে রক্ষে। এদিকে ট্রেন ক্রমশ লেট হচ্ছে|
সকাল পাঁচটা
পঞ্চান্নতে মানমাড নামতে হবে বলে পাঁচটায় অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম উঠে দেখলাম
ট্রেন সবে ভুসাওয়াল পার করল। আরো লেট করে প্রায় নটার সময় ট্রেনটা মানমাড পৌঁছাল।
এদিকে আমার চিন্তা শুরু হয়ে গেছে। মানমাড থেকে শিরডি আটান্ন কিলোমিটার রাস্তা।
আমাদের হোটেলে পৌঁছে স্নান করে কিছু খেয়ে পৌনে একটায় রিপোর্টিং করতে হবে।
এদেবদ্বিজ কতটা পাংচুয়াল জানা নেই, দেরি হলে শেষে
ছশো দশ টাকা জলে যাবে।
মানমাড স্টেশনে
ওভারব্রিজ থাকলেও র্যাম্প নেই। ট্রলি ব্যাগ টেনে বাইরে এসেই গাড়ি পেলাম। অটো থেকে
ছোট বড় নানান মাপের গাড়ি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। শিরডি এবং নাসিক দুই জায়গায় যাবার
জন্য। আমরা পার হেড দেড়শ টাকায় শেয়ারে শিরডি বাসস্ট্যান্ড যাবার জন্য মারুতি
ওমনিতে উঠলাম। আমরা তিনজন ছাড়া আরো দুজন দম্পতি উঠল যারাও কলকাতা থেকে আসছে আর
শিরডি যাবে। সঙ্গে একাধিক লাগেজ। কোনোভাবে গাড়ির ছাদে ক্যারিয়ারে সব বেঁধে রওনা
দেওয়া গেল।
মানমাড থেকে আহমেদনগর গামী হাইওয়ের মাঝে শিরডি। মহারাষ্ট্রের অন্য জায়গার মত রাস্তা বেশ ভালো। প্রধানত দু লেনের রাস্তা হলেও কিছুটা চার লেনের। মানমাড স্টেশন থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে বাসস্ট্যান্ড। এমএসআরটিসির প্রচুর লাল বাস চলাচল করে এইপথে। শুধু শিরডি না, মুম্বই, পুনে, ঔরঙ্গাবাদ, এমনকি সোলাপুর কোলহাপুর পর্যন্ত বাস যাচ্ছে।
শিরডির মাইলফলকে কমতে কমতে যখন আট কিলোমিটার তখন থেকে বাড়িঘর হোটেল-মোটেল শুরু হল। চার কিলোমিটারের মাথায় দেখিসে এক জ্যাম। চার লেনের হাইওয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। গাড়ি বাস অটো সব বাঁদিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। সোজা রাস্তা নো এনট্রি। আমাদের গাড়িও বাঁদিকে বেঁকে এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে চলতে লাগল। সেই গলির রাস্তায় কী জ্যাম।
এদিক ওদিক ঘুরে আমাদের সহযাত্রীদের নামিয়ে গাড়ি আমাদের বাসস্ট্যান্ডের উল্টো দিকে ছেড়ে দিল। সেখানেও এক প্রস্থ ব্যারিকেড। পুরো বিষয়টা কিছুটা ক্লিয়ার হল। মানমাড থেকে আহমেদনগর যেতে বাঁদিকে রাস্তার ওপরেই সাঁই সমাধি মন্দির। আজ প্রচুর দর্শনার্থীদের ভিড় তাই দুদিকে রাস্তা ব্যারিকেড করা আছে। সব গাড়ি এমনকি বাসও ঘুরপথে যাচ্ছে।
