ব্লগ-টগ

প্রকাশ্যে আত্মপ্রকাশের ঘরোয়া সূত্র

Post Page Advertisement [Top]

To Place your advertisement here call - +917980316633/+918145704098
- অদিতি বন্দ্যোপাধ্যায় 

কৈশোর,তারুণ্যের চারণভূমি কলেজস্ট্রিট বইপাড়া,কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়,প্রেসিডেন্সি কলেজ। তার আগে স্কুল ও মহাত্মা গান্ধী  রোডের আসে পাশে ,সবই  হাঁটা রাস্তা। পথের ধারে তখনও  বেশ কিছু ঘোড়ার জল খাওয়ার পাত্র ,বাথটবের মতো দেখতে ,যদিও তা অন্য কাজে ব্যবহার হতো । রাস্তার ধারে কোনো ব্যাকুল বীথি,শালের বন ,নিদেন পক্ষে  কলা বাগান ,কিংবা বাঁশবাগান ছিল না । ট্রাম লাইন আর পিচ রাস্তা ,গাড়ি ঘোড়া ব্যস্ত মানুষের ক্যাকাফোনি। সেইরকম সদ্য কৈশোরে পাঠ্য বই এর মধ্যে পরে ফেলতে হলো অনবদ্য সেই লাইন গুলো -
    
'একেলা জগৎ ভুলে ,পরে আছি নদী কূলে 
পড়েছে নধর বট হেলে ভাঙা তীরে ,
ঝুরু ঝুরু পাতাগুলি কাঁপিছে সমীরে' 

মহাত্মা গান্ধী রোডে কিছু ফেরীওয়ালার ডাক আর টাইম কলের জল আসার শব্দ তার সাথে বিহারী দুই সমবয়সী মাসি বোনঝি র শালপাতা ছাই দিয়ে বাসন মাজার শব্দ ,সাথে তাদের একটানা ভোজপুরি ভাষায় গল্প -এই নিয়ে ছিল  আমার দুপুর -মধ্যাহ্ন । সে সবেরই মধ্যে কবি অক্ষয় বড়াল ঝিম ধরিয়ে দিলেন আমার মনে । সেই ঝিম মারা দুপুরের মায়াজাল   অদৃশ্য কুবো পাখি র কুব কুব ডাক যেন শুনতে পেলাম ফেরীওয়ালার ডাক পেরিয়ে  , কৈশোরের কল্পনা কে স্বপ্নের জালে জড়িয়ে নিয়েছিল আমার এবং অনেকেরই - 
'খসে খসে পরে পাতা ,
মনে পরে কত গাঁথা ,
ছায়া ছায়া কত ব্যথা ,
ঘুরে ধরা ধামে।' 

এক অপূর্ব নিটোল গ্রাম্য ছবি –
‘দূরেতে পথিক দুটি চলে যায় গুটি গুটি মেঠো পথ দিয়া।
পাশ দিয়ে নিয়ে জল ,
আঁখি দুটি ঢলঢল 
কুলবধূ দ্রুত গেলো লাজে চমকিয়া।'।

এ ছবির পটভূমি  শ্যামল তরুর বাংলা না হয়ে যায় না – 
'কোন দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল ,
কোন দেশেতে চলতে গেলেই দলতে হয় রে দুর্বাকমল ?' 

আমাদেরই বাংলায় এসব কবিতা  পরীক্ষা সূত্রে ,কিংবা অনিবার্য সংস্কৃতিই হোক ঠোঁটস্থ ,কন্ঠস্থ অনেকেরই ,আজ ও। এ রীতির ধারা পথহারা হয়েছিল ..হালে|পরীক্ষার রীতি নীতি পাল্টালো,পাল্টানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ছিলো ক্রমশ ,সর্বভারতীয় পরীক্ষার নিরিখে বাংলা নম্বরের তালিকায় পিছিয়ে পড়ছিলো ক্রমশ। আমাদের অনেকেই সেই কৃপণ হাতের নম্বর প্রাপ্তির যন্ত্রনার শিকার হয়েছি বাস্তব কর্মক্ষেত্রে । তবে  সত্তর,আশি,কিংবা নব্বইয়ের দশকে যাঁরা বাংলা পরীক্ষা স্কুল কিংবা সম্ভবত বোর্ডেও  দিয়েছেন তাদের প্রশ্নপত্রে একটা সংকটের মুখোমুখি  সবাই হয়েছেন এরাজ্যে - 'কবিতার প্রথম আট লাইন মুখস্থ নামাতে হতো,কবির নাম শুধু এবং সেটা দাঁড়ি, কমা সমেত , এছাড়াও হাইফেন , ড্যাশ ইত্যাদি প্রভৃতির সংকট ও কিছু কম ছিলোনা ! তবে হ্যাঁ ,নামিয়ে  দিতে পারলে ছাঁকা ৬,৭ এমনকি আটে আট ও পাওয়া যেত । স্কুলের পরীক্ষায় কড়া মাস্টারমশাইরা কোনো কোনো সময় শেষ আট লাইন ও মুখস্থ লেখার প্রশ্ন দিতেন । সেই সূত্রে পরীক্ষার জন্য প্রথম যে কবিতা মুখস্থ করতে হয়েছিল তা হল -  
'ছোট শিশু মোরা, 
তোমার করুণা হৃদয়ে মাগিয়া লব,
জগতের কাজে জগতের মাঝে আপনা ভুলিয়া রবো।'   