হোটেল ফোন করতে গাড়ি পাঠিয়ে দিল। টাটা ম্যাজিক। দুমিনিটের মধ্যে হোটেলে পৌঁছে গেলাম। ততক্ষণে সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। চেক ইন করে খাবার অর্ডার দিলাম। হোটেলের মালিক সম্ভবত অন্ধ্রপ্রদেশের লোক। ইডলি আর বড়া এসে গেল রুমে। গরমজল দিয়ে স্নান করে আবার দৌড় লাগাতে হল মন্দিরের দিকে। এখানে জলের খুব অভাব। তাই নোটিশ লাগানো জল অপচয় না করতে। এগারোটা পর্যন্ত গরম জল পাওয়া যাবে বলা থাকলেও আমরা গরম জল পেয়েছিলাম।
চব্বিশে ডিসেম্বর হলেও দিনের বেলা একদম ঠান্ডা নেই এদিকে। হোটেল থেকে বেরিয়ে নির্দেশিত পথে মন্দিরের দিকে হাঁটা দিলাম তিনজনে। পথে ডালাওয়ালার খপ্পরে পড়তে হল। কী সব ছিটিমিটি জিনিস গছিয়ে সাড়ে আটশো টাকা ঠকিয়ে নিল। তবে একটা ইনফো জানা গেল রিপোর্টিং টাইম মিস হলেও পরের স্লটে ঢুকতে পারা যায়। আমি যদিও সেটা টোটাল ঢপ মনে করে উড়িয়ে দিয়েছিলাম।
আগেই বলেছি
রাস্তার উপরেই সাঁই সমাধি মন্দির। বাঁদিকে এক আর দুনম্বর গেট সাধারণ দর্শনার্থীদের
ভিড় উপছে পড়ছে। তাঁদের দাঁড়ানোর জন্য শেডের ব্যবস্থা আছে। পরে জেনেছিলাম চার পাঁচ
ঘন্টা এমনকি দশ বারো ঘন্টাও লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। তিন নম্বর গেট দিয়ে বেরোনোর
রাস্তা। মন্দিরের আশে পাশে এক ইঞ্চি জায়গা না ছেড়ে তৈরি হয়েছে হোটেল বাড়ি দোকান।
ডানপাশের গলি দিয়ে কিছুটা ঠেলে গেলে পরে চার নম্বর গেট। সে গলি কাশীর গলিকেও হার
মানাবে।
তার আগে বাঁদিকে পরে দ্বারিকামাই। এখানে সাঁইবাবা সম্ভবত ধ্যান করতেন। সেটাও দেখা হল। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা দুটো পার। চার নম্বর গেটের সামনে বিশাল লাইন। সবার হাতেই রশিদ। জিগজ্যাগ লোহার চ্যানেলের মধ্যে সারা ভারতবর্ষ দাঁড়িয়ে। গরম থেকে বাঁচতে উপরে ছাউনি আর পাখা ঘুরে চলেছে।
একপাশে বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্নদের ঢোকার ব্যবস্থা যদিও তাতেও বাকিদের ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টা। আশেপাশে যা দেখলাম মহারাষ্ট্র অন্ধ্রপ্রদেশ তেলঙ্গানা আর মধ্যপ্রদেশের লোক বেশি। পাশাপাশি রাজ্য বলে। সবার কাগজ তিনটের স্লটে ঢোকার জন্য। সুবিধা বা অসুবিধা হল এক লাইনেই নারী পুরুষ নির্বিশেষে ঢুকতে পারবে। কিছুক্ষণ পরে লাইন এগোতে এগোতে একজায়গায় কলকাতা থেকে করে নিয়ে যাওয়া প্রিন্ট আউট গুলো দিয়ে মন্দিরে ঢুকে পড়লাম। ভিড়ের মাঝে সেসব খুলেও কেউ দেখল না। যাই হোক অলি গলি সিঁড়ি বেয়ে সমাধিমন্দিরে প্রবেশ করলাম। আমার হাঞ্চ বলছিল ডানদিক বরাবর গেলে সবথেকে সুবিধাজনক পজিশনে থাকা যাবে।
একসময় সাঁইবাবার মূর্তির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সেই আটশো টাকার ব্যাগ ছুঁয়ে গেল মূর্তির পা। চলতে চলতে মন্দির থেকে বেরিয়ে এলাম। একজায়গায় প্রসাদ স্বরূপ মিছরি পাওয়া গেল সবাইকে একটা ছোটপাউচ। সঙ্গে এক বাক্স ছাই। এটারও কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল ভুলে গেছি। মন্দিরের বাইরে অথচ কমপ্লেক্সের ভেতরে আরো অনেক মন্দির অফিস দোকান এসব ছিল। একটা কথা না বললেই নয় সেটা হল যদিও মন্দির ভোর চারটে থেকে রাত দশটা পর্যন্ত খোলা থাকে| সেদিন বিশাল ভিড়ের জন্য মাইকে ঘোষণা করা হচ্ছিল সেই রাতে মন্দির সারারাত খোলা থাকবে।
তখন বেজায় খিদে
পেয়েছে। সকালের ইডলি কখন হজম হয়ে গেছে। দেখলাম বাকি দুজনের একই অবস্থা। তিন নম্বর
গেট দিয়ে বাইরে এসে সেই দোকান খুঁজে বের করলাম। বলতে ভুলে গেছি চটি/জুতো আর মোবাইল
দোকানে জমা রেখে গেছিলাম। ফলে পদে পদে সন্ত্রস্ত থাকতে হচ্ছিল নিজেদের হারিয়ে না
ফেলি। আমার রবারের সোল লাগানো কাপড়ের জুতো রেখে যেতে হয়েছিল অথচ চামড়ার বেল্ট পরে
দিব্যি ঘুরে এলাম।
বাইরে প্রচুর দোকান। নিম্বু পানি ডাবের জল এসব খাওয়ার পর কিছু মেমেন্টো কেনা হল। সঙ্গে আমন্ড আর কিসমিস। নাসিকে আঙুর চাষ হয় জানতাম কিন্তু কিসমিস কেমন হবে সেই নিয়ে সংশয় ছিল। আমি বলেছিলাম টক হলে মুড়ির মধ্যে মিশিয়ে ওটাই সাঁইয়ের প্রসাদ বলে চালিয়ে দিতে।
এদিকে অটো রিকশা গাড়ি সবাই আমরা পুজো দিয়ে বেরিয়েছি দেখে শনিসিগনাপুর বলে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। কিন্তু তখন বেলা প্রায় পড়ে এসেছে আর অচেনা জায়গায় অন্ধকারে না যাওয়াই সিদ্ধান্ত হল। আমি নিজেও আগ্রহী ছিলাম না কারণ শুনেছি শনিসিগনাপুরে নাকি মহিলাদের মন্দিরে ঢোকার অধিকার নেই। সত্যি মিথ্যে জানি না তবে এইরকম সেক্সিস্ট ব্যাপারে দূরে থাকাই শ্রেয় মনে করলাম।
তারপর বাসস্ট্যান্ডে এসে খোঁজ নিলাম ফেরার বাসের। বিশাল বাসস্ট্যান্ড এবং এসপ্ল্যানেডের মত নোংরা না। কাউন্টারে সব নাগরী স্ক্রিপ্টে লেখা। ফেরার সময় আমাদের কল্যাণ হয়ে ফেরার ছিল| জিগ্যেস করে জানা গেল কল্যাণ যাবার বাস সকাল 7.30, 8.30 আর 10.30এ পাওয়া যায়। চার থেকে সাড়ে চার ঘন্টা সময় লাগে। নন এসি টু বাই টু সিট। এর আগে জলগাঁও থেকে অজন্তা যাওয়ার সময় এমএসটিসির বাসে চড়েছিলাম সে অভিজ্ঞতা বেশ ভালো।
সত্যি কথা বলতে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া অন্য যেসব রাজ্যে সরকারি বাসে চড়েছি দিল্লি ছাড়া সর্বত্র ভালো সার্ভিস পেয়েছি। দিল্লির বাসেও সার্ভিস ভালো শুধু কন্ডাক্টররা হেল্পফুল না| যাই হোক পাশের কাউন্টারে নাম মোবাইল নাম্বার বলে কম্পিউটারাইজড টিকিট পেলাম সিট নাম্বার সমেত। কাল সকাল 8.30এ বাস এখান থেকেই ছাড়বে। ডিপো থেকে টার্মিনালে বাস ঢুকলেই মাইকে বলা হবে। আশ্বস্ত হয়ে বাসস্ট্যান্ড ছাড়লাম।