কবিতা  - প্রার্থনা , কবির নাম -  যোগীন্দ্রনাথ সরকার ।

রবীন্দ্রনাথ ,নজরুল ছাড়া বেশ কয়েকজন কবি আমাদের শৈশব ,কৈশোর বেশ খানিকটা দখল করে নিয়ে ছিলেন তাঁদের কবিতায় ,তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য যতীন্দ্রমোহন  বাগচী ,যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত , অক্ষয় বড়াল ,সুনির্মল বসু ,,জসিমুদ্দিন,,দেবেন্দ্র নাথ সেন ,,কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ,কামিনী রায়  আরো অনেকে |যাঁদের রচনার আঁতুরঘর তৈরী হয়েছিল কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী র হাতে ,সেই আঁতুড়ঘরের ছাত্র ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও ।

কাহিনী,নীতি,এসব ছাড়াও শুধু ব্যক্তিগত ভালো লাগা ,খারাপ লাগা ,প্রকৃতি,নারী ,প্রেম এসব বিষয় নিয়ে লেখার যে স্রোত বইতে শুরু হল ,সেই পিরামিড এর ঊর্ধ্বতম চূড়ায় রবীন্দ্রনাথ সে তো বলাই বাহুল্য |কিন্তু আরো কিছু কবি হৃদয় বিহারীলাল ,রবীন্দ্রনাথ কে মাথায় রেখেই কবিতার জার্নি শুরু করেন -অক্ষয় কুমার বড়াল তার মধ্যে অগ্রগণ্য।

এই কবিতা গুলো প্রৌঢ়ত্বে এসে একটা যেন ঠান্ডা হাওয়া দেহে মনে ছড়িয়ে দিয়ে যায় । 

'নদীর কাছে শিক্ষা পেলাম আপন বেগে চলতে ,
মাটির কাছে সহিষ্ণুতা পেলাম আমি শিক্ষা'  

কিংবা,

'বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র' -- সুনির্মল বসুর সেই অপূর্ব লেখনী - 'আকাশ আমায় শিক্ষা দিলো উদার হতে ভাই রে .....।'
  
আমাদের অভিভাবকরা সকালে ঘুম ভাঙিয়ে ছিলেন -

'ভোর হলো দোর খোলো ,খুকুমনি ওঠরে ,
ওই দ্যাখো জুঁই সাথে ফুল কলি ছোটরে ,
রবি মামা দেয় হামা গায়ে রাঙা জামা ওই ,
দারোয়ান গান গে শোনো ওই রাম হৈ',

মা রা জামা পড়াতে পড়াতে ,চুল বাঁধতে বাঁধতে ,আমাদের কানের কাছে নিরলস গুন্ গুনিয়ে যেতেন সেই সব ভ্যালুজ – ‘আপনারে বড় বলে ,বড় সেই নয় ,লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয় --কে সেই কবি হরিশ চন্দ্র মিত্র ?কিন্তু আজ কেন চারপাশ দেখলে কানে সেই কবিতা গুনগুনিয়ে যায় মন্ত্রের মতো ,যেন আমায় ভেতর থেকে টান মারে, দম্ভের প্রকাশ না করতে বলে। অথবা চতুর্দিকে যখন উপচে পড়ছে শহুরে ঐশ্বর্য - সেই ভাবসম্প্রসারণের জন্য ছোট দুটো পংক্তি মনে পড়ে যায় -'যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি ,আশু গৃহে তার,দেখিবে না আর নিশীথে প্রদীপ ভাতি' কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার । 

'পারিবনা এ কথাটি বলিও না আর ,কেন পারবে না তাহা ভাব একবার' - এসব পংক্তি কোনো ছাপা অক্ষরে আমাদের মনে পড়ে না , কিন্তু শ্রুতি র প্রয়োগে কানে গুঞ্জরিত হয়ে যায় ,সেই ভাবেই স্মৃতিতে থেকে গ্যাছে একান্নবর্তী ,কিংবা একা দোকা র সংসারে মা বাবারা ঠাকুমা ,পিসিমার  চলতে ফিরতে এইসব পংক্তি আউড়ে যেতেন কখনো সচেতন হয়ে আবার কখনো অভ্যাসে  আর আমাদের অন্তঃস্থলে ঢুকে যেত অজান্তে ,অনায়াসে । এর জন্য বই খুলতে হয়নি আমাদের অনেকেরই। 

'সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি ,
সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি 
ভাই বোন সকলেরে যেন ভালোবাসি,
একসাথে থাকি যেন সবে মিলে মিশে।' 

লেখক কবি মদন মোহন তর্কালংকার বাড়িতে ভালো খাবার এলে শেয়ার করতে শিখতে হয়নি আলাদা করে ।  শিখতে হয়নি  - কেননা এই সব কবিরা - যাঁরা বিস্মৃত , অ-চর্চিত,কাব্যগুণের  বিশ্লেষণে অপাংক্তেয় , এঁদের নিয়ে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে গবেষকরা কয়েকটি পংক্তি মাত্র খরচ করেছেন, আবার কেউ কেউ সেখানেও যায়গা পাননি তাঁরা কিন্তু অজান্তে আমাদের অনেকেরই মূল্যবোধ কে মার্জিত করেছেন ,জায়গা করে নিয়েছেন আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে আর ডানা মেলতে শিখিয়েছেন সেই রূপকথার দুপুরে । 


No comments:

Post a Comment

Bottom Ad [Post Page]

To Place your advertisement here call - +917980316633/+918145704098