এই বাসের ব্যাপারে অনলাইনে বুকিং করা যেত কিন্তু বাসের হালচাল না বুঝে আমি বুকিং করাইনি। যাই হোক বাসের টিকিটটা হয়ে যাওয়াতে বেশ আশ্বস্ত লাগছিল। সারাদিনের পরিশ্রম আর উদ্বেগ মিটে যাওয়াতে হোটেলে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। বাসস্ট্যান্ড থেকে হোটেল কাছেই, মালপত্র না থাকলে হেঁটে যাওয়াই যায়। ফেরার পথে মহারাষ্ট্র ডেয়ারির লোকাল আইসক্রিম খেলাম, বেশ ভালো খেতে। আগেই বলেছি শিরডি সম্ভবত ভ্যাজ শহর এবং অ্যালকোহল বর্জিত। সিগারেট আর গুটকা বিক্রি হতে দেখেছি তবে কলকাতার মত পিক ফেলে রাস্তা রাঙানো একেবারেই নেই|
হোটেলে ফিরে চা আর সঙ্গে নিয়ে যাওয়া স্ন্যাকস খাওয়া হল। খোঁজ নিয়ে জানা গেল হোটেলে শুধু অন্ধ্র থালি পাওয়া যাবে। সেটা যে টক হবে সেটাও তারা লজ্জা লজ্জা মুখে জানিয়ে দিল। ইতিমধ্যে আমার বউ কল্যাণে তার বড়মামাকে জানিয়ে দিয়েছে আমরা আগামীকাল দুপুরে কল্যাণ পৌঁছে যাচ্ছি।
সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ইনফোটা দিলেন আমার মেজো মামাশ্বশুর। সন্ধান দিলেন সাঁই প্রসাদালয়ের। যেখানে নাকি বিনা পয়সায় সারাদিন খাবার পাওয়া যায়। বিনা পয়সার লাইনে ভিড় থাকলে পাশে পয়সা দিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থাও আছে। সেটা ফাঁকা থাকে আর পঞ্চাশ টাকা করে টিকিট করতে হয়। যাইহোক এটা আমাদের একটা সমস্যার সমাধান করল। আগে ঠিক করেছিলাম আমি আর আমার বউ বাইরে থেকে খেয়ে আসব আর শাশুড়ির জন্য কিছু খাবার কিনে আনব।
হোটেলে সন্ধ্যায় শুয়ে গড়িয়ে সাড়ে আটটা নাগাদ তিনজনেই বেরিয়ে পড়লাম। গুগল ম্যাপে দেখাচ্ছে প্রসাদালয় একটু দূরে। অটো নিতে হবে। হোটেল থেকে বেরিয়ে একটা অটো দাঁড় করিয়ে প্রসাদালয় বলতে সে ডানদিকে হাত দেখিয়ে কী সব দেখাচ্ছে আর মাথা নাড়ছে। এখানেও অটো রিফিউজাল? ভালোভাবে শুনে বুঝলাম অটোওয়ালা বলছে সামনের মাঠ দিয়ে ডানদিকে তিন মিনিট হেঁটে গেলেই নিউ প্রসাদালয়। আমার শাশুড়ি তাও জিজ্ঞেস করলেন ওটাই কি অরিজিনাল প্রসাদালয়? তাতে জানা গেল আগের প্রসাদালয়ে জায়গা কম পড়ছিল তাই নতুন প্রসাদালয় বানানো হয়েছে একসঙ্গে দশহাজার লোক বসিয়ে খাওয়ানোর জন্য।
একটু হাঁটতেই প্রসাদালয়ের নিওন আলো দেখা গেল। অটোওয়ালা অনায়াসে আমাদের এদিক ওদিক ঘুরিয়ে পঞ্চাশ একশো টাকা নিয়েও নিতে পারত। প্রসাদালয় একটা বিশাল বাড়ি যার একতলায় হলঘরে একসঙ্গে দশহাজার লোক খেতে পারে। আমরা যখন পৌঁছালাম তখন ফ্রি প্রসাদের কাউন্টারে কোনো ভিড় নেই। এখানে ফ্রি মানে একেবারে ফ্রি| কোনো কিছু লাগে না। তবে পাশে দানপাত্র রাখা আছে চাইলেই কেউ কিছু দিতে পারেন| যাই হোক কুপন নিয়ে সোজা ডাইনিং হলের দিকে।
একতলায় হলঘরে মুখোমুখি বসার স্টীলের টেবিল চেয়ার। একটা সারিতেই পাশাপাশি একশোর বেশি লোক বসতে পারে। মুখোমুখি দুটো রো ভর্তি হলেই পরিবেশন শুরু। চাকা লাগানো বড় সাইজের ট্রলি তাতে কোনো খোপে ভাত কোনো খোপে ডাল তরকারি। ভাত রুটি ডাল আর তিনরকম তরকারি দিয়ে তৃপ্তি করে খেলাম। ল্যামিনেশন করা কাগজের খোপকরা থালা। সঙ্গে স্টীলের গ্লাসে জল। অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
রান্নায় দক্ষিণ
ভারতের ছোঁয়া থাকলেও কষ্টকর টক না। সর্বত্র বড় বড় হরফে লেখা খাবার নষ্ট না করার
আবেদন করা আছে। একদিকে লোক খেতে বসছে অন্যদিকে
খাওয়া শেষ করে উঠে যাচ্ছে। সারা ভারতের লোক একঘরে জমা হয়েছে| এও এক দেখার মোট এক্সপেরিয়েন্স।
খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধোয়ার প্রশস্ত বেসিন আছে হলের বাইরে। আমরা ঘুরে দেখলাম বিল্ডিং এর বাকি অংশ। দোতলায় পঞ্চাশ টাকা কুপনের খাওয়ার হল।
ওঠার জন্য লিফট আছে। সেখানের মেনু জানা হয়নি। বিরাট বোর্ডে নিয়মাবলী লেখা আছে,
যারা এই প্রসাদালয়ে খাবার খাওয়ানোর জন্য দান করতে চান| একবেলা, একদিন, একমাস
বিভিন্ন টাকার পরিমান| একটা দেখেছিলাম ১৮লক্ষ টাকা, তাতে কতদিনের দান হবে মনে নেই|
খেয়ে একটু আশেপাশে এরিয়াটা এক্সপ্লোর করতে বেরোলাম। সাঁইবাবার একটা বড় ছবি পছন্দ করেও নিয়ে আসার অসুবিধার জন্য কেনা হল না। প্রসাদালয়ের সামনে একটা বড় পার্কিং| তখন রাত্রের যাত্রীরা বাস ধরছে ফিরে যাবার জন্য। একটা ব্যানার দেখে জানলাম সাঁইবাবার প্রয়াণের একশো বছর উপলক্ষ্যে এক বছর ধরে বিশেষ দর্শনপর্ব চলছে| আমরা গিয়ে পড়েছিলাম ঠিক সেই মোক্ষম সময়ে| ওষুধের দোকান থেকে একপাতা অ্যাভোমিন কিনে হোটেলে ফিরে এলাম। কাল সকালে ওটার জোরেই ইগাতপুরী থেকে কাসারা থলঘাটের পাহাড়ি রাস্তার বাঁক পার করব। চলে যাব শিরডি থেকে কল্যাণের দিকে।
এরপর শিরডি বেড়ানোর আর অল্প একটু বাকি থাকে। সকালে উঠে স্নান করে চেকআউট করার সময় জানা গেল কুক আসেনি বলে ব্রেকফাস্ট পেতে দেরি হবে। প্ল্যান চেঞ্জ করে শুধু চা খাওয়া হল। গাড়ি যদিও আটটার আগে আসেনা কিন্তু আমাদের জন্য আগে এসে গেল। এতক্ষণে পাহাড়ি ঠাণ্ডা মালুম দিচ্ছে। গাড়ি করে বাসস্ট্যান্ডে আসতে লাগল ঠিক দুমিনিট পর আরো দুমিনিটের মধ্যে জানা গেল আট নম্বর খিড়কি থেকে বাস ছাড়বে। বাস যাবে উরান তাই সামনে নাগরী ভাষায় সেটাই লেখা থাকবে।
শাশুড়ি কে বাসস্ট্যান্ডে বসিয়ে আমি আর আমার বউ গেলাম ব্রেকফাস্ট করতে। পাশের একটা দোকানে এত ভালো সম্বর বড়া খেলাম যে এখনও মুখে লেগে আছে। আমি নিশ্চিত আবার কোনওদিন শিরডি গেলেও পঁচিশে ডিসেম্বরের সকালে সেই সম্বর বড়ার স্বাদ আর ফেরত পাবো না। তা যাই হোক শাশুড়ির জন্য প্যাক করে আনা ইডলি খেতে খেতেই বাস এসে গেল।
এমএসআরটিসির লালবাসের ড্রাইভারের কেবিনে মালপত্র তুলে দিলাম। আগে পরে দুটো উইন্ডো সিটে আর একটা আইল সিটে আমরা বসে গেলাম। বাসের সব সিট ভর্তি হয়ে গেছে যদিও কেউ দাঁড়িয়ে নেই। বাস কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে আটটায় দুবার হর্ন বাজিয়ে শিরডি বাসস্ট্যান্ড থেকে ছেড়ে দিল। আমরাও কল্যাণের পথে এগিয়ে চললাম। বাইরে তখন পঁচিশে ডিসেম্বরের সকালের রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়েছে।
শেষে যেটা না বললেই নয়, সংক্ষেপে বলি| একশো বছরেরও বেশি আগে একজন মানুষ যে সংহতির বার্তা দিয়েছিলেন তার টানেই সারা দেশ থেকে সব ধর্মের মানুষ ছুটে আসেন শিরডিতে| একটা নামকে কেন্দ্র করে মহারাষ্ট্রের একটা গ্রামের এলাকার যা উন্নয়ন হয়েছে তা দেখার মত| রেল আর রাস্তা ছাড়াও, আমরা যখন যাই সেই সময় থেকেই মুম্বই আর হায়দরাবাদের সঙ্গে শিরডির বিমান পরিষেবা শুরু হয়েছে। যে সংস্থা বা ট্রাস্ট এই ধর্মস্থান পরিচালনা করে তাদের বেশ কিছু দায়িত্ব থেকেই যায় এলাকার জন্য। এখানে প্রসাদালয় ছাড়াও হাসপাতাল আছে দেখেছি। সর্বত্র দর্শনার্থীদের সেই হাসপাতালে রক্তদানের জন্য উত্সাহিত করার নোটিশ দেওয়া|
শিরডির যে সব
মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয় তাদের মধ্যে একটা বেসিক সততার নজির পেয়েছি। মানমাড থেকে
আসা অন্য ধর্মের মারুতি চালক জ্যাম দেখে ভাড়া বাড়ানোর দাবি করতে পারতেন।
বাসস্ট্যান্ডের আগেই নামিয়ে দিতে পারতেন| ডালাওয়ালা আটশো টাকা নিলেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইনফো দিয়েছিলেন যেটা আমি
প্রথমে ঢপ ভেবেছিলাম। অটোওয়ালার কথা আগেই বলেছি। হোটেলও আমাদের টক কম খাবার বানিয়ে
দেব বলে ওদের থেকে ডিনার করতে উৎসাহিত করতে পারত। সকালেও কুক আসার কথা গোপন করে
দেরি করিয়ে দিতে পারত। কিন্তু সেসব হয়নি। যেসব কিসমিস আর আমন্ড আমরা কিনেছিলাম
সেগুলোও ভালো ছিল।
ট্রেনের টিকিটের জন্য:
**********
যোগাযোগের জন্য:
Saugata Sengupta
370 Subhash Nagar Road
2nd Floor
Kokata 700065
Mobile: 9836482622
E-mail: saugatalk@gmail.com
No comments:
Post a Comment